সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু (পর্ব ২) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২১ জুলাই ২০২০ ২২:২১

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪৪

ছবিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

 

১৯৫২-এর ২৭শে জানুয়ারী ডাকসুর ছাত্রনেতারা মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হল। ১৯৪৮ সারের ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ফজলুল হক হল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করল মধুর ক্যান্টিন।

ভাষা আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলবার জন্য ৩০শে জানুয়ারী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সংগ্রাম কমিটিতে আওয়ামী লীগ, যুব লীগ, খিলাফতে রাব্বানী পার্টি, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ থেকে দু'জন দু'জন করে প্রতিনিধি নেয়া হয়। কমিটির আহবায়ক ছিলেন গোলাম মাহবুব। কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আবুল হাশেম, আতাউর রহমান খান, কমরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, খারেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক প্রমুখ। বলাবাহুল্য, এই সময়ে শেখ মুজিব জেলে ছিলেন।

২১শে ফেব্রুয়ারি (৫২) আন্দোলনের পথিকৃত ১১ই মার্চের (৪৮) আন্দোলন ছিল এই ঐতিহাসিক ‘না' ধ্বনির উত্তাল তরঙ্গ। ঢেউ লাগলো সারা প্রদেশে। স্বাধীনতাকামী জনসমষ্টির যেন নবযাত্রা শুরু হল। তরুণ সমাজ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর থেকে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। পুলিশের মুখোমুখি। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।

১১ই মার্চের ধর্মঘট পালনের কর্মসূচী সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আগের দিন অর্থাৎ ১০ই মার্চ ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাপকভাবে পিকেটিং করার সদ্ধিান্ত নেয়া হয়। নির্দিষ্ট দিনে ছাত্ররা পিকেটিং শুরু করে। তারা ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করতে থাকলে সরকারের নির্দেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ধর্মঘটের জন্য পিকেটিং-এর সময় যে সব ছাত্রনেতা বন্দী হন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁকে প্রথমে কোতোয়ালী থানায় ও পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

১২ই মার্চে জগন্নাথ কলেজে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ছাত্ররা মিছির বের করে। পুলিশী জুলুম ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ঢাকার সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।

১১ই মার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ই মার্চে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং তা ১৫ই মার্চ পযৃন্ত অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

১৪ই মার্চে ঢাকাসহ প্রদেশের সকল জেলাতেও পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়।

১৫ই মার্চ তারিখের ধর্মঘটে পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেন। সেক্রেটারীয়েটের কর্মচারী, অন্যান্য অফিসের বাঙালী কর্মচারী, এমনকি শেষ পযৃন্ত রেল কর্মচারীরাও তাঁদের কাজ ফেলে রেখে ধর্মঘটে যোগ দেন। পুলিশও পাইকারী হারে গ্রেফতার করতে থাকে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতারের গেটের সামনে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষেপ করে।

১৫ই মার্চ পূর্ব বাংলার অ্যাসেম্বলীর বৈঠক বসার কথা। ঐদিনই মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের বাসভবন বর্তমান বাংলা একাডেমিতে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক চলাকালীন ধৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে একটি বিরাট মিছিল রাত্রি ন'টা পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভের ফলে সরকার শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজন ছাত্রনেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৬ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। তিনি সর্বসম্মতিক্রমেই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। উক্ত সভায় পূর্বে অনুষ্ঠিত ফজলুল হক হলের বৈঠকে গৃহীত সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয় এবং গৃহীত প্রস্তাবগুলো নাজিমুদ্দিনের নিকট পৌঁছে দেবার জন্য অলি আহাদের হাতে দেয়া হয়। অতঃপর বক্তৃতা পর্ব শেষ হলে একটি মিছিল অ্যাসেম্বলী ভবনের দিকে যাত্রা করে।

পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ১৭ মার্চ ঢাকায় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ঐদিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা শুরু হয়। সে সভায় শেখ মুজিবের অনুরোধে অলি আহাদ বক্তৃতা করেন বলে অলি আহাদ উল্লেখ করেছেন।

জনাব অলি আহাদের বর্ণনা ও জনাব বদরুদ্দীন উমরের বয়ানকৃত বক্তব্য পাশাপাশি পাঠ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তা হলো বদরুদ্দীন উমরের লেখা ব্যক্তি-আক্রোশ ও বিদ্বেষ দুষ্ট যা শালীনতা বিবর্জিত ও নির্লজ্জ-ইতিহাসনিষ্ঠ নয়।

বদরুদ্দীন উমর তার বইতে যা বলতে চেয়েছেন জনাব তোয়াহার স্মৃতিচারণমূলক লেখাটিতে তা আরো উলংগভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত একুশের সংকলন ঃ ১৯৮১ স্মৃতিচারণে তোয়াহা সাহেব তদানীন্তন আইন পরিষদ সদস্য তোফাজ্জল আলীর উত্তরে বলেছিলেন, “মুজিবের সাথে আমাদের আবার কি কথা হবে। মুজিব তো ঢাকার ছাত্রনেতা নয়। ঢাকার ছাত্রনেতা হচ্ছে হল ইউনিয়নের ভি.পি. আর জি.এস.-রা।”

শুধুমাত্র শেখ মুজিবকে ছোট করার জন্যই তোয়াহা সাহেব একথা বলেছেন। শেখ মুজিব যদি নেতৃস্থানীয়ই হবেন তাহলে ১৫ তারিখে তোয়াহা সাহেবে গং জনাব নাজিমুদ্দিনের সংগে যে চুক্তিনামা স্বাক্ষর করেন, তা পূর্বেই জেলাখানায় শেখ মুজিব প্রমুখের অনুমোদনের প্রয়োজন হলো কেন? শুধু তাই নয়, শেখ মুজিব তখন পযৃন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পূর্ব পাস্তিান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য হলেও তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বনামধন্য বিপ্লবী ছাত্রনেতা যার উপস্থিতি এবং অবস্থানকে কেউই উপেক্ষা করতে পারেনি। সে জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করে শেখ মুজিবকে ছোট করতে গিয়ে তোয়াহা সাহেব গং নিজেরাই ছোট হয়ে গেছেন। বলাবাহুল্য, ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ছাত্র সংসদের ভি.পি. জি.এস-রা করে নি বরং সংগে মুখ্যভাবে যুক্ত ছিল ছাত্র সংগঠনের ও সরকার বিরোধী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি এবং যা ইতিহাস সত্য।

 

পরবর্তী ঘটনা

ইংরেজীর স্থুলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয় পূর্ববংগ আইন পরিষদে গৃহীত হলে স্বভাবতই আন্দোলনে ভাটা পড়ে।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে।” এই নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সারের ১৫ মার্চের চুক্তি ভুলে গিয়ে গদির লোভে এই উক্তি করলে নতুন করে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা ইত্যাদির কারণে এবং সরকারের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই আন্দোলন প্রসংগে জনাব অলি আহাদ লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সারের ১ জানুয়ারি হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাহাকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাহার সহিত হাসপাতালে কয়েক দফা দেখা করি।

“তিনি ও নিরাপত্তা বন্দী মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ ফেব্র“য়ারি হইতে মুক্তির দাবীতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন।” এ প্রসঙ্গে একুশে সংকলন ঃ স্মৃতিচারণ ঃ ১৯৮১ বইতে জিল্লুর রহমান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন ধরে জেলে আবদ্ধ ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে তার স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে তাই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল করেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একই বিল্ডিং-এ অবস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় ছাত্রনেতাদের গভর রাতে আলাপ আলোচনার জন্য ডাকতেন এবং তাদের সাথে দীর্ঘসময় রাজনৈতিক বিষয় ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে আলোচনা করতেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দী মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধুই আমাদেরকে নির্দেশ দেন। কেন তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবাদ দিবস বলে নির্ধারিত করেছিলেন তার যথেষ্ট কারণ ছিল। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বসার দিন ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। নূরুল আমিন সাহেব তখন চীফ মিনিষ্টার। আজিজ আহমদ নামে একজন অবাঙালি ছিলেন চীফ সেক্রেটারী, ঢাকার ডি.সি. ছিলেন রহমতুল্লাহ নামে আকের অবাঙালি, আইয়ুব খান ছিলেন ইষ্টার্ণ জোনের জি,ও,সি।

বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রথম দিনই পরিষদ ভবন ঘেরাও করার কথা বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি আমরণ অনশন করবেন। এ কথাটা আজ অনেকেই রাজনৈতিক কারণে মানতে চান না। কিন্তু আমি এসব সথ্য ঘটনা বলেই জানি।

বঙ্গবন্ধুর সাথে ছাত্রনেতারা মেডিকেল কলেজে আলাপ-আলোচনা করে একটা আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে এ সংবাদ সরকার জানতে পেরে বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ফেরত পাঠায়। ১৯৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেন্ট্রাল জেল থেকে গোপনে তিনি আমাদের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তাতে তিনি লেখেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারির দিন আমরা যেন নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী কাজ করি। আর তিনি অনশন ধর্মঘটে যাবেন।

বঙ্গবন্ধুর সংগে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে আটক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ একইরূপ ঘটনার সত্যতা উল্লেখ করে বলেছেন যে, প্রকৃত প্রস্তাবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে গৃহীত কর্মসূচি শেখ মুজিব এবং আমাদের সংগে পূর্বেই আলোচনা হয়েছিল। এবং পূর্ব নির্ধারিত ১৬ তারিখে আমি ও শেখ মুজিব অনশন ধর্মঘট শুরু করি।

 

জনাব উমরের গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে

ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালে ১১ই মার্চ সকালে সেক্রেটচারীয়েট গেটে পিকেটিং করে যাঁরা পুীরশ কর্তৃক বন্দী হয়ে জেলে প্রেরিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন একজন। (ঐ, পৃঃ ৬৯-৭০)

ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পরিষদ ১৫ই মার্চে যে চুক্তিপত্র প্রণয়ন করেন তা অনুমোদনের জন্য জেল-এ নিয়ে যেতে হয় এবং অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবের অনুমোদন বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়। (ঐ, পৃঃ ৮১-৮২)

১৫ই মার্চ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ও শওকত আলী ফজলুল হক হল থেকে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে গিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপন করেন। পরদিন খুব সকালে তাঁরা আবার ফজলুল হক হলে ফেরত গিয়ে ছাত্রদেরকে একটি প্রতিবাদ সভার জন্য একত্রিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। (ঐ পৃঃ ৮৮-৮৯)

অতপর ১৬ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অুনষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। সভাশেষে তিনি অ্যাসেম্বররি দিকে মিছিল পরিচালনা করেন। (ঐ. পৃঃ ৯০)

বামপন্থী রাজনীতি গড়ে তুলতে যাঁরা অক্লান্তভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়। ১৯৪৮ সালের ১৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের যে বৈঠক বসে সেখানে শেখ মুজিব উপস্থিত ছিলেন এবং এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর কলকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোস্টেলে অসাম্প্রদায়িক দল গঠনের যে প্রয়াসের কথা জনাব উমর উল্লেখ করেছেন, সেখানে কৌশলে তিনি শেখ মুজিবের নাম বর্জন করেছেন। অথচ শেখ মুজিব ও অপর কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একথা আম জানতে পেরেছি যে, উক্ত আলোচনা সভায় শেখ মুজিব নিজেও উপস্থিত ছিলেন। শুধু তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এমন নয়, রাজশাহীর আতাউর রহমান ও শেখ মুজিবের উদ্যোগেই এই আলোচনা সভার ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছিল। পরে তিনি ঢাকায় এসেও এই আলোচনা ও কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলেন এবঙ ইতিহাস প্রমাণ দেবে যে, এই অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনই শেখ পর্যন্ত জনসমর্থন লাভ করে জয়যুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ এই জাতীয় আন্দোলনের একটি বাস্তব ফসল।

আমরা একথা জানি যে, শেখ মুজিব নিজেও কলকাতা থেকে পাকিস্তানে এসে এমনি একটি রাজনৈতিক ছাত্র দলের সন্ধান করছিলেন। তাছাড়া মুসলিম লীগের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কেও মানসিকতার জন্যই শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সাংঘাতিক মতবিরোধ ঘটেছিল। জনাব উমরের উক্ত গ্রন্থে তার প্রমাণ আছে।

(ঐ, পৃষ্ঠা ৮)

১৯৪৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর বেরা ৩-৩০ মিনিটে ‘বলিয়াদী হাউসে' পার্লামেন্টারী উপদলের বৈঠক বসে। এখানে শেখ মুজিব বামপন্থীদের নেতৃত্ব দান করেন এবং নাজিম মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নের প্রস্তাব করেন। পরের দিনও রাত্রি আটটা পর্যন্ত বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে কয়েকজন ছাত্রনেতা ‘ইত্তেহাদ' পত্রিকাটি বিভিন্ন ছাত্রাবাসে বিতরণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। শেখ মুজিব এঁদের নেতৃত্ব দান করেন। “তখন ইত্তেহাদকে সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা সত্তেও সে সময় লোক মারফৎ বড় বড় প্যাকেটে নিয়মিতভাবে ইত্তেহাদ ঢাকাতে আসতো এবং ছাত্ররা তা মাঝে মাঝে বিতরণ করতেন।”

(ঐ পৃঃ ৯৯)

১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকা সফরকালে নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে আবার দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেনঃ ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।' ভুলে গেলেন তিনি তার চুক্তির কথা। বিশ্বাসঘাতকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখালেন তিনি। খোন্দকার গোলাম মুস্তফা লিখেছেন ঃ “১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ। আর ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারী। মাঝখানে কয়েকটি বিশ্বাসঘাতক বৎসর আর খাজা নাজিমুদ্দিন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-চাত্রীরা ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের সংগ্রামের কথা স্মরণ করল। আর স্মরণ করল ১৫ই মার্চের চুক্তিপত্র লংঘন। পাঁচটি বছর যেন বৃথা চলে গেছে। এতে প্রতিবাদ, এমন দাবি, কোনও ফল নেই? প্রত্যয় দৃঢ়তর হয় ছাত্র সমাজের আবার আন্দোলন। অধিকার হরণকারীর বিরুদ্ধে মরণপণ প্রতিরোধ। এবার সমগ্র পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ ফেটে পড়লো। শুরু হর মহাসংগ্রামের আযোজন।

সর্বদরীয় সংগ্রাম কমিটির ডাকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ছাত্ররা ধর্মঘট ালন করল। তাদের শ্লোগানে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছিল। ছাত্র-জনতার হাতে এক একটি করে প্লাকার্ড শোভা পাচ্ছিল। প্ল্যাকার্ডগুলোতে লেখা ছিলঃ ‘ভাষার উপর হামলা চলবে না.' ‘ফ্যাসিস্ট নূরুল আমীন নিপাত যাও' ‘নাজিম চক্রান্ত ব্যর্থ করুন,' ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবা' ইত্যাদি।

সেদিন বিকেলে সংগ্রাম কমিটির তরফ থেকে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম ও অন্যান্য নেতা তাঁদের জ্বালাময়ী ভাষণে সরকারকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছিল। উক্ত সভায় প্রস্তাব নেয়া হয় (ক) বাংলা ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হবে, (খ) একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা দিবস' হিসেবে পারন করা হবে; (গ) ঐ দিন বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রদেশব্যাপী ডাক দেয়া হবে সর্বাত্মক হরতালের।

সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হওয়ার ১১ই ও ১৩ই ফেব্রুয়ারিকে ‘পতাকা দিবস' বলে ঘোষণা করা হয। সেদিন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কৌটো হাতে নিয়ে পথে পথে বেরিয়ে পড়ে। পথচারীদের বুকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' লেখা কাগজের ব্যাজ এঁটে দেয়। জনতাও খুশীমনে নিজেদের সামর্থানুযায়ী টাকা-পয়সা কৌটোর ভিতরে ফেলে দিয়ে মনে করে আমি বা আমরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক একজন অংশীদার।

সে সময় ভাষা আন্দোলনের প্রচারের বাহন ছিল ‘পাকিস্তান অবজারভার' পত্রিকা। সারা বাংলাদেশে বাঙালীর ঘরে ঘরে ভাষা আন্দোলনের সংবাদ বহন করত উক্ত পত্রিকা। কিন্তু ১৩ই ফেব্রুয়ারি নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার উক্ত পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়। পত্রিকাটি বন্দ হয়ে যাওয়ার ফলে সারা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের সংবাদ পৌঁছে দেবার তীব্র সংকট দেখা দেয়। তবে উল্লেখযোগ্য যে, এর পূর্বেই ‘২১-এর ডাক'- বাঙালীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তা'ছাড়া সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক' তখন এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায়।

১৯৫২-এর ২০শে ফেব্রুয়ারি। তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তখন করাচীতে। পূর্ব বাংলার ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি তাঁর শয়নকক্ষে গালিচার ওপর অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। একটু আগে নূরুল আমীনের সাথে টেলিফোনে আলাপ করছিলেন। পায়চারি করতে করতে আবার তিনি রিসিভার তুলে পূর্ব বাংলার চীফ সেক্রেটারীকে ফোনে ১৪৪ ধারা জারির আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি ঢাকা সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টায় ঢাকা বেতার থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ প্রচার করা হল।

খবরটি প্রচারের পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ সমবেত হলেন একটি জরুরী সভায়। সদস্যদের কেউ কেউ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে প্রস্তাব দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা যাতে ভাঙা না হয় এই সিদ্ধন্তেই অধিকাংশ সদস্য রায় দেন। তবে সাধারণ ছাত্র, যারা ছাত্র সমাজের বৃহত্তর অংশ, সংগ্রাম পরিষদের এই সিদ্ধান্তকে প্রতিক্রিয়াশীল ও সরকারী নীতির পরিপোষক বলে ধিক্কার জানালেন। ১৪৪ দারা ভেঙে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বৃহত্তর ছাত্র সমাজ যে বদ্ধপরিকর একথা পরদিন ভোরেই স্পষ্টতর হয়ে উঠল।

১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল খুবই কম। যে দু'একটি দোকান খোরা হয়েছির তা' ছাত্রদের সনির্বন্ধ অনুরোধে বন্ধ হয়ে গেল। ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাজপথে বেশ কিছু সংখ্যক পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুলিশদের অনেকের কোমরে টিয়ার গ্যাসের বাক্স। কারো হাতে রাঠি, কারো বা বেয়নেট লাগানো রাইফেল।

বেলা দশটা থেকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করেছে। বেলা বারোটায় সভা শুরু হর। বটতলায় দাঁড়িয়ে ছাত্রনেতারা বক্তৃতা দিচ্ছে। প্রতিটি ছাত্রের চোখে-মুখে একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা চিহ্ন পুটে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা কমিটির আহবায়ক আবদুল মতিন দাঁড়িয়ে লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত ভাষায় বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। ছাত্র সমাজকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘মায়ের অপমান সহ্য করা যঅ যনা। মা তাঁর এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ডাক দিয়েছেন। বলুন, আপনারা সে ডাকে সাড়া দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙবেন, না ঘরে ফিরে যাবেন?”

সহস্র সহস্র কণ্ঠে নাগ-নাগিনীরা গর্জে উঠলোঃ ‘১৪৪ ধারা মানব না, মানব না।'

সর্বদলীয় কর্মপরিষদের শামসুল হক ছেলেদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের বললেন, ‘১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ঠিক হবে না।

ছাত্রদের তরফ থেকে বিদ্রুপাত্মক উক্তি ভেসে এল। শামসুল হক বসে পড়লেন। ছাত্রনেতা আবদুস সাত্তার পরামর্শ দিলেন দশ দশ জন করে বেরোলে আইন অমান্য করা হবে না।

এ প্রস্তাব সকলে মেনে নিল। দশ দশজন ছাত্র নিয়ে এক একটি দল তৈরি হল। তারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো    ঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' ‘১৪৪ ধারা মানি না'। ‘নাজিম-নূরুল নিপাত যাক'। ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলী চলো।' প্রথম দলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই জনৈক পুলিশ অফিসার সাবধানী বাণী উচ্চারণ করে বললেন ঃ “আপনারা বেরোবেন না। বেরোলেই গ্রেফতার করবো।”

‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' ধ্বনি দিতে দিতে প্রথম দশজনী দলটি গেটের বাইরে আসামাত্র একঝাঁক পুলিশ হুমড়ি দিয়ে তাদের ওপর এসে পড়ল এবং টেনে হিঁচড়ে তাদেরকে ট্রাকের ওপর তুলে নিল। ট্রাকের ওপর থেকে ওরা আওয়াজ দিলঃ “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”

এবার দ্বিতীয় দশজনী দলটি বের হওয়ামাত্র তাদের গ্রেফতার করা হল। মেয়েদের একটি দলও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' শ্লোগান দিতে দিতে পথে বের হল।

মেয়েদের দলটি পরে শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে আর একদল দশজনী মিছিল করে বেরিয়ে এল। এমন সময় এক পুলিশ অফিসার বিনা দোষে লাথি মেরে একটি ছেলেকে ফেলে দেয়। ছেলেটি উঠে অফিসারটির মুখে থু-থু দিয়ে দেয়। এহেন অবস্থায় একঝাঁক পুলিশ লাঠি হাতে ছেলেটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে ছেলেরা ক্ষেপে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুঁড়তে থাকে ঢিল। পুলিশ বাহিনীর টিয়ার গ্যাসের একটি শেল এসে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে। শুরু হয় ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ।

ছেলেরা একে একে মেডিকেল হোস্টেলে সমবেত হয়েছে। পুলিশ সেখানেও ঢুকতে চেষ্টা করেছে। অবশেষে টিয়ার গ্যাসও ছুঁড়েছে। ছেলেরা বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে চিৎকার করে উঠল ঃ ‘পুলিশী জুলুম চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”

পুলিশ অনবরত টিয়ার গ্যাস ছেড়ে চলেছে। সারা মেডিকেল কলেজ ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। রোগীরা কাশছে আর কম্বর দিয়ে নিজেদের চোখে ঢকে নিয়েছে। ইমারজেন্সীকে কতকগুলো ছেলেমেয়ে গ্যাসের আক্রমণে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কাতর ডাক ভেসে আসছে। মেডিকেল কলেজের দু'জন ছাত্রী ড্রপারে করে লিকুইন প্যারাফিন ঢেলে দিচ্ছে। ছেলেরা আবার ছুটছে গেটের দিকে। এভাবে বেলা দুটো পযৃন্ত ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলল।

তিনটে বাজে। াধিবেশন বসার সময় হয়ে এল। ছাত্ররা এমএলএ-দের নিয়ে একটি জীপ চুটে যাচ্ছে দেখে চিৎকার করে উঠলঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।'

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা গেট থেকে আওয়াজ দিচ্ছেঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।'

ছাত্রদের শ্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা পরিবেশ গম গম করতে লাগল। একজন পুলিশ অফিসার ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনারা দু'জন প্রতিনিধি অ্যাসেম্বলীতে পাঠিয়ে আপনাদের দাবি পেশ করে আসুন।'

ছাত্ররা এই ধোঁকার পড়তে রাজী নয়। তারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' ঠিক এমন সময় একটা টিয়ার গ্যাসের শেল ছাত্রদের সামনে এসে ফাটল। ছাত্ররা চোখে রুমাল দিয়ে বসে পড়ল। পর মুহ‚র্তে ‘গুড়–ম' করে শব্দ হল। একটি বাচ্চা ছেলেকে কয়েকজন ধরাধরি করে ইমারজেন্সী রুমের দিকে নিয়ে চরছে। ছেলেটির শার্ট রক্তে ভিজে গেছে।

আবার গুলীর আওয়াজ পাওয়া গেল। ছাত্রদের মধ্যে হৈ চৈ, দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল। অনেকের হাত-পা কেটে গেছে। সকলে এসে ভীড় করেছে ইমারজেন্সী রুমে। ছেলেটির মাথার খুলি থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। সকলেই এই দৃশ্য দেখে বিচলিত। সকলের চোখ সিক্ত। একটা আক্রোশ তাদেরকে উন্মুক্ত করে তুলেছে।

ছেলেটির নাম জব্বার। সে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সারা দেহ নিথর হয়ে গেল।

আর একটি গুলিবিদ্ধ ছেলেকে কয়েকজন ধরাধরি করে নিয়ে এল। তারও মাথার গুলী লেগেছে। সেখান থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন, তার দেহে আর প্রাণ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। মার কোল শূন্য করে পরপারে যাত্রা করেছে। ভাষা আন্দোলনে এই বীর শহীদের নাম রফিক।

পুলিশ নির্যাতন তখনও সমভাবেই চলেছে। টিয়ার গ্যাস আর গুলীর শব্দে সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভীত ও সন্ত্রস্ত। ছাত্র-ছাত্রীরা ভেজা রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে আর আওয়াজ তুলছেঃ ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই'।

বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ইমারজেন্সীতে আশ্রয় পেয়েছে। মেডিকেল কলেজের ডাক্তার -নার্স আর ছাত্ররা যান্ত্রিকভাবে কাজ করে চলেছে।

ছাত্র হত্যার কথা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। জনতা ১৪৪ ধারার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দলে দলে মেডিকেল কলেজে এসে ভীড় জমাচ্ছে। তখন আর পুলিশ গুলী চালায়নি।

কিছুক্ষণ পর আবার গুলীর শব্দ। মেডিকেল কলেজের সামনে গাছগুলোর ওপর অনেক কাক বসেছিল। গুলীর শব্দ পেয়ে তারাও কা-কা রবে বিপদের আশংকা ঘোষণা করে চলেছে।

হঠাৎ একটা গুলী এসে একটি ছেলের উরুতে লাগে। ছেলেটি মেডিকেল হোস্টেলের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ থুবড়ে সে মাটিতে পড়ে যায়। চাপ চাপ রক্তে ঐ জায়গাটি লালেলাল হয়ে উঠেছে। কয়েকজন ছাত্র ধরাধরি করে তাকে ইমারজেন্সীতে নিয়ে গেল। তখনও অনবরত রক্ত ঝরছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছেলেটি সারা মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে। পাশের ছেলেটিকে ডেকে পিস ফিস করে বললঃ আমাদের বাড়িতে একটু খবর পাঠাবেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন-পল্টন লাইন।” একটু পরে সে পানি খেতে চাইল। মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রী দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়াল।

ছেলেটির নাম বরকত। স্নাতকোত্তর রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র, মুর্শিদাবাদে তার বাড়ি। বাড়িতে রযেছে তাঁর মা। বরকত এই বাংলার মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বরকম, জব্বার, রফিক নিজের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলার ছাত্র-জনতাকে পথ দেখিয়ে গেল।

বরকতের মৃত্যুর খবর শুনে মেহনতী মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ল। ছাত্র-জনতা সাগরের গর্জনের মত গজিয়ে উঠলঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', ‘কসাই মুসলিম লীগ সরকার ধ্বংস হউক।'

ওদিকে পরিষদ কক্ষে অধিবেশন চলছে। পুলিশের গুলীতে ছাত্র হত্যার সংবাদ পরিষদ ভবনেও পৌঁছেছে। মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়Ñএই দু'জনেই উক্ত সংবাদ বহন করে পরিষদ কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিরোধী দলের সদস্যরা এই মর্মান্তিক সংবাদে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁরা নূরুল আমীনের নিকট এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের জবাব দাবি করেন।

নূরুল আমীন প্রথমে এইসংবাদ বিশ্বাস করতেই চাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘ইটস ও ফ্রানটাসটিক স্টোরী।' বিরোধী দলের যুক্তির মুখে তিনি আর বিষয়টাকে চাপা দিতে সমর্থ হলেন না। তিনি বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি না করেই উত্তেজিত হয়ে বললেন ঃ “পুলিশ ঠিকই করেছে। উচ্ছৃংখলতা দমানোর জন্যই তো পুলিশ। এর পেছনে কম্যুনিস্টদের উস্কানি আছে। আমরা তাদের নির্মূল করবই।”

নূরুল আমীনের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তিকে বিরোধী পক্ষ ও সরকার পক্ষের বেশ কয়েকজন সদস্য নিন্দা করলেন। সরকারী পক্ষের মধ্যে ছিলেনÑমওলানা তর্কবাগীশ এবং আবুল কালাম শামসুদ্দিন। পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে মুসলিম লীগের পার্টি থেকে তাঁরা পদত্যাগ করলেন। মওলানা তর্কবাগীশ পরিষদ কক্ষে বললেন ঃ “আমাদের ছাত্ররা যখন শাহাদাত বরণ করছেন, আমরা তখন আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকব, এ বরদাশত করা যায় না। চলুন, মেডিকেল কলেজে চলুন। মেডিকেল কলেজ আজ পাঁচ কোটি জনতার তীর্থস্থান। শহীদের রক্তে পবিত্র হয়েছে সেখানকার মাটি।”

তারপর তাঁরা সদলবলে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েন।

 

মেডিক্যাল কলেজে তখন হাজার হাজার মানুষ। ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানীদের শেষ দেখা দেখবার জন্য সমাবেশ।

মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ভবনে তোলা হয়েছে শহীদের রক্তে ছাপান পতাকা। ছেলেরা মাইকে পুলিশী হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনবরত বলে চলেছে? সমুদ্রের কল্লোলে গর্জনে গর্জে উঠছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', ‘লীগ সরকার নিপাত যাক'!

সেই দিন পুলিশী নির্যাতনের সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হল।

সংগ্রাম পরিষদ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল ২২শে ফেব্রুয়ারি শহীদদের লাশ দাফন করা হবে এবং মেডিকেল কলেজে গায়েবী জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।

কাতারে কাতারে মানুষ চলেছে মেডিকেল কলেজের দিকে। জনতার সীমাহীন কাফেলা চলেছে সেই তীর্থস্থানে যেখানে বরকত, জব্বার ও রফিক মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের রক্ত দিয়েছে।

জানাযার সময় জানা গেল সরকার শহীদদের লাশ দেবেন না। অনেক চেষ্টা করেও লাশ পাওয়া গেল না। লাশ ছাড়াই গায়েবী জানাযা শুরু হল। পরে অবশ্য এদের কবর চিহ্নিত হয়েছে।

ইমাম সাহেব দু'হাত তুলে মোনাজাত করলেন।

‘আল্লাহ, জালিমের গুলীতে কচি কচি ছেলেরা মারা গিয়েছে। ওদের খুনে রাঙা হয়েছে ধূলো আর ঘাস। তুমি তো জান আল্লাহ, ওরা নিরপরাধ। ওরা শুধু বলেছিল বাপ-দাদার মুখের ভাষা ওরা কেড়ে নিতে দেবে না। কিন্তু গুলী করে জালিমরা খালি করে দিল কতো মায়ের বুক। তুমি ওদের ক্ষমা করো না। তোমার রোষের আগুনে জালিমদের নিশ্চিহ্ন করো দুনিয়ার বুক থেকে।'

জানাযার পর এক শোক-মিছিল বের করা হয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল এগিয়ে চরল নবাবপুর রোডের দিকে। দোকানপাট, যানবাহন সব বন্ধ। হঠাৎ এই মিছিলের ওপর চলল অতর্কিত আক্রমণ। পুলিশের লাঠির ঘায়ে অনেকের মাথা ফাটল। পুলিশের লাঠির আঘাতে ফজলুল হক সাহেবও আহত হয়েছিলেন। লাঠিচার্জ করার পরই গুলীর শব্দ শোনা গেল। হাইকোর্টের সামনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল একটা ছেলেÑনাম শফিকুর রহমান। সে ল' ক্লাসের ছাত্র। মিছিলে আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম। বিক্ষুব্ধ জনতা এই সংবাদ পেয়ে রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠল। তখনে বলা তিনটে। পরিষদ কক্ষে অধিবেশন চলছে। জনতা সেখানে গিয়ে অ্যাসেম্বলী ঘিরে ফেলেছে। বিরোধী দল থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেয়া হল। সরকার পক্ষের কিছু সদস্য তা সমর্থন করলেন। এদিকে চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদের সাথে নূরুল আমীনের মতবিরোধ দেখা দেয়ায় প্রস্তাবটি কার্যকরী হতে বিলম্ব হল। অবশেষে লীগ সরকার বাংলাকে প্রদেশের সরকারী ভাষা করতে রাজী হল এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের কাছে সুপারিশ করে প্রস্তাব পাঠান হল।

নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশী নির্যাতন ও হত্যাকে এবং শহীদদের লাশগুলো গায়েব করার উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে ‘দৈনিক মিল্লাত' ২৩শে ফেব্রুয়ারি সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখলঃ “ইসলামী বিধান অনুসারে লাশ খুবই পবিত্র। অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে সে লাশ দাফন করা বিধেয়। কিন্তু গত দুই দিনে পুলিশের গুলীতে শাগাতৎপ্রাপ্ত লাশগুলো তাদের অভিভাবকদের হাতে দেওয়া হয়নি। জানি না, শরিয়ত মোতাবেক শেষকৃত্য হয়েছে কি-না। এ যে কতো বড় মর্মান্তিক, অনৈসলামিক এবং গুণার বিষয় তা বলে বোঝানো যায় না। সরকার ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করছেন, পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র। এই কি ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিচয়?”

বরকত-জব্বার-রপিক-শফিকদের রক্তের ঋণ এই দেশবাসী শোধ করতে পারবে না। শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য শহদি মিনারের পরিকল্পনা নেয়া হয়। মেডিকেল কলেজের সামনের জায়গাটিতে ‘শহীদ মিনার' তৈরি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল। ছাত্ররা নিজেরাই ইট, সিমেন্ট নিয়ে লেগে গেল মিনার তৈরির কাজে। হৃদয় নিংড়ানো ভক্তিও  শ্রদ্ধা দিয়ে গেঁথে দিল শহীদ মিনার। শহীদ শফিকুলের বাবাকে গিয়ে উন্মোচন করান হল এই শহীদ মিনারটি।

একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে ও ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব একটি অত্যন্ত উলে­খযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিল। এ কারণেই ২১শে ফেব্রুয়ারির পূর্বে অনেকবার তিনি কারাবরণ করেন। আবার ২১শে ফেব্র“য়ারীর প্রাক্কালে ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখে তাঁকে গ্রেফতার করা হয। কিন্তু ঢাকা জেল থেকেই তিনি গোপনে তাঁর বন্ধু ও অনুরাগীদের সংগ্রামের নির্দেশ দিতে থাকেন। তিনি জেলে অবস্থানকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সবাইকে মানিক জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টরের সাহায্যে খবর দেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার প্রশ্নে মিছিল করে অ্যাসেম্বলীতে যাবার নির্দেশ দান করেন। তারপর ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে ভাষার প্রশ্নে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দেন ছাত্রকর্মী মহিউদ্দিন। তিনিও তখন শেখ মুজিবের সঙ্গে জেলে ছিলেন। অনশনের ফলে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে, তখন তাঁকে ঢাকা জেল থেকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয। তাঁর অপরিসীম প্রভাব লক্ষ ্যকরে সরকার তাঁকে ডাকা থেকে স্থানান্তরিক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৮ই ফেব্র“য়ারী তাঁকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তিনি চালাকি করে সময় হরণ করার চেষ্টা করেন। ইচ্ছা করেই নারায়ণগঞ্জ স্টীমার ফেল করেন। অনশনরত ছাত্র-নেতাকে ছাত্র-জনাত দেখতে এলে নারায়ণগঞ্জের স্টীমার ঘাটে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম গড়ে তুলবার আহবান জানিয়ে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তখনও অনশন ভাঙ্গেননি। ২১শে ফেব্রুয়ারি তিনি ফরিদপুর জেলে কড়া পাহারায় অবস্থান করেন। তখন তাঁর শরীর সাংঘাতিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অবশেষে তাঁর শারীরিক অবস্থার অস্বাভাবিক অবনতি ঘটলে তাঁকে ২৭শে ফেব্র“য়ারী মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির সময় তাঁকে স্ট্রেচারে করে জেল গেটে নিয়ে এসে ছেড়ে দেয়া হয়। তাঁর আত্মীয় স্বজন তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে প্রায় একমাস চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ঢাকায় ফিরে এসে আবার যুব নেতৃত্ব দান করতে থাকেন।

জনাব বদরুদ্দীন উমর, মোহাম্মদ তোয়াহা বা ফয়েজ আহমদ সাহেব গং ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির অংগনে শেখ মুজিবকে যত ছোট বা নগণ্যরূপে উপস্থাপন করতে প্রয়াসই নেন না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে শেখ মুজিবই ছিলেন আন্দোলনে প্রাণশক্তি এবং কেন্দ্রবিন্দু। সেজন্য সেদিনের ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করলে যে কোন সত্যনিষ্ঠ পাঠক মাত্রই দেখতে পাবেন শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ভাষা আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক তথা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সেজন্য তদানীন্তন স্বৈরাচারী গণবিরোধী মুসলিম লীগ সরকারের কোপানলে শেক মুজিবকে ঐ-সময় অন্তত তিনবার কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করতে হয়। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি হতে সুদীর্ঘ দু'বছরের বেশি কাল ধরে তাঁকে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে কারাগারে আটক রাখা হয়। এসব ঘটনাসমূহ দ্বারা একটি কথাই প্রমাণিত হয় আর তা হলো শেখ মুজিব কোন নগণ্য ব্যক্তি ছিলেন না বা তাঁর রাজনৈতিক উপস্থিতি অবহেলা বা উপেক্ষার বিষয় ছিল না। ভাষা আন্দোলনে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বলতে গেলে তিনিই ছিরেন একমাত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে নিয়ে তদানীন্তন বঙ্গীয় আইন পরিষদে ২০ ফেব্রুয়ারি '৫২ মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল এবং মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের জনাব ‘বিশারদগণ' কোন সময়ই তা উল্লেখ করেনি।

২১শে ফেব্রুয়ারি (৫২) আন্দোলনের পথিকৃত ১১ই মার্চের (৪৮) আন্দোলন ছিল এই ঐতিহাসিক ‘না' ধ্বনির উত্তাল তরঙ্গ। ঢেউ লাগলো সারা প্রদেশে। স্বাধীনতাকামী জনসমষ্টির যেন নবযাত্রা শুরু হল। তরুণ সমাজ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। পুলিশের মুখোমুখি। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।

১১ই মার্চের ধর্মঘট পালনের কর্মসূচী সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আগের দিন অর্থাৎ ১০ই মার্চ ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাপকভাবে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নির্দিষ্ট দিনে ছাত্ররা পিকেটিং শুরু করে। তারা ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করতে থাকলে সরকারের নির্দেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ধর্মঘটের জন্য পিকেটিং-এর সময় যে সব ছাত্রনেতা বন্দী হন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁকে প্রথমে কোতোয়ালী থানায় ও পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

১২ই মার্চে জগন্নাথ কলেজে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ছাত্ররা মিছিল বের করে। পুলিশী জুলুম ও বাংলা বাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ঢাকার সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয।

১১ই মার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ই মার্চে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং তা ১৫ই মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

১৪ই মার্চের ঢাকাসহ প্রদেশের সকল জেলাতেও পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়।

১৫ই মার্চ তারিখের ধর্মঘটে পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেন। সেক্রেটারীয়েটের কর্মচারী, অন্যান্য অফিসের বাঙালী কর্মচারী, এমনকি শেষ পযৃন্ত রেল কর্মচারীরাও তাঁদের কাজ ফেলে রেখে ধর্মঘটে যোগ দেন। পুলিশও পাইকারী হারে গ্রেফতার করতে থাকে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতারের গেটের সামনে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষেপ করে।

১৫ই মার্চ পূর্ব বাংলার অ্যাসেম্বলীর বৈঠক বসার কথা। ঐদিনই মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের বাসভবন-বর্তমান বাংলা একাডেমীতে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক চলাকালীন ধৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে একটি বিরাট মিছিল রাত্রি ন'টা পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভের ফলে সরকার শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজন ছাত্রনেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৬ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। তিনি সর্বসম্মতিক্রমেই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। উক্ত সভায় পূর্বে অনুষ্ঠিত ফজলুল হক হলেন বৈঠকে গৃহীত সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয় এবং গৃহীত প্রস্তাবগুলো নাজিমুদ্দিনের নিকট পৌঁছে দেবার জন্য অলি আহাদের হাতে দেয়া হয়। অতঃপর বক্তৃতা পর্ব শেষ হলে একটি মিছিল অ্যাসেম্বলী ভবনের দিকে যাত্রা করে। 

(চলবে)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top