সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি (পর্ব ৫) : কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
২৭ জুলাই ২০২০ ২২:০৮

আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ০২:০৪

 কাজী জাকির হাসান

 

কানপুর জংসন।

ট্রেন দাঁড়ানোর পর গাইডকে অনুরোধ করলাম প্লাটফর্মে একটু হেঁটে বেরিয়ে আসবো। প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না- পরে কি ভেবে নামলো সংগে নিয়ে। হাঁটলাম ক্র্যাচে ভর করে কিছুক্ষণ। মানুষের হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলির মধ্যদিয়ে চলতে ভালোই লাগছিলো। একটা বুকস্টলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। হিন্দি, ইংরেজি পত্র-পত্রিকায় ঠাঁসা। ওর ভেতরেই বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ' চোখে পড়লো। কিনলাম ছাপানো মূল্যের চেয়েও দু'টাকা কম দিয়ে।

: চা খাবে মোষের দুধ দিয়ে?

চায়ের ভাড়ে চুমুক দিয়ে আরেকটি ভাড় এগিয়ে ধরলো গাইড আমার দিকে। চুমুক দিয়ে ভালোই লাগলো। অনেকক্ষণ জ্বাল করা দুধে চায়ের রংটা ফুটে উঠেছে আরও।

: একটা স্পেশাল খাবার জিনিস আছে এখানে, খাবে?

জিজ্ঞেস করলো গাইড।

: কি জিনিস?

: মাটির পাতিলে বসানো ছাগলের দই। ঐ যে দেখছো ও'গুলো।

খাবার ইচ্ছে হলেও দইওয়ালা যে ভাবে হাত লাগিয়ে তুলে দিচ্ছে সবার পাতে পাতে তাতে রুচি হলো না আর। চায়ের ভাঁড়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললাম, ‘চল যাই'।

জানালার কাছে এসে বসলাম। একজন বৃদ্ধলোক ছয়-সাত বছর বয়সী একটি ছেলেকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের কম্পার্টমেন্টের সামনে। সংগে ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের একজন মহিলা। সদ্য বিধবার বেশ। মলিন মুখখানা সযতেœ ঢেকে রেখেছে ধুতির আঁচল দিয়ে। ধুলোমাখা নগ্ন পা। গাও-গ্রাম থেকে হেঁটে এসেছে বুঝা গেল।

: একটু উঠতে দিন বাবু। জায়গা পাচ্ছিনা কোথাও।

কণ্ঠে আকুতি। উপচে পরা মানুষের ভিড়ে ফাঁকা কম্পার্টমেন্ট দেখেই এসেছেন হয়তো।

: কোথায় যাবেন?

: ত্রিবেনী সঙ্গম। যাচ্ছি বাবা নাতি আর বৌমাকে নিয়ে। তরতাজা ছেলেটা আমার মাস দেরেক হলো মারা গেছে। একটু সরে দাঁড়ান বাবু।

: দেখছো না রিজার্ভেশন লেখা রয়েছে।

দারোজাটা সজোরে বন্ধ করে দিলো গাইড বৃদ্ধের মুখের উপরে।

: সামনের স্টেশনেই নেমে যাবো বাবু।

অনুনয়ের চোখ দু'টো কি যে অসহায় দেখাচ্ছে, গলে যাবে পাষণের হৃদয়ও তাকালে এ চোখের দিকে।

ট্রেন ছেড়ে দিলো। চলন্ত ট্রেনের জানালায় হাত রেখে বৃদ্ধ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আর্তনাদ করে উঠলো, ‘উঠতে দিন বাবু-দয়া করুন একটু'। হোঁচট লেগে পায়ে পড়ে গেল বৃদ্ধ প্লাটফর্মে। কাঁধের ছেলেটি পড়ে গেল ছিটকে দূরে। কেঁপে উঠলো বুকটা আমার। মরে গেল না তো।

দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করতে গিয়ে কত শহর, কত স্টেশন যে পেরিয়ে এসেছি হিসেব রাখতে পারিনি তার ট্রেনের গতির সংগে তাল মিলিয়ে। তবে মনে আছে খড়কপুর, টাকা নগর, ধানবাদ, এলাহাবাদ, নাসিমপুর রোড, জব্বলপুর, ঝাঁসি ও কল্যাণ স্টেশনের কথা।

 

এলাহাবাদ।

স্টেশনের প্লাটফর্ম ঘেঁষে ট্রেন থাকতেই অপেক্ষমান মেডিক্যাল কোরের সদস্যরা দ্রুত দাঁড়ালো এসে আর্মি রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টের সামনে। জানালার ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে বলল, ‘রাম রাম জ্বী।

: রাম রাম।

দু'তরফের কুশল বিনিময় শেষে নামিয়ে আনলো মুক্তিযোদ্ধাদের। একজন গাইডসহ মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ বন্ধু চলে গেল তাদের সংগে। জানালার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে দেখা যায় যতদূর তাকিয়ে থাকলাম।

ঐতিহ্যবাহী শহর এলাহাবাদ। ইতিহাস খ্যাত নানা কারণে। ইঞ্জিন পরিবর্তনের কারণে কিছুটা সময় পাওয়া যায় এখানে। যাত্রিরা অনেকেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিচ্ছেন স্টেশনে নেমে। হাঁটাহাঁটি করছেন অনেকে এক ঘেঁয়েমির আলস্য কাটিয়ে উঠতে। মনে পড়ে গেল হঠাৎ কানপুর স্টেশনের সেই ঘটনার কথা। কি যে ব্যাকুল আকুতি বৃদ্ধের পূণ্যাস্নোনের আকাঙ্খায়। সেই ত্রিবেনী সঙ্গম-এই এলাহাবাদে। একটু উঁচু দৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যায় যমুনা নদী। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিনের মিলনস্থলই ত্রিবেনী সঙ্গম। রং দেখে সহজে ভিন্ন করা যায় তিন নদীর পানি। বিশ্বাস হিন্দু তীর্থ যাত্রিদের জীবনের সব পাপ-শাপ স্খলন হয়ে যায় এই স্থানে স্নান করলে।

 

কল্যাণ জংসন স্টেশন।

নাস্তার অর্ডার বুফেকারে দেয়া থাকলেও স্টেশনে নেমে রেলওয়ে ক্যান্টিনে খাবার ইচ্ছে হলো খুব। মাখন টোস্ট, ডিমের অমলেট আর কফি অর্ডার দিয়ে  বসলাম চারজন কোনায় এক টেবিলে গিয়ে। চাঁদের মত ফুটফুটে একটি মেয়ে, আড়াই-তিন বৎসর বয়স হবে, এ টেবিল ও টেবিল ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছিলো আপন স্বভাবে। আমাদের পাশের টেবিলে দু'জনের পরিবার একটি নাস্তা করছিলেন। হঠাৎ ধমক দিয়ে ভদ্রলোক হাত ধরে টেনে এনে কাছে বসালেন মেয়েটিকে। ধমক খেয়ে ফুঁফিয়ে উঠলো মেয়েটি। কোলে তুলে নিলেন ভদ্রমহিলা। আদর করে বলতে লাগলেন ছেলে ভুলানো সব কথা। পরিচয় পেয়ে চেয়ারটা সরিয়ে নিলাম আরেকটু কাছে, জিজ্ঞেস করলাম ভদ্রলোককে, ‘আপনারা বাঙালি'?

: আমরা মুসলমান।

নাস্তা খেতে খেতেই উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।

(প্রসঙ্গত, পরিচয়ের এই উদ্ভট ব্যাপারটা এর আগেও একবার আমি বুঝতে পারি-নি। ব্যারাকপুর হাসপাতালে বর্ধমানের এক হিন্দু বন্ধু কথায় কথায় এরকমই বলেছিলো, ‘আমাদের বাঙালি পাড়ায় মুসলমানও অনেক বাস করেন।') কুঁচকানো ভ্রু’র দিকে তাকিয়ে সাহস পেলাম না আর কিছু জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু লক্ষ করলাম উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ভদ্র মহিলা তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে, বললেন, ‘আপনার বাড়ি?'

: বাংলাদেশে।

এবার ভদ্রমহিলাই চেয়ার টেনে বসলেন আমার কাছে এসে।

: বাংলাদেশের কোথায়?

: রংপুর।

: আমার বড় দু'বোনের বিয়ে হয়েছে চাঁপাই নবাবগঞ্জে।

মালদহে বাড়ি এঁদের। শিক্ষকতা করেন ভদ্রমহিলা নিজ শহরের একটি জুনিয়র হাইস্কুলে। বছর চারেকের সংসার। স্বামী নাসিক' এ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অপারেটর। মাস খানেকের ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছেন সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের খবরা খবরই তারা জানেন। মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে সামনা সামনি দেখতে পাবেন স্বপ্নেও ভাবেন নি। নাসিকের ঠিকানা লিখে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে, বললেন, ‘সময় করে যদি একবার বেড়াতে আসেন খুশি হবো খুউব।'

টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। মেয়েটির হাত ধরে নেকড়ের দৃষ্টিতে তাকালেন ভদ্রমহিলার দিকে, বললেন, ‘ট্রেন ছাড়বে এক্ষুণি।'

নির্ধারিত সময়ের পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে ভি টি স্টেশনে এসে পৌছালো ট্রেন। পুনা যেতে চেঞ্জ ট্রেন ধরতে হবে বোম্বের এই স্টেশন থেকে।

মাইলের পর মাইল পাথর কেটে তৈরি হয়েছে রেলপথ। কখনো দু'পাহাড়ের মধ্য দিয়ে, কখনো পাহাড় ঘেঁষে চলছে ট্রেন। কৃষি কাজ করছে পাহাড়ে মারাঠী মহিলারা। তাদের কাপড় পরার ধরণ হিন্দু পুরুষেরা ধুতি পরে যেভাবে।

পার হচ্ছে ট্রেন পাহাড়ের ভেতরে পাথর কেটে তৈরি শত শত ফিট লম্বা টানলের ভেতর দিয়ে। অন্ধকারাচ্ছন্ন। বন্ধ হয়ে আসে নিঃশ্বাস। পাথরের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা পানি অবিরাম। নিকষ ঐ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি মানুষ জ্বলন্ত মশাল হাতে রেল লাইনের দু'ধারে। দেখলে মনে হয় যেন পাথরের মূর্তি একেকটা। আছে দাঁড়িয়ে অনাদিকাল ধরে।

বিচিত্র এই অনুভ‚তি সারা পথ মোহবিষ্ট করে রাখে আমাকে।

শিবাজী নগর।

মারাঠী বীর রাজা ছত্রপতি শিবাজীর জন্মস্থান। এই স্টেশনেই নামলাম আমরা। আমাদের নিতে এ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়ে ছিলো প্লাটফর্ম থেকে কিছুটা দূরে। ব্রাদার দু'জন এগিয়ে এলো নিকটে।

: রাম রাম জ্বী।

: রাম রাম।

এই ক'মাসে সম্বোধনটা রপ্ত হয়ে গেছে আমারও। প্রতি উত্তরে তাই বোধ করি খুশিই হলো ওরা। যদিও ক্র্যাচে স্বচ্ছন্দ হাঁটতে পারি আমি-মানলো না তা ব্রাদাররা, নিয়ম মাফিক এস্ট্রেচারে করেই তুললো এ্যাম্বুলেন্সে।

ষ্টার্ট নিলো। ছুটে চললো এ্যাম্বুলেন্স পাহাড়ি পথ ধরে কিরকী সামরিক হাসপাতালের দিকে।

চার নম্বর সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি হলাম। আনুষাঙ্গিক সারতে ঘণ্টা খানেক সময় লাগলো। এরই মধ্যে ডাক্তার এসে হাজির। সরাসরি আমার কাছে। বিছানার ওপর চিকিৎসা ফাইল তুলে নিয়ে দেখলেন নাড়াচাড়া করে। জিজ্ঞেস করলেন তারপর, ‘ব্যাথাটা কোথায়'?

আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘এখন এখানে।'

: এখন মানে?

কিছুটা অবাক হয়ে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন আমার দিকে তাকিয়ে।

: ব্যাথাটা নির্দিষ্ট করে থাকে না এক জায়গায়। ব্যথা হয় স্প্রিং এর মুভমেন্টের উপর।

: স্প্রিংই যে আছে এ কথা তোমার মনে হলো কি করে?

: গুনার তারের মত খোঁচা লাগে যে।

: এক্সরের জন্য একটা এ্যাডভাইস লিখে দাও।

ক্যাপ্টেন ব্যানার্জিকে নির্দেশ দিলেন।

রাশভারী হলেও কর্ণেল মজিদ বেশ মিষ্টভাষী। কথা বলেন ধীরে ধীরে, নিচু স্বরে। তাঁর সঙ্গে আসা মেজর চ্যাটার্জী ও ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর সঙ্গে কি যেন শলাপরামর্শ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে তাকালেন আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন অনেক কিছুই। এই কথপোকথন ছিলো একেবারেই চিকিৎসার বাইরে। ব্যক্তিগত। কর্ণেল মজিদের পৈত্রিক বাড়ি পাবনায়। মেজর চ্যাটার্জী কলকাতার মানুষ। পুরুলিয়া ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর বাড়ি হলেও পরিবারের সবাই থাকেন জয়পুরে বাবার চাকুরিস্থলে।

অবাক দৃষ্টিতে অনেকে তাকিয়েছিলেন শুধু-যতক্ষণ কথা বলেছেন কর্ণেল মজিদ আমার সঙ্গে।

রাউন্ড শেষ করে ডাক্তার চলে যাবার পর সিষ্টার ক্যাপ্টেন হেলেন ডি সোজা এগিয়ে এলেন আমার কাছে।

চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এঁদের চেন নাকি আগে থেকে?'

: এইতো দেখলাম প্রথম।

আমি বললাম।

: কথা শুনে বুঝবার উপায় নেই তো।

হাসলেন।

: আফটার অল বাঙালি তো।

বিছানা থেকে ফাইলটা তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে ঢুকে গেলেন ডিউটি রুমে।

চার নম্বর সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে সিট সংখ্যা কুড়িটি। এর মধ্যে পাচটি বেডে স্থায়ী ভাবে রয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত পাঁচজন সৈনিক। প্যারালাইজড সম্পূর্ণ। এঁদের সঙ্গে মিশে, কথা বলে বিস্মিত হয়েছি। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা দেখিনি কখনো। বরং উল্টো এঁরাই সাহস যুগিয়েছেন আমাদের মনে। বাকি পনের সিটের তিনটিতে আহত ভারতীয় সৈন্য। দু'টো খালি। দশটিতে মুক্তিযোদ্ধা আমরা। সাতজনের পা নেই। হাত নেই দু'জনের। দু'পাটি দাঁতে আঘাত একজনের। তার দিয়ে রয়েছে আটকানো। লিকুইড খাবার খেতে হয় পাইপ দিয়ে। তিন-চারদিন আগে পিছে এরা এসেছে সকলে। লক্ষ্‌নৌ, শিলচর, ধুবড়ী, গৌহাটি ও আগরতলা হাসপাতাল থেকে।

বিকেল হলেই লনে, খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াতাম। হাসপাতালের গোটা এরিয়া কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। একটিমাত্র গেইট ভেতর-বাইর আসা-যাওয়া করার জন্য। আর পি চেকপোস্টের বাঁ' পার্শ্বে টেকনিক্যাল স্কুল। পঙ্গুত্ব বরণকারী সৈন্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রয়েছে এখানে যার যার পছন্দের সব বিষয়। ট্রেনার সবাই সামরিক বাহিনীর। টেকনিক্যাল স্কুল থেকে একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিলে দেখা যাবে ছাতহীন থিয়েটার হল। মঞ্চের আদলে তৈরি উঁচু প্লাটফর্ম একটি। সপ্তাহে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্ক্রীন টেনে সিনেমা দেখানো হয় সেখানে। হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই ডাক্তার, নার্সদের ফ্যামিলি কোয়ার্টার এবং ব্যাচেলর মহিলা নার্সদের হোস্টেল। ভেতরের রাস্তাগুলোর দু'পার্শ্বে সাজানো ফুল গাছ দিয়ে। তাকালে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। টিনের ছাউনি একতলা ওয়ার্ডগুলো জড়িয়ে আছে গাছের লতায় পাতায় এমোন ভাবে যে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে পাহাড়ি টিলা যেন একেকটা। ঔষধের চিকিৎসাই শুধু নয়- মন ও মননের সুস্থতার জন্য অদ্ভূত মুগ্ধ করার মত আরো অনেক কিছুই রয়েছে এখানে।

দিন পনের পর আহত মেজর আবু তাহের ও ক্যাপ্টেন খান গোলাপ ভর্তি হলেন পাশের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের অফিসার্স কেবিনে। ঠাণ্ডা প্রকৃতির খান গোলাপ চলনে বলনে ছিলেন শান্ত খুব। কিন্তু মেজর তাহের ছিলেন ঝড়ের মত উদ্যম, স্পষ্টভাষী এবং কিছুটা অস্থির প্রকৃতির। নিয়মের মানুষ হয়েও কতক ক্ষেত্রে নিয়ম মানতে চাইতেন না। এজন্য অনেকবার প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে।

বিকেল হলেই ক্যাপ্টেন গোলাপ হুইল চেয়ারে চলে আসতেন আমাদের ওয়ার্ডে। একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিতাম নতুন কোন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা আহত কোন সৈনিক এলো কিনা অন্য কোন ওয়ার্ডে।

 

৮ নভেম্বর ১৯৭১

সকালের নাস্তা শেষ হওয়ার মাত্র হুলস্থূল পড়ে গেল গোটা হাসপাতাল জুড়ে। প্রচণ্ড ব্যস্তায় ছুটাছুটি করছে সবাই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। মাত্র দিন দুই আগে পাল্টানো বিছানার চাদর, বালিশের কভার, গায়ের ইউনিফর্ম খুলে ফেলে পড়তে দেয়া হলো নতুন কাপড়। বিগ্রেডিয়ার যোশী ঘুরে ঘুরে পরখ করে দেখছেন সব। চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত। রোগীরা সব যার যার বিছানায়। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া উঠা নিষেধ একেবারেই। কেউ যে একজন আসছেন অবস্থা দেখে তা অনুমান করা যায়। কিন্তু কে আসছেন? সে কথা কেউ বলছেন না মুখ ফুটে।

সকাল সাড়ে দশটা।

এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। সঙ্গে মহারাষ্ট্রের গভর্নর (হায়দরাবাদ নিজামের বংশধর, নামটা মনে পড়ছে না এখন), মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। জনাকীর্ণ সাংবাদিক পরিবেষ্ঠিত শ্রীমতি গান্ধী প্রত্যেক সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে বলে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি বসেছিলাম ডিউটি রুমের স্পেসে ইজিচেয়ারে কয়েকজন ভারতীয় সেনা অফিসারের সঙ্গে। হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী হ্যান্ডশেক করার জন্য। অভিভূত আমি তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে।

ছোট খাটো মানুষ।

পরনে জলপাই রং এর শাড়ি।

পার মাথার পেছনে পর্যন্ত উঠানো।

বাঁ হাতের মুষ্টিতে ধরা শাড়ির আঁচল।

তেজদীপ্ত চেহারা।

চোখ দু'টো সদ্য ভুমিষ্ট শিশুর মত দেখতে।

কোমল হাতখানা ধরে রেখেছিলাম কতক্ষণ খেয়াল নেই। আলতো ভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে হাত, মাথাটা একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেশে কে কে আছেন তোমার?

এখন কে কে আছেন জানি না।

: কোন খোঁজ পাওনি তাদের? বাবা কি করেন? তুমি কি করতে যুদ্ধে আসার আগে? এখন কি করবে স্বাধীন দেশে ফিরে গিয়ে?

এমনি অনেক কথা। কতক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি চোখে পানি এসে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ মৌন ভাবে। পানি টল টল করছে দু'চোখে। শান্ত এবং স্থীর কণ্ঠে বললেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ, একজন মা হিসেবে বলছি, এ মুহুর্তে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি আমি। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছে- কিন্তু তারা যে এত অল্প বয়সের ভাবতে পারিনি।'

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার এই কথপোকথন এক নাগারে সাত দিন প্রচার করা হয়েছিলো পুনা রেডিও থেকে। উপহার হিসেবে একটি করে ফ্লাক্স প্রধানমন্ত্রী তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধদের হাতে।

মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল তুলে দিলেন দু'ব্যান্ডের বুশ রেডিও সেট একটি করে।

 

 

ভারতের শিবরাজ পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার পর আহত সৈন্যে ভরে যেতে লাগলো ওয়ার্ড। পরিস্থিতি তখন এমনই যে, ডাক্তার, নার্সের পাশাপাশি আমরাও নার্সিং এর কাজে লেগে পড়লাম।

বিপদ কাছে টানে মানুষকে। সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এমনই এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো কিরকী হাসপাতালে যে, কে মারাঠী, কে রাজপুত, কে গোর্খা, জাট, অহমিয়া? কে আত্মীয়, কে অনাত্মীয়? কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে শিখ, কে চন্ডাল পার্থক্য ছিলো না কোন। অবলম্বন একে অন্যের। মহামিলনের অভূতপূর্ব এই দৃশ্য ভুলবার নয় কখনো।

পুনা লীম সেন্টারে আর্টিফিশিয়াল পায়ের মাপ দিয়ে আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে যেতে হতো ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করার জন্য। কিরকী হাসপাতাল থেকে পায় দশ কিলোমিটার দূরত্বের পুনা লীম সেন্টারে যাতায়াত করতাম আমরা সামরিক এ্যাম্বুলেন্সে। এই সময় সি পি আই, সি পি আই (এম), আর এসপি'র ছদ্মাবরণে, নকশাল আন্দোলন আহত কিছু কর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। থাকতো তারা লীম সেন্টারের সিভিল ওয়ার্ডে। এক ঘণ্টা লাঞ্চ বিরতির সময়টাকে বেছে নিয়েছিলাম কথা বলার জন্য। বেশীর ভাগ কলকাতার বাঙালি। জনা পাঁচেক শিলিগুড়ির। বয়স ষোল থেকে সাতাশের মধ্যে। বোকা সোকা কোমল মুখশ্রীর আড়ালে রয়েছে এদের দুর্ধর্ষ ও কঠোর অনমনীয় মনোভাব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধিতাকারীদের মধ্যে এরা ছিলো অন্যতম। আমি যাই বলিনা কেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা কথাই তারা বুঝানোর চেষ্টা করতো আমাকে, বলতো, ‘ইউ হ্যাব বিন পলিটিক্যালি চিটেড।' ধার করা বুলেটে আর যাই হোক স্বাধীনতা যুদ্ধ করা যায় না। ধারের অর্থই সুদের ফাঁদে পা দেয়া।'

রাজনৈতিক কোন দর্শন ছিলো না আমার। তাই বুঝতাম না এদের কথার অর্থ। তবে বুঝে গিয়েছিলাম একটা বিষয় ভাল করে, এরা পছন্দ করছে না আমাদের। মানতে পারছে না আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে।

 

(চলবে)


মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ১
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ২
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৩
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৪
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৫
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : শেষ পর্ব

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top