যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী রাজনীতি চর্চায় বঙ্গবন্ধু ও সিলেটি সমাজ : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
প্রকাশিত:
১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:১৩
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৭
বাঙালি জনসমাজে যে ক’জন অমর রাজনীতিকের আবির্ভাব ঘটেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সেরা। তাঁর সংগ্রামী জীবনে ইউরোপে রাজনৈতিক কর্মপ্রয়াশের বিষয়টি তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ ও পাকিস্তানের উভয় অংশে সৃষ্ট পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য দূরীকরণের সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য তিনি দেশের বাইরে একটি রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেছিলেন। তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটিশ প্রভাব এবং ইউরোপে লক্ষাধিক বাঙালির অভিবাসন ছিল বিধায় বঙ্গবন্ধু সে অঞ্চলকেই এর জন্য উপযুক্ত মনে করেন। ইউরোপ প্রবাসী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুকে নিরাশ করেননি। সে সময়ে লন্ডনে থেকে বাঙালি নেতাদের রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্ম পরিচালনা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তরে প্রবাসীদের সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যই মানুষের অজানা। নিম্নে এ বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করা হলো।
কোনো দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র সে দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষ নিজ নিজ দেশে তাদের রাজনীতি চর্চা করে থাকেন। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী ও অস্থায়ীভাবে জীবনযাপন করে সদর্পে দেশের রাজনীতি চর্চা করে আসছেন। পরবাসে বাংলাদেশের এই অভ্যন্তরীন রাজনীতি চর্চার সূচনা হয় পাকিস্তান আমলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পথিকৃত। তিনি ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাধ্যমে এ দেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু অকল্পনীয় ভাবে গণপ্রত্যাশা পদদলিত করে পশ্চিমা শাসকচক্র পূর্ববঙ্গে নতূন অবয়বে আর একটি উপনিবেশ কায়েম করে। একের পর এক সেনা-শাসনের অক্টোপাশে আবদ্ধ হয় দেশ, ভুলুণ্ঠিত হয় মানুষের আকাক্সক্ষা। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ জাতীয় নেতৃবৃন্দ সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এ সংগ্রামে যুক্ত হন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্ম-নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতার চরম উৎকর্ষ ঘটিয়ে ছাত্রাবস্থায়ই নিজেকে জাতীয় নেতার কাতারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওার্দীর বিশ্বস্থ সহচর ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি ধীরে ধীরে স্বদেশী রাজনীতি চর্চা ও নির্ভরযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হন।
স্বাধীনতার এই পথপরিক্রমার শুরুতেই আন্তর্জাতিক পরিসরে জনমত সৃষ্টির জন্য বহির্বিশ্বে একটি স্বদেশী কর্মীবাহিনীর আবশ্যকতা বোধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে তাগিদ থেকেই তিনি প্রবাসে বাঙালি জাতীয় রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রয়াসী হন। এ জন্য তিনি যুক্তরাজ্যকেই সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। কারণ তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতি চর্চায় ইউরোপের যেমন ছিল বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী প্রভাব বলয় তেমনি তৎকালীন সময়ে লক্ষাধিক পূর্ববঙ্গবাসীর অভিবাসন ছিল ইউরোপে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অসম্মতিতেই বঙ্গবন্ধু লন্ডনে সে সময়ে যে স্বদেশী রাজনীতি চর্চা ও আওয়ামী লীগের শাখা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা-ই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বলাবাহুল্য, ইউরোপ-প্রবাসী সে জনবলের প্রায় পুরোটাই ছিল সিলেটি জনগোষ্ঠী।
যুক্তরাজ্য-প্রবাসী সিলেটি জনগোষ্ঠী
সুদূর অতীত থেকে মানুষ ভাগ্যান্বেষণ, রাজনৈতিক বাস্তবতা ইত্যাদি নানাবিদ কারণে দেশ হতে দেশান্তরে পাড়ি জমিয়েছে। তবে ব্রিটিশপূর্ব কালে এ অঞ্চলের মানুষ কৃষি ও মৎস্যনির্ভর কর্মপেশা ত্যাগ করে নিজের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার উল্লেখযোগ্য নজীর নেই। ইংরেজরা নদী ও সমুদ্রগামী জাহাজে করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতো। সেসব জাহাজে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়তো। তখন জাহাজের শ্রমিক হিসেবে পূর্ববঙ্গের সিলেট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের লোকজন জীবিকা নির্বাহের পথ খোঁজে। এই জাহাজি শ্রমিকদের শতকরা পঁচাত্তর জনই ছিলেন সিলেটের অধিবাসী।
এসব শ্রমিক ইংরেজদের প্রধান সমুদ্রবন্দর কলকাতায় গিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাগামী জাহাজের শ্রমিক হিসেবে তারা যোগদান করেন। জাহাজের কাজ ছিল মাত্রাতিরিক্ত কষ্টকর। তাই কেউ কেউ এ কাজ পরিত্যাগ করে গোপনে কোনো কোনো দেশে নেমে পড়তেন। এভাবে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাহাজি শ্রমিকেরা প্রবাস জীবন শুরু করেন। এ ধারায় চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর শ্রমিকেরা বার্মা, সিঙ্গাপুর ও শেষে দোবাইকে পছন্দ করেন। অপরদিকে সিলেটের শ্রমিকেরা প্রধানত ব্রিটিশ শহর-বন্দর ও স্বল্প সংখ্যক মার্কিন শহর-বন্দরকে পছন্দ করে সেখানে ভাগ্যান্বেষণ করেন।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনাবসানের পর ভারত-পাকিস্তানে পাসপোর্ট প্রথা শুরু হলে পূর্ববঙ্গের জাহাজিরা কলকাতা বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। তখনও কমনওয়েলথ-এর নাগরিক হিসেবে তাদের ইউরোপে যেতে ভিসার প্রয়োজন পড়তো না। সে সুযোগে বহু শ্রমিক ইউরোপ গিয়ে জাহাজের পেশা ত্যাগ করে অন্যান্য পেশায় প্রবেশ শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। এসব বাঙালিদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকায় বসবাস শুরু করলে সেখানকার মাত্র চার বর্গমাইল এলাকায় পঞ্চাশ/ষাট হাজার বাঙালির আবাস গড়ে ওঠে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ববঙ্গবাসীদের পাসপোর্ট দিতে গিয়ে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের অবাঙালি কর্মকর্তারা বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করে। তাদের নানা রকম দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালিরা পাকিস্তান হাইকমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এ নিয়ে একদিন হাইকমিশনের লেবার অ্যাটাসের অফিসে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এসকল সমস্যা এবং প্রবাস জীবনের অন্যবিধ সুবিধা-অসুবিধায় পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে জন্ম নেয় ‘পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’। উক্ত সংগঠনের প্রায় সকলেই ছিলেন সিলেটি। এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন মৌলভীবাজারের আথানগিরী এলাকার দেওয়ান মনফর আলী এবং সেক্রেটারি হন ছাতকের আশীদ আলী মাস্টার। এ কমিটির নেতৃত্বের বিষয়ে অনেকের আপত্তি থাকায় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে কমিটি গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হন নবীগঞ্জের আব্দুল মন্নান এবং জেনারেল সেক্রেটারি হন গোলাপগঞ্জের নেছার আলী।
লন্ডনের সবচাইতে জনপ্রিয় সমাজকর্মী ও প্রবাসী নেতা ছিলেন আব্দুল মন্নান (ছানু মিয়া)। যাকে একডাকে বিলাত প্রবাসী সকল বাঙালিরা চিনতেন। তিনি নিজের ব্যবসার পাশাপাশি প্রবাসীদের সুখ-দুঃখে স্বপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে যেতেন। বাঙালিদের সংগঠিত করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্ঠা করেন। নিজের রেস্টুরেন্টকে কেবল প্রবাসীদের জন্য নয়Ñ স্বদেশ থেকে লন্ডন গমনকারী ছোট বড় নেতা থেকে সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত করেন। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের যত রাজনীতিক লন্ডন গেছেন তাদের সকলের কাছে তিনি ছিলেন সুপরিচিত প্রবাসী নেতা। ‘পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা, ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন বা বাঙালিদের যেকোনো সভা-সমিতির একমাত্র স্থান ছিল আব্দুল মন্নানের মালিকানাধীন আর্লসকোর্ট এলাকায় অবস্থিত গ্রীনমাস্ক রেস্টুরেন্ট। তিনি সেখানে সভা-সমাবেশে যোগদানকারী বাঙালিদের আপ্যায়নসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অতিথিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও নিজ উদ্যোগেই করতেন।
এই প্রবাসী নেতা আব্দুল মন্নান ছিলেন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্টজন। সেকালে বঙ্গবন্ধু যতবার লন্ডন গেছেন ততবারই আব্দুল মন্নানের লন্ডনস্থ বাসভবন ২৯নং সেন্ট ম্যারি এ্যাবোট্স ট্যারেসে তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। শুধু তিনি কেন, তৎকালীন সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খানসহ লন্ডন সফরকারী পূর্ব পাকিস্তানের এমন কোনো নেতা ছিলেন না যিনি দু’এক বেলা এ্যাবোট্স ট্যারেস বা গ্রীনমাস্ক রেস্টুরেন্টে মন্নান সাহেবের আতিথেয়তা গ্রহণ করেননি।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেবার পর মওলানা ভাসানী বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতি জুলিও কুরীর আমন্ত্রণে বিশ্বশান্তি পরিষদের বৈঠকে যোগদানের জন্য অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ, জমির উদ্দিন ও খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে সাথে নিয়ে ইউরোপ যান। ইউরোপ যাবার পর গভর্নর ইস্কান্দর মির্জা মওলানা ভাসানীকে দেশে ফেরা মাত্র গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। এ কারণে তিনি দীর্ঘ আট মাস দেশে ফিরতে পারেননি। এই আট মাস তাঁরা ছিলেন প্রবাসী নেতা আব্দুল মন্নানের লন্ডনস্থ বাসভবন এ্যাবোট্স ট্যারেসে।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে একাধারে তিনমাস লন্ডনে অবস্থান করেন। সে সময় আব্দুল মন্নান তাঁর নিজ খরচে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে লন্ডনের অভিজাত ও বিলাসবহুল হোটেল কেনসিংটন প্যালেস-এ থাকার ব্যবস্থা করেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও লন্ডন গিয়ে মন্নান সাহেবের সেন্ট ম্যারি এ্যাবোট্স ট্যারেসে ওঠেন। লন্ডনে এই উদীয়মান নেতার উপস্থিতি ও তাঁর যৌক্তিক বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানকার প্রবাসী বাঙালি সমাজ দেশের রাজনীতি চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাঁর প্রেরণায় সেখানকার বাঙালি সমাজ স্বদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় সরগরম হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে এক সভায় আব্দুল মন্নানের নেতৃত্বে প্রবাসীরা তাদের অভাব-অভিযোগ বিশেষত পাসপোর্ট সমস্যার বিষয়টি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে তোলে ধরলে তিনি ওয়াদা করেন ক্ষমতায় গেলে এ সমস্যার সমাধান করবেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একমাসের মধ্যে সে ওয়াদা পূরণ করেন। যার প্রেক্ষিতে ওই বছরের শেষ দিকে হাজার হাজার বাঙালি বিনা বাধায় পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিলাতে পাড়ি জমান। একই সাথে বিলাতে অবস্থানকারী হাজার হাজার পাসপোর্টহীন পুরনো জাহাজি শ্রমিক বিনা জামানতে পাসপোর্ট গ্রহণ করে বৈধতা পান।
এভাবে ইউরোপে যে লক্ষ লক্ষ সিলেটির অভিবাসন ঘটে তারা পর্যায়ক্রমে কল-কারখানা, অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট প্রভৃতিতে শ্রম দিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এই অভিবাসীরা কেবল সেখানকার অর্থনীতিকেই না, এ দেশের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রেও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন। চাকরী ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত লন্ডনে বসবাসরত তখনকার প্রায় পাঁচ লক্ষ বাংলাদেশীর শতকরা ৯৮% ভাগ মানুষই ছিলেন সিলেটের অধিবাসী।
সিলেটি রেস্টুরেন্টসমূহের অভ্যন্তরে প্রচারিত বাংলাদেশের দেশাত্ববোধক, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি ও মারেফতি গান এ দেশের সংস্কৃতিকে পরিচিত করে তুলছে ইউরোপীয় পরিমণ্ডলে। সিলেটিদের জনবল ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কারণে পূর্ব লন্ডনের ওল্ডগেইট এলাকা আজ ইংরেজদের কাছেও ‘লিটল সিলেট’ নামে পরিচিত। লন্ডন মহানগরীর টাওয়ার হ্যামলেটস বোরা কাউন্সিল অত্র এলাকার ব্রিকলেন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জনপদকে ‘বাংলা টাউন’ নামকরণ করেছে। যা প্রবাসী সিলেটিদের দীর্ঘদিনের গৌরবজনক ভূমিকার ফসল।
দীর্ঘ কয়েক বছর নিষ্ক্রিয় রাখার পর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুব খান রাজনৈতিক পার্টিসমূহকে পুনরুজ্জীবিত করার অনুমতি দেয়ার সময়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব চিকিৎসার জন্য লন্ডন অবস্থান করছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করাসহ রাজনৈতিক নানা বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্য লন্ডন গমন করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন মন্নান সাহেবের অতিথি হিসেবে কেনসিংটন প্যালেস হোটেলে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু ওঠেন এ্যাবোটস ট্যারেসে। দুজন নেতা প্রায়শ মন্নান সাহেবের বাসভবন কিংবা গ্রীনমাস্কে একান্তে বসে রাজনৈতিক নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। এসব আলোচনাকালে একমাত্র তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন আব্দুল মন্নান।
আব্দুল মন্নানের গ্রীনমাস্ক রেস্টুরেন্টে একদিনের আলোচনায় বঙ্গবন্ধু যখন কিছুতেই পূর্ব পাকিস্তানের পৃথকীকরণের বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে রাজী করাতে পারছিলেন না তখন এক সময় শেখ সাহেব বেশ জোরেই বলে উঠলেন:
স্যার, আপনি হউন, আর মওলানা সাহেবই হউন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী, আপনারা কোনো অবস্থায়ই ইস্ট পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারবেন না। কারণ ওয়েস্ট পাকিস্তান ইস্ট পাকিস্তানকে গিলতে বসেছে। ইস্ট পাকিস্তানকে একদিন না একদিন আলাদা হতে হবে। এমনি গর্জে উঠলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব ‘Don’t talk nonsense’ অর্থাৎ, বাজে কথা বলোনা। আর অগ্নিশর্মা চোখে চেয়ে রইলেন শেখ সাহেবের দিকে। শেখ সাহেব চুপ করে গেলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘তোমোদের কি আছে যে আলাদা হয়ে যাবে। পারবে ওদের সাথে যুদ্ধ করে আলাদা হতে? শতকরা ৯৭টি ভোট পেয়েও দুই মাসের বেশি মন্ত্রীসভা টিকিয়ে রাখতে পারলেনা ১৯৫৪ সালে। এখন একেবারে আলাদা হয়ে যাবে। আর না হয় আলাদা হয়েই গেলে, তখন তোমার দেশের আর্থিক অবস্থা কি হবে? কোরিয়ান বুম ত আর নেই যে পাটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় চালিয়ে দেবে দেশের অর্থনীতি। চলবে কি করে তোমাদের?
এবারে শেখ সাহেব আস্তে আস্তে মাথা তুলে বললেন, স্যার, এখনও শতকরা ৯৭/৯৮টি বাঙ্গালী আমাদের ডাকে সাড়া দেবে। তবে সে ডাক হবে স্বাধিকারের ডাক। আর স্বাধিকারের ডাকে দেখা দেবে গণ আন্দোলন। আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারলে অস্ত্রের প্রয়োজন হবে না। বাঁশের লাঠিই হবে যথেষ্ট।’ মন্নান সাহেবের দিকে তাকিয়ে শেখ সাহেব বলেন, আর স্যার, এই হাজার হাজার প্রবাসী বাঙ্গালী যাদের আপনি পাসপোর্ট দিয়েছেন, যাদের পাসপোর্ট দিয়ে এদেশে পাঠিয়েছেন, তারা যোগাবে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাÑ তারা গড়ে তুলবে বিশ্বজনমত বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবার চুপ করে রইলেন। একটু করে মুচকি হাসি হেসে বললেন, হ্যা তুমি তৈরি করবে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। তারপর মন্নান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি মন্নান মিয়া, কি বলো তুমি? মন্নান সাহেব এমন মারাত্মক প্রশ্নে কি বলবেন ভেবে পেলেন না। শুধু বললেন, আপনারা যা বলবেন তাই করব আমরা। আমরা দেশের মানুষের সাথে আছি, স্যার। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, হুঁ, আচ্ছা দেখা যাবে।
সেদিন আলাপ ওখানেই শেষ হয়ে যায়। এরপর আরো কয়েক দফা আলাপ হয়েছে উভয় নেতার মধ্যে। তারপর সোহরাওয়ার্দী সাহেব অসুস্থতার জন্য ফিরে গেলেন জুরিখে। সেখান থেকে বৈরুতে। আর এর কিছুদিন পর ৫ই ডিসেম্বর (১৯৬৩) তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন বৈরুতের এক হোটেলে।
এদিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব জুরিখে চলে যাওয়ার পর শেখ সাহেব লন্ডনে থাকলেন আরো কয়েকদিন। সে সময় লন্ডনে ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দেখে তিনি খুবই খুশি হলেন। তাঁর কথাবার্তায় যথার্থই বুঝতে পারা গেলো যে তিনি পুর্ব পাকিস্তানের দাবী দাওয়া নিয়ে এখনই আন্দোলন শুরু করতে বদ্ধপরিকর। তবে নেতার (সোহরাওয়ার্দী সাহেবের) কাছ থেকে এ ব্যাপারে যে তিনি অনুমতি পান নাই তার জন্য মর্মাহত দেখা গেল।
দেশে ফেরার দিন অনেকের সামনে মন্নান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে আবেগময় কণ্ঠে শেখ সাহেব বললেন, মন্নান সাহেব, শেখ মুজিব আর বাঁচতে চায় না। দেশের মানুষের স্বাধিকার আদায় না করে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। এর চাইতে জালেমদের সাথে লড়াই করে মৃত্যুই শ্রেয়। এবার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব। হয়ত আইয়ুব শাহীর হাতে মৃত্যু হবে। আমার ছেলে মেয়েদের দিকে একটু নজর রাখবেন।
সামাজিক ছদ্মাবরণে রাজনৈতিক ধারণার উন্মেষ
পেশার দিক থেকে সিলেটিরা যুক্তরাজ্যে হোটেল ব্যবসাকেই প্রাধান্য দেন। প্রতিটি শহরেই তাদের বহুসংখ্যক হোটেল গড়ে ওঠে। এসব হোটেলের মালিক-কর্মচারি সকলেই সিলেটি। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটেনে তিন শতাধিক রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠে। এসব সিলেটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি স্বদেশী সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। পারস্পরিক সৌহার্দের সূত্রে ষাটের দশকেই সিলেটিরা বৃটেনের বিভিন্ন শহরে নিজ নিজ এলাকাভিত্তিক বহু সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এর পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি শহরে গড়ে ওঠে ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন।
গ্রীনমাস্ক রেস্টুরেন্ট থেকে ইংল্যান্ডে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক তৎপরতায় প্রবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগৃতি ঘটে। তখন তছদ্দুক আহমদের উদ্যোগে একটি রাজনৈতিক আলোচনা চক্র গঠিত হয়। অতঃপর তাঁরই সম্পাদনায় দেশের ডাক নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এটি ১৯৫৬ খ্রি. থেকে ১৯৬৮ খ্রি. পর্যন্ত বাঙালিদের মধ্যে দেশের খবরাখবর ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ প্রকাশ এবং প্রবাসীদেরকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
যুক্তরাজ্যস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের বৈরী আচরণ ও লন্ডন ভ্রমনকারী পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতাদের মতবিনিময় থেকে সেখানে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্ররা দেশীয় রাজনীতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনস্থ বাঙালি ছাত্রদের একটি আলোচনাচক্র শুরু হয়। আইনের ছাত্র আব্দুর রশিদের বাসায় প্রতি রোববার বিকেলে এই আলোচনা চলতো। এতে অংশ নিতেন আইনের ছাত্র আমিরুল ইসলাম, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, নূরুল ইসলাম, কবির উদ্দিন, ফজলে আলী প্রমুখ। এর ধারাবাহিকতায় হবিগঞ্জের জাকারিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে তাঁর বাসায় একাধারে ৬দিন পরামর্শ সভার পর লন্ডনে ‘পূর্বসূরী’ নামে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। উচ্চশিক্ষার্থে বিলাত-প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে জাকারিয়া চৌধুরী, আমিরুল ইসলাম, কে এস নবী, মওদুদ আহমেদ, জমির উদ্দিন সরকার, শরীফুল ইসলাম খান, মাহমুদুর রহমান, শহীদ ড. আলিম চৌধুরী, আলমগীর কবির (চিত্র প্রযোজক), ড. সালাহ উদ্দিন আহম্মদ, ড. মনোয়ার হোসেন, ড. বেলায়েত হোসেন, এ কে খান, আব্দুর রব, লুৎফুর রহমান শাহজাহান, শফিক রেহমান, সৈয়দ ফজলে আলী, ফজলে হাসান আবেদ, ড. কবির আহম্মেদ প্রমুখ ‘পূর্বসূরী’গঠনে অবদান রাখেন।
উক্ত সংগঠন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার ক্ষেত্র প্রসারিত করার জন্য পূর্বলন্ডনে একটি ভবন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাঁদের উদ্যোগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার বৈষম্যচিত্র হিসেবে ‘আনহ্যাপি ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। একই সাথে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্য গঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমি’। অতঃপর ইংল্যান্ড প্রবাসী বাঙালিদের একত্রিত করার মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন শহরে অবস্থিত সিলেটি রেস্টুরেন্ট মালিকদের সমন্বয়ে ‘পাকিস্তান ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন ইন গ্রেটব্রিটেন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি হন মৌলভীবাজারের সিরাজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথপুরের ময়না মিয়া কোরেশী ও নির্বাহী সচিব হন আইনের ছাত্র জহুরুল ইসলাম চৌধুরী।
এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জনসমর্থন এবং তহবিল গঠনের গুরুদায়িত্ব পালন করেন সিলেটিরাই। তখন সমৃদ্ধশালী সিলেটি হোটেল ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এবং সমগ্র যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী সিলেটিদেরেকে সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেন। এই সাংগঠনিক তৎপরতায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নবীগঞ্জের আব্দুল মন্নান।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন গঠিত হবার পর শুরু হয় যুক্তরাজ্যের সকল সিলেটি সংগঠনকে একতাবদ্ধ করে একটি ফেডারেশন গঠনের কাজ। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মোট ৪৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফেডারেশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন তাসাদ্দুক আহমদ ও জেনারেল সেক্রেটারি হন নুরুল ইসলাম। ফেডারেশন গঠনের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ছদ্ম¦াবরণে প্রবাসী বাঙালিদের রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’। এর প্রতিষ্ঠাকালীন ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি ছিলেন কিউ এম ই হক, সহ-সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন ও দেওয়ান মনফর আলী, সম্পাদক এ এ এ রশিদ, যুগ্ম সম্পাদক তৈয়বুর রহমান এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন আব্দুল মন্নান ও রিয়াজুল আলম। ছাত্রনেতাদের মধ্যে জাকারিয়া চৌধুরী, আলমগীর কবির, আবুল খায়ের খান, মওদুদ আহমদ, নুরুল ইসলাম, মেসবাহ উদ্দিন, আমীর আলী প্রমুখ এ উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
পাকিস্তানের হাইকমিশনার লে. জেনারেল ইউসুফ ইস্ট পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করে একদিন ফার্স্ট সেক্রেটারি পাঞ্জাবি জুলফিকার আলীকে গ্রীনমাস্ক রেস্টুরেন্টে পাঠান। জুলফিকার আলী সেখানে এসে এর বিপক্ষে সরকারের মনোভাব প্রকাশ করে এটিকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ভয়ঙ্কর বীজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান দু’জনেই তখন লন্ডনে মন্নান সাহেবের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখনই এ সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশে স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা করতে হলে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের সংগঠিত এবং তাদেরকে বিশ্বজনমত সংগ্রহের জন্য কাজে লাগাতে হলে লন্ডনের এই বিপুল পরিমান সিলেটি জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। সে কারণে ইস্ট পাকিস্তান হাউসই হতে পারে একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
সোহরাওার্দী সাহেব এ ব্যাপারে তৎপর না হওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন। বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে সোহরাওার্দী সাহেবের মতের বিরোধিতা না করে মন্নান সাহেবকে এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পরামর্শ দেন। তিনি তখন মন্নান সাহেবের বাড়িতে থেকে সোহরাওয়াদী সাহেবের অগোচরে কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য নানাভাবে দিক নির্দেশনা দিতে থাকেন। ইতোমধ্যে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ও তাঁর যৌক্তিক বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানকার প্রবাসী বাঙালি সমাজ দেশের রাজনীতি চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তাই মন্নান সাহেবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা পেয়ে সেখানকার বাঙালি সমাজ ইস্ট পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠাসহ স্বদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় সরগরম হয়ে ওঠে।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মন্নান, মিনহাজ উদ্দিন, হরমুজ আলী ও নেছার আলীকে সদস্য করে গঠন করা হয় ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’ এর ট্রাস্টি বোর্ড। এর জন্য উত্তর লন্ডনের হাইব্যুরি হিলে ১০ হাজার পাউন্ড মূল্যে ১৩ কক্ষ বিশিষ্ট একটি বিরাট বাড়ি ক্রয় করা হয়। পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি করা হয় যথাক্রমে হরমুজ আলী ও আব্দুর রশীদকে। সংগঠনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে লালনের লক্ষ্যে এখান থেকে প্রকাশ করা হয় ‘পূর্ব বাংলা’ নামে একটি সাময়িকী। একই সময়ে কিউবান রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য গঠিত ‘পূর্বসূরী’ দলের ইংরেজি নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’।
লন্ডনে আওয়ামী লীগের শাখা গঠন
লন্ডনে অবস্থান কালে প্রবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার যে স্ফোরণ ঘটে তার আলোকে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যত আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক ভাবে বেগবান করার জন্য একটি নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তা করেন। তিনি প্রবাসী নেতাদেরকে ইংল্যান্ডে আওয়ামী লীগের শাখা গঠনের পরামর্শ দেন। কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকায় আওয়ামী লীগের শাখা গঠন না হলেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সেখানে জোড়ালো আন্দোলন গড়ে ওঠে। উক্ত মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর লন্ডনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা আব্দুল মন্নান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করা ও লন্ডনে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য দেশে আসেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন সফরের সিদ্ধান্ত নিলে মন্নান সাহেবও লন্ডনে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মন্নান সাহেবের দীর্ঘ প্রবাস জীবনের ক্লান্তি দূর করার জন্য কিছুদিন দেশে থেকে যেতে পরামর্শ দিলে তিনি দেশে রয়ে যান। বঙ্গবন্ধু এই লন্ডন সফর কালে আব্দুল মন্নানের অনুপস্থিতিতে লন্ডনের অপরাপর সিলেটী নেতা গউছ খান, মিনহাজ উদ্দিন, নেছার আলী, তৈয়বুর রহমান, হাফিজ মজির উদ্দিন, বামিংহামের আফরোজ মিয়া, জমশেদ মিয়া, ম্যাঞ্চেস্টারের আব্দুল মতিন, নজীর উদ্দিন, মকদ্দস বখত প্রমুখকে আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখাসহ বিভিন্ন শহরভিত্তিক শাখা গঠনের দায়িত্ব দেন।
মন্নান সাহেব দেশে অবস্থানকালেই গউছ খানের নেতৃত্বে ‘আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখা’ গঠন করা হয়। এ কমিটি প্রায় ছয় মাস বিভিন্ন শহরে সাংগঠনিক তৎপরতা চালায়। সে বছরের মাঝামাঝি সময়ে উক্ত শাখা বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক কাজে সহায়তার জন্য একটি বড় ল্যান্ড রোভার গাড়ি দেশে পাঠায়। ২০ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বামী ড.ওয়াজেদ মিয়ার পরিচালনায় নির্বাচনের মাধ্যমে এ শাখার কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গউস খান এবং জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ তৈয়বুর রহমান।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রবাসী সিলেটিদের অবদান
৬ দফা আন্দোলনের গতিরোধ করার লক্ষ্যে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে দমনের উদ্দেশ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে প্রধান আসামী করে। এ পর্যায়ে দেশের আপামর জনতা আন্দোলনকে গতিশীল করতে সক্ষম হলেও মামলা থেকে নিষ্কৃতির জন্য যে রকম আইনী তৎপরতার দরকার তা তেমন জোড়ালো ছিল না। সে সময়ে দেশের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবীরা আইয়ুব-মোনায়েমের ভয়ে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে অনীহা প্রকাশ করেন।
মামলায় আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন এডভোকেট আব্দুস সালাম খান। লন্ডনের ইস্ট পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠার অন্যতম সৈনিক ব্যারিস্টার মওদুদ ও আমিরুল ইসলাম দেশে এসে তখন আইন পেশার সাথে যুক্ত হয়েছেন মাত্র। এ অবস্থায় আব্দুল মন্নান লন্ডনের অপরাপর প্রবাসী নেতাদের সাথে মতবিনিময় করে একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তিনি জাকারিয়া চৌধুরী ও মিনহাজ উদ্দিনকে দেশের আইনজীবীদের সাথে আলাপ করার জন্য প্রেরণ করেন।
১০ জুন আব্দুল মন্নানের নেতৃত্বে লন্ডনে ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড’ গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল মন্নান, সেক্রেটারি মিনহাজ উদ্দিন ও ট্রেজারার ছিলেন হাফিজ মজির উদ্দিন। জাকারিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল ছাত্র-সংগঠক এ তৎপরতায় প্রশংসনীয় অবদান রাখেন। শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ডের নেতৃবৃন্দ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর অব্যাহতির জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সাহায্য কামনা করেন। ডিফেন্স ফান্ডের অর্থানুকূল্যে মন্নান সাহেব ইংল্যান্ডের রাণীর আইন উপদেষ্টা প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউ.সি-কে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নিয়োগ করেন। টমাস উইলিয়াম ২৬ জুলাই ঢাকায় আসেন। ২৯ জুলাই তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান।
এর আগে ১৪ জুলাই লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে হাজার হাজার প্রবাসী সভা করে সেখান থেকে মিছিল সহকারে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের দাবিসহ আইয়ুব খান রচিত শাসনতন্ত্র ও তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে। হাইকমিশনের কিছু ভাড়াটে গুন্ডা এ বিক্ষোভে আক্রমন করলে জাকারিয়া চৌধুরী আহত হন। এরপর সেখানে প্রতিদিন প্রবাসী সিলেটী ও লন্ডনে অধ্যয়নরত পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা বিক্ষোভ করতে থাকেন।
৬ আগস্ট লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর বিচার এবং টমাস উইলিয়ামসের যুক্তিতর্ক সম্বন্ধে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ পায়। এতে সেখানকার প্রবাসীরা ভীষণ উৎসাহিত হয় এবং সেখানে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। ইউরোপের মাটিতে সংঘটিত এ দুর্বার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সারা দুনিয়ার মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে চাপের সৃষ্টি হয় তাতে আইয়ুব খান বাধ্য হন মামলা প্রত্যাহার করে নিতে। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি’৬৯ তারিখে বঙ্গবন্ধু সকল আসামীদেরকে নিয়ে বীরদর্পে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।
বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের অনন্য রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রবাসীদের সাথে সাক্ষাতের জন্য ২৬ অক্টোবর লন্ডন যান। তাঁকে স্বাগত জানাতে হিথরো বিমান বন্দরে সমবেত হাজার হাজার সিলেটি প্রবাসীর ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় লন্ডনের মাটি। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের টি.ডি.ওলেরি, এডওয়ার্ড হীথ এমপি এবং টি.এফ. ওয়াকারসহ বহু বিশিষ্টজন ভিআইপি লাউঞ্জে এসেছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলার মানুষের ভালবাসা ও আন্তরিক উচ্ছাস মুগ্ধনয়নে উপভোগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর লন্ডন পৌঁছার খবর তাৎক্ষণিক পৌঁছে যায় ইংল্যান্ডের প্রতিটি শহর-বন্দরে। বিমান বন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিরাট মোটর-শোভাযাত্রা মাউন্ট প্লেজেন্ট হোটেলে গিয়ে থামে। হোটেলের লাউঞ্জ, বাইরের রাস্তাঘাট সবই লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য আসেন বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর মি. এনেল, বিভিন্ন ব্রিটিশ গণমাধ্যমের সম্পাদক-সাংবাদিক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের লন্ডনস্থ প্রতিনিধি, বিবিসি ও আই টিভির সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী প্রতিনিধিসহ নানা পেশাজীবী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এ সফরকালে বঙ্গবন্ধু ১২ দিন লন্ডনে অবস্থান করে ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস, শহীদ ভবন, গ্র্যান্ড প্যালেস হল, বার্মিংহামের বুলরিং হল প্রভৃতি স্থানে বিশাল বিশাল জনসভায় প্রবাসী মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হন। এ ছাড়াও ম্যাঞ্চেস্টার, শেফিল্ড, ব্রাডফোর্ড প্রভৃতি স্থানে আরো অনেক সভা করার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকার মীরপুরে বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা শুরুর সংবাদ জেনে নতুন ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে বঙ্গবন্ধু সফরসূচি অসমাপ্ত রেখেই দেশের ফিরে আসেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাংলাদেশী
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিনে লন্ডনেও সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্নারে একটি বিরাট জনসভার আয়োজন করেন। বিভিন্ন শহর থেকে রেল, বাস ও কারে করে আগত হাজার হাজার জনতা জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে হাইড পার্ক, অক্সফোর্ড স্ট্রিট পার্ক লেন এলাকা। উক্ত সভা শেষে উপস্থিত প্রায় পনের হাজার মানুষের এক মিছিল পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে। সন্ধ্যায় ইস্ট পাকিস্তান হাউসে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’র নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ভবন’ ঘোষণা করা হয়।
এরপর থেকে প্রতিদিন লন্ডন, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, কার্ডিক, ম্যাঞ্চেস্টার, ব্রাডফোর্ড, লুটন প্রভৃতি ছোট-বড় শহরে চলতে থাকে মিছিল ও সভা-সমাবেশ। প্রবাসীরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেন ইংল্যান্ডের নিজ নিজ এলাকার সংসদ সদস্য, মেয়র, কাউন্সিলরদের সাথে। তাদেরকে পাকিস্তানে শাসকচক্রের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে চলমান বৈষম্য, বর্বরতা ও অসাংবিধানিক তৎপরতার বিষয়টি বুঝিয়ে প্রবাসীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
২৬ মার্চ ব্রিটিশ রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে সেখানকার প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে। অবস্থার প্রেক্ষিতে হাইকমিশন কর্মকর্তাদের অনুরোধে সেখানে ব্রিটিশ পুলিশ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদার করলেও বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে হাইকমিশন দখলের চেষ্টা করলে পুলিশ-জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধে। এতে একজন পুলিশের মাথা ফেটে যায় এবং ৮জন বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হন।
২৭ মার্চ প্রবাসীরা দেশে পাকবাহিনী কর্তৃক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা অবগত হন। ২৮ মার্চ বার্মিংহাম নগরীর স্মলহিথ পার্কে প্রবাসীরা এক সভায় মিলিত হন। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় প্রবাসীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে নেবার জন্য অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের নিমিত্তে তহবিল গঠন এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্বজনমত সৃষ্টির এক দৃঢ় শপথ গ্রহণ করেন। সন্ধ্যায় প্রবাসী নেতৃবৃন্দ পুনরায় একত্রিত হলে ÔCouncil for the people’s Republic of Bangladesh’ নামে গউছ খানের নেতৃত্বে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এর অফিস করা হয় বারউইক স্ট্রিটস্থ গউছ খানের এলাহাবাদ রেস্টুরেন্টের উপর তলায়। ২৮ মার্চ সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে প্রায় দশ হাজার প্রবাসীর উপস্থিতিতে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখা ও সংগ্রাম কমিটির সভাপতি গউছ খান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ৮ জানুয়ারি’৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে পিআইএ’র এটি বিমানে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। খুবই স্বল্প সময়ের অবগতির কারণে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সবার সাথে যোগাযোগ করার পূর্বেই বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে আসেন। তখন ভিআইপি কক্ষে মুজিবকে দেখাশোনার জন্য কেবল বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মুজিবের প্রথম অনুরোধ ছিল লন্ডনে তাঁর পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার। তাঁরা প্রায় সবাই বাঙালি ও রেস্তোরাঁর মালিক। তিনি যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সেনা হেফাজতে, তখন তাঁর পক্ষে ওই ব্যক্তিরা জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
পরিশেষে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন আজীবন স্বাধীনচেতা এবং দূরদর্শী রাজনীতিক। ইতিহাসের অমোঘ বিধানেই তাঁর সাথে বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্থানের যোগসূত্র নির্ণয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর ইউরোপে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা, সেখানকার প্রবাসীদেরকে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার মতো দূরদর্শীতার কারণেই দেশের ক্রান্তিকালে তাদের কাছ থেকে প্রশংসনীয় সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। আজকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় রাজনীতি চর্চার যে প্রবণতা তার পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু। তাঁর প্রেরণায় যুক্তরাজ্যের অভিবাসী বাঙালিরা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তার পথ ধরেই প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়।
মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস, হাওরের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা। সমন্বয়ক (হবিগঞ্জ জেলা): এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: