১৯৭১: সাধারণ মানুষ না খেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে : সালেক খোকন
প্রকাশিত:
৪ আগস্ট ২০২১ ২০:১০
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:১৩
“ছয় দফা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ক্লাসের বাইরের থেকে স্লোগান কানে আসলেই বসে থাকতে পারতাম না। ক্লাস বর্জন করে বেরিয়ে যেতাম। মিছিলে মিশে যেতাম। অন্যরকম লাগত তখন। ছাত্রনেতারা দেশ নিয়ে বৈষম্যের কথাগুলো শোনাতেন। সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল ৯০ পার্সেন্ট, আমরা ১০ পার্সেন্ট মাত্র। তখন চাল, আটা ও সরিষার তেলের দাম পূর্ব পাকিস্তানে ছিল যথাক্রমে ৫০টাকা, ৩০ টাকা ও ৫ টাকা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল প্রায় অর্ধেক যথাক্রমে ২৫টাকা, ১৫ টাকা, ২টাকা। রাজস্বের মাত্র ১৫ শ কোটি টাকা ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে আর পশ্চিম পাকিস্তানে এ ব্যয় ছিল ৫ হাজার কোটি। পাকিস্তানিরা আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। প্রতিনিয়ত এ বৈষম্য মেনে নেওয়াটা সত্যি কষ্টের ছিল।
“উনসত্তরের গণঅভুঙ্থান চলছে। কায়েদী আজম কলেজে হেলাল, এলাহী, মজিবর আর জগন্নাথ কলেজে জিন্না প্রমুখ আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। ছাত্রলীগের চার খলিফার নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ওইসময় এনএসএফের নামকরা গুন্ডা ছিল খসরু আর পাঁচপাত্তু। ওরা ছিল ভয়ংকর। তাছাড়া বিহারী ছাত্ররা আমাদের দেখতে পারত না। প্রায়ই ওদের সঙ্গে মারামারি হতো। দেশ আমাদের অথচ মাস্তানি করছে অন্যরা। এটা ভেবে ঠিক থাকতে পারতাম না।
মিছিলের রাস্তায় ছিলাম সবসময়। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক ছিল কেন্দ্রবিন্দু। মিছিল শুরু হতো সেখান থেকেই। শেষ হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই ব্যস্ত হতাম আরেক কাণ্ডে। সাইনবোর্ডের উর্দু লেখাগুলোতে আলকাতরা লাগিয়ে নষ্ট করে দিতাম। সারারাত চলত এই কাজ।
আমাদের চিন্তা চেতনার মূলে ছিলেন শেখ মুজিব। ছাত্র আন্দোলনের পর পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় তাকে মুক্তি দিতে। ছাত্রসমাজ তখন শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু নামে অভিহিত করে। ”
“একদিন খুব কাছ থেকে দেখি তাকে। ওটাই নেতাকে প্রথম দেখা। তখন সত্তরের নির্বাচন শেষ। মেট্রিক পাশ করেছি মাত্র। আনন্দ নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি গ্রামের বাড়িতে, শরিয়তপুরের জাজিরায়। সঙ্গে বন্ধু সাদেক। বড় ভাইয়ের শ্যালক সে। আমরা ঘাটপাড়ে ঘুরছি। হঠাৎ খবর আসে চরে আটকে গেছে বঙ্গবন্ধুর লঞ্চ। নির্বাচনে একটি হত্যাকাণ্ড হয়েছিল পাবনায়। আওয়ামী লীগের এক নেতাও নিহত হয় সেখানে। তাই বঙ্গবন্ধু গিয়েছেন। ফেরার পথেই তার লঞ্চ চরে আটকে যায়। এ খবর পেয়ে ঘাটের লোকজন নিয়ে ছুটে যাই। বিশটার মতো নৌকা রশি দিয়ে টেনে লঞ্চটাকে ছাড়িয়ে আনে।
বঙ্গবন্ধু তখন চলে যাবেন। আমরা বললাম, না, আমাদের ঘাটে নামতে হবে। সম্মতি দিয়ে উনি শুধু মুচকি হাসলেন।”
“জাজিরা লঞ্চঘাটে ভিড়ে বঙ্গবন্ধুর লঞ্চ। নেমেই উনি প্রশ্ন করলেন- তুই কোথায় থাকিস? আমি বললাম, ঢাকায়। তিনি বললেন, বাড়িতে আসিস তুই।
উনি বেশ লম্বা। আমি তার বুকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তার স্নেহের হাতটি তিনি আমার মাথায় রেখেছিলেন ওইদিন। সে স্পর্শই প্রেরণা হয়ে আছে। এরপর তার দেখানো পথেই আমরা হেঁটেছি। তার নির্দেশে তাকে মুক্ত করতেই ঘর ছেড়েছি একাত্তরে। রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতাকে।”
স্মৃতি হাতড়ে একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম আতিউর রহমান।
তার বাবা ডা. আব্দুর রহমান ও মায়ের নাম হাসিনা বানু। নয় ভাই ও তিন বোনের সংসারে আতিউর ষষ্ঠ। গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুরের (তখন ছিল ফরিদপুরে) জাজিরা উপজেলায়। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। জাজিরায় থানার সাথেই ছিল তাদের বাড়ি, জমিজমাও ছিল অগাধ। কিন্তু একবার পদ্মা গ্রাস করে নেয় সবকিছু। ১৯৫৮ সালে তারা চলে আসে ঢাকায়, ১২৮ নম্বর উত্তর যাত্রাবাড়ির বাড়িতেই কাটে তার শৈশব ও কৈশোর।
আতিউরের লেখাপড়ায় হাতিখড়ি যাত্রাবাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। এরপর পড়েন জুবলি স্কুলে। ম্যাট্রিক পাশের পর তিনি ভর্তি হন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী কলেজ)। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই কলেজেরই ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি।
কেমন ছিল তখনকার ঢাকা? শুনি আতিউরের জবানিতে। তার ভাষায়-
“এতো গাড়ি তখন ছিল না। ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশাতে চড়তাম। মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন রাস্তায় সলতা বাতি জ্বালাতো। সূত্রাপুর, কতোয়ালি, ওয়ারিতে আমাদের মুভমেন্টটা ছিল বেশি। খেলাধুলার পরিবেশ, মাঠ, খোলামেলা জায়গা ছিল অনেক। মানুষের মধ্যে ভালো কালচার আর ভদ্রতা জ্ঞান বেশি ছিল। ওইরকম সময় এখন নাই ভাই।”
“তখন দেখেছি রায়ট হতে। বিহারীরা ছিল খুবই অ্যাগ্রেসিভ। পুরান ঢাকায় অবাঙালি বিহারী কসাইরাই রায়ট বাধাতো। বাড়ির সামনেই ছিল হিন্দু আর জেলে পাড়া। রায়টের সময় হিন্দুরা এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিত। এসব স্মৃতি ভোলার নয়!
“হাই স্কুলে বন্ধু ছিল শেখ সাদী, ফিরোজ কিবরিয়া, আনোয়ার, রাজ্জাক প্রমুখ। আমরা একসাথে খেলায় মেতে থাকতাম। তখন শিক্ষকরা ছিলেন দায়িত্বশীল। জুবলি স্কুলের পণ্ডিত স্যারের কথা মনে আছে। পড়া না পারলে পেটের চামড়া টেনে ধরতেন। খুব ভয় পেতাম তাকে। তবে তিনি আগ্রহ নিয়ে পড়াতেন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি মনোযোগীও ছিলেন। ক্লাসে বেত মারার প্রচলন ছিল তখন। কিন্তু বড় কর্তারা ইনেসফেকশনে আসার আগেই বেতগুলো লুকিয়ে রাখা হতো।”
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। মঞ্চের খুব সামনে থেকে ওই ভাষণ শোনেন আতিউর। আগেই ছাত্র, শ্রমিক, জনতা এক হয়ে যায় সারাদেশে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে সবাই। নেতা কখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন? সকাল থেকেই লাঠিসোটা নিয়ে জড়ো হতে থাকে লাখো মানুষ। সবাইকে সাহস দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখে ওইদিন উচ্চারিত হয়েছিল- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে…।
আতিউরদের কাছে এই নির্দেশনাই সবকিছু স্পষ্ট করে দেয়। এরপর ইকবাল হলে চলে জয়বাংলা দলের ট্রেনিং। সেখানে শারীরিক কসরত ও ডামি রাইফেল দিয়ে আতিউর ট্রেনিং করেন দশ দিনের মতো। ২৩ মার্চে পল্টনে পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের মার্চপাস্টেও অংশ নেন তিনি।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ক্র্যাক ডাউন শুরু হয়। ওই রাতে আতিউর ছিলেন যাত্রাবাড়ির বাড়িতেই। কীভাবে কাটে ভয়ার্ত ওই রাতটি?
তিনি বলেন- “রাতে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। বেরিয়ে দেখি সারা আকাশে বিদুতের ঝলকানি। ফায়ারিংও হচ্ছে। অন্যদের সঙ্গে দৌড়ে আসি ডেমরা রোডে। বড় বড় গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে থাকে স্থানীয়রা। আমি, সাদেক, ফারুকসহ ১০-১২জন তাতে অংশ নিই। কিন্তু ভোররাতে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক দিয়ে তা গুড়িয়ে দেয়।
“২৩ মার্চে উত্তোলন করা বাংলাদেশের পতাকা অনেক বাড়িতেই উড়ছিল। আর্মিরা মাইকিং করে ওই পতাকা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ করে। মাঝেমধ্যে ফাঁকা গুলিও চালায় তারা। সারাশহরে চলে পাকিস্তানি সেনাদের টহল। তখন যে যার মতো পালাতে থাকে। পরিবারের সবাই নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। দুই ভাইসহ আমরা থাকি বাড়ি পাহারায়।
“রাতে বাড়িতে ঘুমানো নিরাপদ ছিল না। সেনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিত। যুবকদের পেলেই গুলি করে মারত। বাড়ির উঠানে একটা বড় আমগাছ ছিল। গাছের ওপর বসে কোমড়ে দড়ি বেধে বসে থাকতাম আমরা। এভাবেই কাটতো গোটা রাত। প্রতিদিন শুনতাম মানুষ মারার সংবাদ। তখন গোপনে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার খোঁজখবর নিতে থাকি। আগ্রহ দেখে সাহায্যে এগিয়ে আসেন পাড়ার এক দোকানদার। তার সঙ্গেই দেশের জন্য ঘর ছাড়ি আমি আর সাদেক।”
কোথায় গেলেন?
“একদিন খুব সকালে কমলাপুর আসি। শ্রমজীবীদের মতো পরনে ছেঁড়া কাপড়চোপড়। যাতে কেউ বুঝতে না পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেনে উঠি। স্টেশনে মিলিটারি গিজগিজ করছিল। দেখলাম, ওরা সন্দেহ হলেই যুবকদের নামিয়েও নিয়ে যাচ্ছে। তখন আল্লাহর নাম জপি, দোয়া দুরূদ পড়ি। প্রায় সাত ঘণ্টায় ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছি। ওই রাতে দোকানদারের বাড়িতে থেকে পরদিনই বর্ডার ক্রস করে প্রথমে আগড়তলা টাউনে এবং পরে কলেজ টিলায় চলে যাই। ওখানে রব ও মাখন ভাই ছেলেদের রিক্রুট করছিলেন। নাম লেখাতেই ১১৩জনের একটা ব্যাচ হয়। আমাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নাইটি ওয়ান বিএসএফে। ওখান থেকে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট হয়ে চলে আসি বিহার চাকুলিয়ায়। সেখানেই আট সপ্তাহ ট্রেনিং হয়। এফএফদের সিএনসি স্পেশাল ব্যাচ ছিল ওটা। ফেনির জয়নাল হাজারী, যশোরের টিপু সুলতান খান, সিলেটের প্রিন্সিপাল আহাদ চৌধুরী, কুমিল্লার কাশেম, জনকন্ঠের আতিকুল হক মাসুদ, মুন্সিগঞ্জের ফজলে এলাহি, সুলতান উদ্দিন রাজাসহ ১৩ জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রনেতা ও আওয়ামী আদর্শের নেতারা ছিলেন ওই ব্যাচে। ওটা ছিল স্পেশাল ট্রেনিং।
“ভারতীয় ক্যাপ্টেন ইন্দ্র শিং ও কর্নেল দাস গুপ্ত ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। ফায়ারিং, এক্সপ্লোসিভ, আন্ডারগ্রাউন্ড, আর আন কমবাইন্ড (অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ কৌশল), টাইম পেন্সিল ডেটোনেটর, রকেট লাঞ্চার, টু-ইঞ্চ মর্টার, গ্রেনেড, এএলএমজি প্রভৃতি শেখানো হয়। আমি ছিলাম এলএমজি স্পেশালিস্ট। ট্রেনিং শেষে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেলাঘরে। সেখান থেকেই পাই অস্ত্র।”
অস্ত্র নিয়ে তারা গোপনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও নরসিংদীর শিবপুর হয়ে বেলাব দিয়ে বেড়াইদ ও ইছাপুরার দিকে চলে আসে। দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে রমনা ও তেজগাঁওয়ের গ্রুপে তারা ছিলেন ৪৮জন গেরিলা, কমান্ড করতেন আব্দুল্লাহ হিল বাকী। উনি একাত্তরেই শহিদ হন।
এছাড়াও এ গ্রুপটিকে যাত্রাবাড়ি, গেন্ডারিয়া, খিলগাঁও, পল্টন, রমনা এরকম আটটি সেকশনে ভাগ করা হয়। লোক মারফত অপারেশনের নির্দেশ আসতো দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এ টি এম হায়দারের কাছ থেকে।
আরবান গেরিলাদের কাজ ছিল হিট অ্যান্ড রান। মারো আর ভাগো। গেরিলা হিসেবে আতিউর অপারেশন করেন ঢাকার গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ব্রিজ, গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে, ওলোন পাওয়ার স্টেশন প্রভৃতি জায়গায়।”
অপারেশন নিয়ে এই যোদ্ধা স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, “গেরিলা অপারেশন ছাড়াও আমরা ফ্রন্ট ফাইটে অংশ নিই। থাকতাম বালুনদীর ওইপাড়ে, উত্তরপাড়া ক্যাম্পে। ওরা ডেমরা ও গোড়ানের দিক থেকে বোট নিয়ে এসে কায়েতপাড়া হাট ও ত্রিমোহনী গ্রামগুলোতে হানা দিত।
এক দুপুরে ক্যাম্পে ছিলাম ৫জন। আমি তখন টুয়াইসি। ওইসময় খবর আসে কায়েতপাড়া হাটে মিলিটারি আসার। শুনেই এলএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়া রওনা হই। একটা ক্যানেলের কিনার দিয়া হাফ মাইল এগোই। কায়েতপাড়া হাটের ঠিক অপজিটে পজিশন নিই। জায়গাটা ঢালু ছিল। ফলে এলএমজিটা বসাতে পারছি না। বেয়নেট দিয়ে কলাগাছ কেটে এনে তার ওপর এলএমজিটা সেট করি।
মিলিটারিরা বড় দুটো নৌকা নিয়ে হাটে আসছে। একটাতে ওরা কলা খেতে খেতে নৌকায় উঠছে। হাতে ঝুলছে অনেক মুরগি। কিন্তু ওদের সামনে আর পেছনে মানুষ। ফায়ার করতে পারছি না। একটা নৌকা ক্রস করে চলে যায়। অন্যটা রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার ওপেন করি। ওরা নয়জন মারা পড়ে স্পটেই। বাকীদের পিটিয়ে মারে হাটের মানুষেরা। একাত্তরে ভয় ছিল না। শক্রর কথা শুনলেই মাথা ঠিক থাকতো না। মনের জোর আর সাহস ছিল অনেক। সাধারণ মানুষ না খেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে। তাদের শক্তিটাও অনেক বড় ছিল।”
এক অপারেশনে মারত্মকভাবে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয় তার বাম পা।
কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনটিতে। জানতে চাই আমরা। চোখের কোনে জল জমিয়ে এ সূর্যসন্তান তুলে ধরেন সেদিনের আদ্যপান্ত। তার ভাষায়-
“২৮ নভেম্বর ১৯৭১। দুপুর বেলা। আমরা উত্তরপাড়া ক্যাম্পে। পাকিস্তানি সেনারা ছিল ত্রিমোহনী গ্রামে। আমরা ওই গ্রামে ঢুকতেই মুখোমুখি হয়ে যাই। ১০-১৩জনের মতো ছিলাম। ওদের পজিশন একটু উঁচুতে, আমার ঢালুতে। তুমুল গোলাগুলি চলছিল। পজিশনটা ঠিক ভাল ছিল না। তাই পজিশন চেঞ্জ করা জরুরি। থেমে থেমে ওরা গুলি করছে। এর মধ্যেই দৌড়ে অন্য জায়গায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। হঠাৎ পায়ে একটা ধাক্কা লাগে। আমি উপুড় হয়ে পড়ে যাই। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে দেখি বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে পিনপিন করে রক্ত ঝরছে। উঠতে যাব কিন্তু ওই পায়ে ভর দিতে পারি না। মরার মতোই পড়ে থাকি। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নেয় নৌকায়। এক গ্রামে চলে প্রাথমিক চিকিৎসা। পায়ের হাড় গুড়ো হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে ড্রেসিং চলতো শুধু। চিকিৎসার অভাবে তখন ক্ষত জায়গা ইনফেকশন হয়ে যায়। স্বাধীনের পর চিকিৎসা হয় ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু তবুও কষ্ট কমে না। বরং ক্ষত স্থানে পচন ধরে। এতে মাংস কেটে ফেলে দিতে হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে আমাকে পাঠানো হয় যুগোস্লোভাকিয়া সামরিক হাসপাতালে। ওখানে কর্নেল ক্লাগ উইলিয়াস পায়ের ক্ষত স্থানে প্রথমে বন গ্রাফটিং এবং পরে স্ক্রিন গ্রাফটিং করেন। ওই চিকিৎসাটা না হলে হয়তো পা-টা কেটে ফেলতে হতো।
একাত্তরের যুদ্ধ শেষ কিন্তু শরীরের সাথে যুদ্ধটা এখনও চলছে। পায়ে ব্যাথা হয় প্রায়ই। স্বাভাবিকভাবে চলাচলও করতে পারি না। তবুও স্বাধীন দেশ পেয়েছি। রক্ত দিতে পেরেছি দেশের জন্য। এটা ভেবেই তৃপ্ত হই।”
১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা আতিউর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন হাসপাতালে। এরপর বড় ভাইয়ের দোকানে বসতেন। পাশাপাশি ছোটখাট ব্যবসা করেই জীবন চালিয়েছেন। এখন যুদ্ধাহতের ভাতা দিয়েই চলছে পরিবার।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা লাভের জন্য কোন জায়গায় একটি আবেদনও করেননি এই বীর। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর তিনি চাইলেই পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে নিতে পারতেন। যা করেছে অনেকেই। কিন্তু তিনি বিপথে যাননি। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘অসততা আর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় একসঙ্গে চলতে পারে না।’
কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে। এই যুদ্ধাহত অকপটে বলেন, ‘তিনশত টাকা যখন ভাতা ছিল তখন অনেকেই ভাতা নিতে চাননি। এখন ভাতা ও সুযোগ সুবিধা বাড়ছে। তাই বাড়ছে সুবিধাবাদীর সংখ্যাও। অনেক অমুক্তিযোদ্ধারাও তালিকায় নাম তুলেছে। যাচাই বাছাইতে আমি যাকে চারবার ক্রস দিয়েছি সেও এখন মুক্তিযোদ্ধা। গেজেটও হয়ে গেছে। টাকার জোরে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে এরা। আবার যাদের যাচাই বাছাই আগে হয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলেও কেন যাচাইবাছাই করতে হবে? এটাও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কেননা এমনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ঠিকভাবে কথাও বলতে পারেন না। শারীরিকভাবে অক্ষমও হয়ে গেছেন অনেকেই। আটচল্লিশ বছর আগের কথা তারা কিছুই বলতে পারবে না। তাহলে তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নন? মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী গণমাধ্যমে কথা বলেন বেশি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও রাজাকারের তালিকা কোনটাই তিনি বির্তকহীন রাখতে পারেননি। যা এককথায় দুঃখজনক।”
স্বাধীনতা লাভের পর জাসদের অতিবিপ্লবীদের কারণেই রক্ষীবাহিনী করতে হয়েছে বলে মনে করেন এই যোদ্ধা। সে সময় তারাই পাটের গুদামে আগুন, ব্যাংক লুট ও ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিপদে ফেলেছে। ফলে তাদের ঠেকানোও দরকার ছিল। মূলত জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম তৈরি করেছিল বলে মত দেন মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের কাজে না লাগানো ও রিপ্যাটট্রিয়টদের এনে সেনাবাহিনীতে রাখাটাও সঠিক ছিল না বলে মনে করেন তিনি।
“আবার জিয়া স্বাধীন দেশটাকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বানাতে চেয়েছিলেন বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা আতিউর। তার হাত ধরেই পুনর্বাসিত হয় রাজাকাররা। ইতিহাসকে কলংকিত করেছেন জিয়াউর রহমান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এই দায় তাকে নিতেই হবে”, বলেন এই বীর।
যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন, স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
মুচকি হেসে এই সূর্যসন্তান বলেন, “স্বপ্ন ছিল সুন্দর, বৈষম্যহীন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি দেশ হবে। যেখানে সবাই পেটপুড়ে খেতে পারবে। সেই পথেই এখন দেশ এগোচ্ছে। কিন্তু গন্তব্যে এখনও পৌঁছাতে পারেনি।”
কী করলে দেশ আরও এগোবে?
এই যুদ্ধাহতের উত্তর, “নোংরামি আর ধান্দাবাজদের ঠেকাতে হবে। ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি, সে দেখি গাড়ি নিয়ে ঘুরে। এটা কোন তামশা! ছাত্রলীগ, যুবলীগের টাকার খনির উৎস কোথায়? এগুলোকে কন্ট্রোল করা না গেলে শত উন্নয়নেও সরকারের ভাবমূর্তি মুখ থুবড়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকার শুধু মন্দের ভাল সরকার হলেই হবে না। সত্যিকারভাবে ভাল সরকার হতে হবে। তাই বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক করাপশন।”
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত এই মুক্তিযোদ্ধা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনকে সাধুবাধ জানিয়ে অকপটে বলেন, “বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের রক্তঋণ শোধ হবার নয়। তাই প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু উৎসবই নয়, সত্যিকারভাবে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনাকে বুকে ধারণ করতে হবে। তার রাজনৈতিক গুণগুলোকে নেতাকর্মীদের ভেতরও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তবেই দেশটা স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে।”
প্রজন্মের সফলতা আর এগিয়ে যাওয়া দেখলে মন ভরে যায় এই যুদ্ধাহতের। তাদের নিয়েই পাহাড়সম আশা তার। তাই প্রজন্মের উদ্দেশে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম আতিউর রহমান বললেন- “তোমাদের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। কাদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে এলো এই দেশ? সেটি তোমরা জেনে নিও। সত্য ও ন্যায়ের পথে তোমরা দেশটাকে এগিয়ে নিও। মনে রেখো দেশ ভাল থাকলেই তোমরাও ভাল থাকবে।”
ছবি: সালেক খোকন
সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক
[email protected]
বিষয়: সালেক খোকন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: