সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

এক যে ছিলো চন্দন : ফারুক নওয়াজ


প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৩৩

আপডেট:
৪ এপ্রিল ২০২২ ২২:৫৯

ছবিঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান এবং শাহান আরা জাকির

 

হ্যাঁ, গল্পই। রূপকথার মতো তার জীবনের ইতিকথা।
ষোল-সতেরো বছরের এক কিশোর। গ্রামের শ্যামলিমায় বেড়ে ওঠা, হলুদ শস্যের ঘ্রাণমাখা উদাস কিশোর। কবিতার মতো নিসর্গের সবুজ বালক। স্বপ্ন দেখা মায়াবী চোখের ছেলেটির নাম চন্দন। নামটি তার কে রেখেছিলো জানি না, তবে যথার্থই সে নাম। সৃজনের চন্দন সুবাসে মাখা মন। স্বভাবত শান্ত, সুবোধ ছেলেটি। এই সুবোধ ছেলেটিই হঠাৎ হয়ে ওঠে বাঁধ না মানা সাহসী এক যোদ্ধাপুরুষ। যখন দেশ ডাকে, প্রিয় মাতৃভূমি ডাক দেয়, তখন এইসব সুবোধ-শান্ত ছেলেরাই সবার আগে ছুটে যায়।
চন্দনও ছুটেছিল তেমনই বীরবেশে। ডেকেছিলো দেশ। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব যখন দেশমাতৃকার মুক্তির মহানায়ক, তখন তাঁর হুঙ্কারে চন্দনরা না ছুটে পারেনি। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যে মুক্তির লড়াই তাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশ্রপ্রেমী কিশোর, তরুন, বৃদ্ধ সবাই ছুটেছিলো; শুধু কিছু বিশ্বাসঘাতক, বিবেকহীন আত্মঘাতী বঙ্গ-কুলাঙ্গার ছাড়া। তাদের পরিচয় হয়ে উঠেছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামস শব্দের আবরণে ঘাতক-দালাল। তারা বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসে চিরঘৃণিত না-মানুষ।
আর দেশমাতৃকার মুক্তির বীর সন্তানেরা ছিল দেশপ্রেমী বীর মুক্তিযোদ্ধা। ষোল-সতেরোর চন্দন লাখোবীরের সেরা এক বালক মুক্তিযোদ্ধা। রূপকথার চেয়েও অপূর্ব তার যুদ্ধে যাওয়ার বীর-কাহিনিকা। হয়তো মাকে, স্বজনদের না-জানিয়েই চুপিচুপি এক গহীন রাতেই দেশমুক্তির যুদ্ধে সে ছুটেছিল। হয়তো তাই, কারণ, উত্তরের এক অনুন্নত জেলা কুড়িগ্রামের ধুলো ওড়া অজ-পল্লী ভোগডাঙ্গার মাত্র ষোল বছরের এক যুদ্ধ-অচেনা ছেলেকে কে পাঠায় অনিবার্য মৃত্যুর পথে!,
তবে, সত্য এটাই-চন্দন যুদ্ধে গিয়েছিল।
জন্ম তার প্রিয় গ্রাম ভোগডাঙ্গায়, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ। দশ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় চন্দন। বাবা কাজী মকবুল হোসেন ছিলেন আর্টিস্ট। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও কোলকাতায় স্টাফ আর্টিস্ট ছিলেন। মায়ের নাম জুলেখা বেগম। লেখাপড়ায় চন্দনের হাতেখড়ি খাটামারি প্রাইমারি স্কুলে। এসএসসি পাশ করে কুড়িগ্রাম রিভারভিউ হাই স্কুল থেকে। পরে চলে যায় বাবার কাছে, ঢাকার বাসবোতে। ইন্টামিডিয়েটে ভর্তি হয় আবুজর গিফারি কলেজে। ১৯৭১-এ, মুক্তিযুদ্ধের বছরে ছিল ওই কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র।
হ্যাঁ, যুদ্ধশেষে এই বীরকিশোর স্বাধীন স্বদেশে যখন ফিরে এলো বীর বেশে, তখন তার একটি পা নেই। যা সে উৎসর্গ করেছিল দেশমাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে।

রণাঙ্গনে চন্দনের গল্পটা এমন
যুদ্ধ করে ৬ নং সেক্টরের লালমনিরহাট সাব সেক্টরে। ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি কোম্পানির দায়িত্বে ছিল এই সাহসী বালক। তাদের ক্যাম্প ছিল ভারতের গিতালদহ পুরনো রেলস্টেশনে। সীমান্ত পার হয়ে তারা অপারেশন করে লালমনিরহাটের মোগলহাট, কাকিনা, গোরপমণ্ডল, আদিতমারী, স্বর্ণামতি ব্রিজ, রতনাই ব্রিজ, বড় বাড়ি প্রভৃতি এলাকায়। সেক্টর কমান্ডার এম কে বাসারের অধীনে তাদের কমান্ড করতেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন উইলিয়াম।
১৯৭১ সালের ১ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা বশির ও শামসুল কিবরিয়াকে নিয়ে আগে রেকি করতে বেরিয়ে পড়ে চন্দন। আলাদাভাবে ক্যাপ্টেন উইলিয়ামও বিএসএফের কয়েক সদস্য নিয়েও রেকি করে সে। রেকি সঠিক হওয়ার পর অপারেশনের জন্যে সঙ্গে দিলো ১৭-১৮ জনকে। এ দলের কমান্ডেও চন্দন। ক্যাম্প থেকে দড়িবাস নামক একটি জায়গা পেরিয়ে শাখা নদী জারি ধরলা। এই নদী পার হয়ে যেতে হয় গোরপণ্ডল এলাকায়। জারি ধরলার কাচারটা ছিল বেশ উঁচুতে। সেখানে ছিল বিরাট এক পাকুর গাছ।
রেকির সময় মুক্তিযোদ্ধারা দেখেছিলো, ৮ থেকে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা ওই গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা মানে চন্দনের পরনে ছিল সাধারণ পোশাক। কিন্তু সে সময়ে পাকিস্তানি সেনারাও যে মুক্তিযোদ্ধাদের সে রেকি কার্যক্রম দেখেছিলো মুক্তিযোদ্ধারা সেটি বুঝতে পারেনি।
১৯৭১ সালের ২ জুলাই ভেলায় করে নদী পার হয়ে এগুতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। রাত তখন ৩টা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নিয়ে তৈরি ছিলো। ভোরে দূর থেকে দেখা গেল পাকিস্তানি সেনাদের টুপি আর রাইফেল।
পাকিস্তানি সেনারা এইদিক দিয়েই গ্রামের দিকে ঢুকবে, তাই মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করে বসেছিলো। কিন্তু আসলে তখন চন্দনের নেতৃত্বাধীনে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই ছিলো ওদের অ্যামবুশের ভেতরে। মুক্তিযোদ্ধাদের আসার সমস্ত পথে মাইন পুঁতে রেখেছিল ওরা। ওরা রেঞ্জের মধ্যে আসতেই চার্জ বলে একটি গ্রেনেড চার্জ করে চন্দন। অন্যারাও তিন দিক থেকে চার্জ করলো। এই কৌশলগত যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দশজনই মারা গেলো।
খুশিতে বিজয় মনে করে যেই বের হলো অমনি মাইন বিস্ফোরন হলো। ছিটকে পড়ে গেলো চন্দন। ডান পা থেকে রক্ত বের হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। হাঁটুর নিচ থেকে পা উড়ে যায় তার।
মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল, আকরাম, নীলফামারীর শহিদুলসহ সহযোদ্ধারা গামছা দিয়ে তার পাটা বেঁধে দেয়। ভেলায় করে প্রথম তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। পরে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুচবিহার জিএন হাসপাতালে। ওখানেই ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। এরপর ব্যারাকপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতাল হয়ে কিরকি মেডিকেল হাসপাতাল থেকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হয়। শুধু পা-ই হারালো না। তার সারা শরীর জুড়েই ছিলো বিষাক্ত বারুদের ক্ষত।

যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে
তবে, মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে পা হারানো চন্দন অসুখি ছিল না। দুঃখ করত না অঙ্গহানির বেদনায়। বরং, নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে এসে নতুন করে জেগে ওঠে। নিজের মেধা, সাহস আর স্বপ্নে ভর করে সে পড়াশোনার পাশাপাশি সৃষ্টির আলোকিত সৃজনযজ্ঞে হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক গৌরবের অধিকারী। অবশ্য আমি যখন তাঁকে স্বচক্ষে দেখি, পরিচিত হই- তখন তিনি একাত্তরের সেই বীর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা চন্দন নন। তিনি তখন জনপ্রিয় নাট্যকার, গল্পকার, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের ইতিহাস লেখক, বেতারের মুখ্য পান্ডুলিপি লেখক কাজী জাকির হাসান।
হ্যাঁ, তাঁর মূলনাম কাজী জাকির হাসান। ১৯৭১ সালে বেতারে তার প্রথম নাটক খেয়াঘাটের মাঝি প্রচারিত হয়। এরপর তিনি বেতার নাটকের জনপ্রিয় লেখক হিসেবে লাখো শ্রোতার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাতই এই লেখালেখির কারণে।
শুধু বড়োদের জন্যই নয়, শিশুদের জন্যও তাঁর লেখার হাতযশ ছিলো প্রশংসাযোগ্য। আমি তখনো বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় শিশু কিশোর মাসিক শিশু পত্রিকার সম্পাদনা কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রিয় নাট্যকার কাজী জাকির হাসান তখন সময় সময় পত্রিকায় লেখা দিতে আসতেন। আমিও মনের টানে কখনো কখনো তাঁর শাহবাগের বেতার ভবনে যেতাম। প্রতিবারই তাঁর সান্নিধ্যলাভে আনন্দিত হতাম, উপকৃত হতাম।
উপকার হতো এটাই যে, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের রূপকথার মতো সাহসের সত্যকাহিনী তাঁর কাছে শুনে শুধু পুলকিতই হতাম না, আমার লেখালেখির উপাত্ত-অনুষঙ্গ হিসেবেও তা কাজে লাগতো। তিনি নিরন্তর লিখে গিয়েছেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ১৫টি। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধের গল্প, তাহাদের গল্প, নাট্যসমগ্র, ঢাকা বেতার নাট্যচর্চার ইতিকথা, বেতার নাটকের নিজস্ব আর্টিস্টদের জীবনী ইত্যাদি। সারাদেশের বেতার নাট্যশিল্পীদের জীবনী সংগ্রহ করে এ সংক্রান্ত তিনি ৫টি গবেষণা গ্রন্থও রচনা করেছেন। এর বাইরে তাঁর অসংখ্য লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিও রয়েছে অনেকগুলি।
সাহিত্যকীর্তির জন্য ২০১০ সালে শিশু-কিশোর পত্রিকা বীরপ্রষু তাঁকে আজীবন সম্মাননায় অলংকৃত করে। এছাড়া স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন। ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে মৃত্যুবরণ করেন। জাতীয় বেতার ভবনে জানাজার পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়লেখক-নাট্যব্যক্তিত্ব ও গবেষক কাজী জাকির হাসান চন্দন মুক্তিযোদ্ধা সংরক্ষিত কবরস্থান, মিরপুর এ চিরশায়িত হোন।

 

ফারুক নওয়াজ
কবি, লেখক
নির্বাহী সম্পাদক,‘শিশু'

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top