সিডনী বুধবার, ১৭ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা গুড হয়েছেন, এখন আমরা ভেরি গুড চাই: সালেক খোকন


প্রকাশিত:
১৭ নভেম্বর ২০১৯ ১৯:৩৯

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২১:২৯

 

আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। মা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। একদিন একটা বোন হয় আমার। কিন্তু মা ও মেয়ে তখনও ঝুঁকিতে। গ্রামের মানুষ বলে ফুল পড়েনি (ডাক্তারি ভাষায় প্লাসেন্টা প্রিভিয়া)। গ্রামে তখন চিকিৎসা ছিল না। দাই মা ছিল ভরসা। মায়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তার ডাকতে হবে শৈলকুপায়। কিন্তু মায়ের নিষেধ। পুরুষ ডাক্তার দিয়ে কিছুতেই চিকিৎসা করাবেন না। ধর্মীয় কুসংস্কার তখন প্রবল ছিল। চোখের সামনে মা ছটফট করলেন খানিকক্ষণ। এরপরই দম শেষ। কয়েকদিন পর বোনটাকেও বাঁচানো যায়নি। বছর দুয়েক যেতেই একদিন বাবাও মারা যান, এজমাতে। আমি তখন একা, মা-বাবা হারা। 

নানী এরছান নেসাই আমাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। কোথায় কি করতে হবে, কি বলতে হবে-উনি বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর পরামর্শমূলক শাসনেই এগিয়ে যায় আমার জীবন। 

লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম। নাইন থেকেই অন্যেরা বাড়িতে লজিং থাকতাম। দুএকজন বাচ্চাকে পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ছিল ফ্রি। স্কুল-কলেজেও বেতন লাগেনি। কষ্ট থাকলেও লেখাপড়া করে বড় কিছু করব-মনের ভেতর এ ইচ্ছাটাই প্রবল ছিল। 

নানা প্রতিকুলতা ফেস করতে হয়েছে জীবনে। সব কষ্ট পুষে রাখতাম। ভাল ফুটবল খেলতাম। সাধুহাটিতে বড় এক খেলায় একবার জিতেছিলাম। খেলতাম ডিফেন্সে, লেফটে। বন্ধু মনোরঞ্জন বিশ্বাস, পরিতোষ বিশ্বাস, সুসান্ত কুমার বিশ্বাস প্রমুখ ছিল সঙ্গী। ওদের পূজাপার্বনে নিয়মিত যেতাম। ওরাও আসতো। প্রতিমা ভাঙার ঘটনা তখন ছিল না। কিন্তু এখন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসটাই কমে গেছে। ডিসট্রিক জর্জ ছিলেন।

খানিক বিরতি। অতঃপর আবারও কথা শুরু সাইফুল আলমের। এবার তুলে ধরেন সে সময়কার রাজনৈতিক চিত্র।

‘১৯৬৯ সাল। আমি তখন মাগুরা কলেজে। ছাত্র ইউনিয়ন তখন খুব তুঙ্গে। ছাত্রনেতা ছিলেন সিরাজুল ইসলাম ছিরু, আব্দুর রৌফ মাখন প্রমুখ। ছাত্রলীগের ছিলেন রঘুনাথ, নিতাইরায় চৌধুরী, আবুল খায়ের, হাশেম আলম, বাবলু প্রমুখ। 

ছয় দফা সম্পর্কে আগেই জানতাম। কলেজে এসে ছাত্র নেতারা নানা বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। চাকুরিতে আমাদের সুযোগ ছিল খুবই কম। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৫% কোটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আর পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৮৫%। আর্মিতে কর্নেলের উপরে আমাদের কেউ ছিল না। সামরিক বাহিনীতে ওরা ৯০% আর আমরা ছিলাম মাত্র ১০%। কাগজ তৈরি হতো পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ সেই কাগজ ওরা কম দামে আর আমরা কিনতাম বেশি দামে। চালের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২৫টাকা আর আমরা কিনতাম ৫০টাকায়। এ সব বৈষম্য আমাদের মনে ঝড় তুলত। তখন মিছিল করতাম। মিছিলে ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন আলাদা থাকত না। সবাই এক হয়ে যেত। ছাত্রলীগের প্রেসিডেট মাগুরায় তখন নব্যুয়ত আলী আর আওয়ামী লীগের ছিলেন সোহরাব সাহেব।’ 

১৯৭০ সাল। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতাম মাদারবক্স হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মতিয়া গ্রুপের আহম্মদ আলী নেতৃত্ব দিতেন। নির্বাচনের সময় চলে যাই গ্রামে। বন্ধু করুনাকান্তসহ ছাত্রলীগের ছেলেদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতাম। নেতারা আসলেই কাঠাল গাছে মাইক বেধে দিতাম। ওই নির্বাচন ছিল প্রতিবাদের নির্বাচন। জয়লাভের পরও পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা ক্ষমতা দেয় না। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। স্কুল-কলেজও তখন বন্ধ। দেশ পাকিস্তান, কিন্তু চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। ছাত্ররা স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন একজন বঙ্গবন্ধুই।’

মুক্তিযুদ্ধের আগের নানা ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইফুল আলম। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।

বাবা মকবুল হোসেন মিয়া ও মা খতেজান নেছার দ্বিতীয় সন্তান সাইফুল। বাড়ি ঝিনাইদাহের শৈলকুপা উপজেলার নাগিরাট গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নাগিরাট প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন নাগিরাট জুনিয়ার হাই স্কুলে। ক্লাস এইটে চলে আসেন মাগুরার শ্রীরামপুর হাই স্কুলে। ১৯৬৫ সালে ওই স্কুল থেকেই এসএসসি পাশের পর এইচএসসিতে ভর্তি হন মাগুরা কলেজে (বর্তমানে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী সরকারি কলেজ)। ওখানেই ব্যাচেলর অব কমার্সে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। অতঃপর ল’তে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সেকেন্ড পার্ট শেষ হয়েছে মাত্র। 

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সাইফুল আলম শোনেন নাগিরাট বাজারে, রেডিওতে। কেমন ছিল সেই ভাষণ?



তিনি বলেন-‘অনিল, অশিত, ভানুঠাকুর, পরিতোষ, হাশেম লক্সর, বাদশাসহ ভাষণ শুনেছি। আমরা তো অপেক্ষায় আছি, শেখ মুজিব কি বলেন। তিনি বললেন-‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে.....আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে.....মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি , রক্ত আরও দেব-এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ...।’ এই নির্দেশগুলোই মনে দাগ কাটে। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই ছিল স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা।’

আপনারা তখন কী করলেন?

সাইফুল আলমের উত্তর-‘ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দায়িত্বে ছিলেন কাজী আব্দুল মোতালেব। তার সাথে যোগাযোগ করে আমরা চলতাম। এরপর আসে ২৫ মার্চ। আমরা তখনও গ্রামে।

পাকিস্তানি সেনারা কন্ট্রোল করার জন্য সারাদেশে আর্মি ডিপুট করে দেয়। ফলে পুলিশ, ইপিআর ও সেনা ব্যারাকগুলোতে চলে গোলাগুলি। অনেক বাঙালি সদস্য শহীদ হয়। কেউ কেউ অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনতা। তারা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। 

চুয়াডাঙ্গায় ছিল ইপিআরের একটি সেক্টর। সেখানে ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা। স্থানীয়দের নিয়ে কুষ্টিয়ায় আর্মির ঘাঁটি ঘেরাও করে রাখে তারা। এ খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। 

শৈলকুপায় পুলিশ আর ইপিআর থেকে পালিয়ে আসারা স্থানীয়দের নিয়ে পজিশন নেয় গাড়াগঞ্জে। উদ্দেশ্য কোনভাবেই যেন শৈলকুপায় আর্মিরা আসতে না পারে। আমরা তখন নানা কাজে তাদের সঙ্গী হই। 

গাড়াগঞ্জে উঁচু একটা ব্রিজ ছিল। সকলে মিলে ব্রিজ শেষের রাস্তাটা মাঝ দিয়ে কেটে ফেলি। উপরে কি  দিয়ে বাঁশ কাগজ বিছিয়ে, সেটা আলকাতরায় লেপে দেওয়া হয়। দূর থেকে দেখতে যেন রাস্তাই মনে হয়। অতঃপর অপেক্ষায় থাকি।

তারিখটা ৩০ মার্চ ১৯৭১ হবে। কুষ্টিয়ায় চাপ সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা এ পথেই এগোতে থাকে। রাতে ওরা জিপ নিয়ে ওই কাটা রাস্তায় পড়ে যায়। ফলে ওদের কয়েকজন মারা পড়ে। বেঁচে যাওয়ারা ভয়ে প্রথম চারদিকে গুলি চালায়। ওখানেই আলি আজম ও করিমসহ আহত হয় কয়েকজন। এক পর্যায়ে ওরা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ে পালাতে থাকে। কিন্তু গ্রামবাসী তাদের ধরে ফেলে। সেখানে পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট আতিকুলও ছিল। ইপিআররা তাকেও ধরে পাঠিয়ে দেয় চুয়াডাংগায়। 

৩১ মার্চ সকালবেলা। খবর আসে ঝিনাইদহ-মাগুরার মাঝামাঝি হাটগোপালপুর বাজারের পাশে লৌহজাংগা নামক জায়গায় যুদ্ধ চলছে। শুনেই খালেকসহ ছুটে গেলাম। ওখানে দুইজন বেলুচ সেনাকে মেরে পাবলিকরাই নদীর পাড়ের মাটিতে গলা পর্যন্ত পুতে রেখেছিল। যারাই আসছে তারাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওদের গোফ ধরে টানছে আর বলছে- ‘এদেশের খেয়ে খেয়ে তোমরা গোফ বানাইছো।’ পাকিস্তানিদের প্রতি মানুষ কতটা ক্ষিপ্ত ছিল সেদিই বুঝেছি।’

পাকিস্তানি সেনারা শৈলকুপা দখল করতে পারেনি?

‘ওইদিন পারেনি। কিন্তু তাদের কিছু সৈন্য যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। তারিখটা ১৩ এপ্রিল হবে। ওরা পুরো সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে আবারও এগিয়ে আসে। ঝিনাইদহ থেকে দক্ষিণে, যশোরের দিকে যেতে বিসইখালি ব্রিজে তারা প্রতিরোধের মুখে পড়ে। প্রচন্ড যুদ্ধ হয় সেখানে। খালেকসহ আমিও যাই। ট্রেনিং নাই কিন্তু তবুও দেশের জন্য তখন উন্মাদ ছিলাম। ওখানে যুদ্ধ করেছিলেন বাঙালি ইপিআর ও পুলিশের সদস্যরা। নেতৃত্ব দেন মাহাবুব উদ্দিন এসডিপিও (সাব ডিবিশনাল পুলিশ অফিসার)। ওই অপারেশনে পাকিস্তানিদের ঠেকানো যায়নি। 

ওরা তখন শৈলকুপার ঢুকে যায়। সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। একজন ইমাম ছিলেন। উনি ভেবেছেন উর্দু জানেন বলে রক্ষা পাবেন। তাকেই গুলি করেছে প্রথমে। এসডিও অফিসের এক ক্লার্ককে ছাড়াতে আসে তার ভাই। দুইজনকেই নির্মমভাবে হত্যা করে ওরা। ৩৯জনকে হত্যা করে ওইদিন একটা ত্রাস সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। তখন আমরা বিলের ভেতর লুকিয়ে থেকে জীবন বাঁচাই।’

শৈলকুপায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হচ্ছে। এ খবর জানা ছিল না সাইফুল আলমের। আওয়ামী লীগ করতেন গ্রামের আমজাদ হোসেন মৃধা। তার ছিল একটি দোনলা বন্দুক। তিনিই সাইফুলকে প্রথম বন্দুক চালানো শেখান। অনুশীলনের অংশ হিসেবে একদিন রাতে তারা ফাঁকা গুলি চালায়। পরদিন টুকু নামের এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন গুলির উৎস সন্ধান করতে।

বাকী ইতিহাস শুনি সাইফুল আলমের জবানিতে।

তাঁর ভাষায়- ‘কোথা থেকে গুলি এসেছে আন্তাজ করে টুকু খোঁজ নিতেই আমরা স্বীকার করি। শুনে উনি বলেন- ‘তুমি জান না সোনা মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দল গঠন হয়েছে। চাইলে আসো। না হয় নিজেরাই আরেকটা দল গঠন করো।’ 

ওইদিনই প্রথম শুনি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি। একেক জায়গায় একেকটা দল গঠন হয়। থানা কমান্ডার হন রহমত আলী মন্টু। তার দলে প্রথম জয়েন করি। পরে গ্রামে নজরুল ক্যাম্প করলে তার দলে চলে যাই। রওশন, সিরাজুল ইসলাম মাখন, সালেক, আলী হায়দার প্রমুখ ছিল সহযোদ্ধা। গোপী বল্লভ কু-ুর বাড়িতে ছিল আমাদের ক্যাম্প। সেখানেই চালনা শিখি থ্রি নট থি, এলএমজি আর এসএলআর। গেরিলা ছিলাম। ৩০-৩২জনের দলের কমা- করতেন নজরুল। আমার অস্ত্র ছিল থ্রি নট থ্রি।’ 

আট নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম গেরিলা অপারেশন করেন শৈলকুপা থানা, আলফাপুর, আবাইপুরসহ ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকায়।

একাত্তরের কয়েকটি অপারেশনের কথা তুলে ধরেন এই বীর যোদ্ধা- 

‘অগাস্টের ৩০ তারিখ। মন্ট বাহিনী আসেন আলফাপুরে অপারেশন করতে। ওটা ছিল মাগুরা আর ঝিনাইদহের শেষ জায়গা। নদী আর খাল এলাকা। তাই কোনো দিকে সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ১৯৭১ এ অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। ওই বৃষ্টিই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর্শীবাদ। পাকিস্তানিরা পানি দেখলেই ভয় পেত। সে সুযোগটাই কাজে লাগাই আমরা। ওখানে দুটি অপারেশন হয়। একটি করেন বিশারত ওস্তাদজি, আরেকটি রহমত আলী মন্টু। দুটোতেই সাকসেস ছিল। আমরা ছিলাম ৫০-৫২জন মুক্তিযোদ্ধা।’  

নির্বাচন কমিশনার হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম

‘১৪ অক্টোবর ১৯৭১। ছিলাম শৈলকুপায়, আবাইপুরে। নজরুল ইসলামসহ ৩০-৪০জন। কথা ছিল পাকিস্তানি সেনারা মাগুরার শ্রীপুর থেকে আসলে আকবর বাহিনী তাদের ঠেকিয়ে খবর পাঠাবে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। খবরও পাঠায় না। ফলে সেনারা এসে আমাদের ঘিরে ফেলে। তাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। ওই অপারেশনেই চোখের সামনে মারা যায় নজরুলসহ ১৭জন সহযোদ্ধা। তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখেছি খুব কাছ থেকে। এখনও মনে হলে বুকের ভেতরটা ধুপ করে ওঠে। আমি আর সোলেমান ছিলাম কুমার নদীর দিকটার দায়িত্বে। ওই পথে নৌকা নিয়ে কেউ আসলেই গুলি চালাব। পরে সাতরিয়ে নদী পাড় হয়ে আমরা জীবন বাঁচাই। এভাবেই মৃত্যু প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরত।’

শৈলকুপা মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধারা তখন অস্ত্রসহ চলে যায় ঝিনাইদাহ শহরে। গাড়াগঞ্জে রাজাকার ক্যাম্পে ছিল হাতেম আলী নামে এক রাজাকার। পায়রা চত্বরে জনতা তাকে মেরে পা উপরের দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। রাজাকারদের জেলা কমান্ডার ছিল নুরুন্নবী ছামদানী। উনি পরে ইসলামি ডেমক্রেটিক লীগ করতেন। পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং পরে এমপিও হন। ঝিনাইদহে তার কোন বিচার হয়নি। এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম।

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সুবিধা লাভ থেকে বিরত ছিলেন এই বীর যোদ্ধা। স্বাধীনের পর ‘ল’ শেষ করে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। পরে অ্যাসিসটেন্ট জর্জ হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। সর্বশেষে ডিসট্রিক জর্জ হিসেবে তিনি পদন্নোতি লাভ করেন। জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্বতিমুরের জুডিসিয়ারি ছাড়াও কাজ করেছেন কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন জেলায়, সেক্রেটারি হিসেবে ল কমিশন ঢাকায় এবং সবশেষে দুদকের মহাপরিচালক হিসেবে। অবসর লাভের পর নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মনোনিত হন মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ ডিপার্টমেন্টের প্রধান তিনি। লেখালিখি করে ল’র শিক্ষার্থীদের জন্য। তার প্রকাশিত আইনের বইয়ের সংখ্যা ৩৪টি।

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

‘এখনও সে জায়গায় আমরা যেতে পারিনি। তবে সে পথেই আছি।’

কি করলে দেশ আরও এগোবে বলে মনে করেন?

মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বলেন-‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। গণতন্ত্রের নামে যেন পরোক্ষ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। মানুষ দুটি দিকে মারাত্মকভাবে খুব ঝুঁকে পড়ছে- একটা হলো ফাইনেন্সিয়াল অফেন্স আরেকটা সেক্সচুয়্যাল অফেন্স। এ দুটিকে কমিয়ে আনতে না পারলে সোনার বাংলা হবে না।’

কথা ওঠে শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম অকপটে তুলে ধরেন নিজের মত। তাঁর ভাষায়-‘বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি মানুষের আস্থা আছে। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে আরও কঠোর হতে হবে। রাজনীতিবিদদের পরিচ্ছন্ন হতে হবে, নিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে হবে। পলিটিক্যাল লোকদের করাপশন বন্ধ হলে, তৃণমূলের করাপশনও বন্ধ হতে থাকবে। শেখ হাসিনা নিজে সৎ বলেই সততাকে প্রতিষ্ঠা দিতে চান। তার বলিষ্ট পদক্ষেপ আমাদের পথ দেখাবে। উনি গুড হয়েছেন, এখন আমরা ভেরি গুড চাই।’ 

পরবর্তী প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নিবে- সেই আস্থা রেখেই তাদের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম শুধু বললেন- ‘তোমরা দেশের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাসটা জেনে নিও। লেখাপড়া শিখে মিথ্যা বলো না। সঠিক কথা বলো। সঠিক পথে চলো। আমাদের ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথে দেশকে এগিয়ে নিও।’ 

সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক
www.salekkhokon.net

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top