এক ভাড়াটের গল্প : তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশিত:
৭ জুন ২০২০ ২০:৩৩
আপডেট:
১৬ জুন ২০২০ ২২:৪৪

মনের খুশিটা যেন মিলিয়ে গেছে নীলুর। ইদানীং তার রাগটা যেন কিছুতেই আর পড়ে না। সারাদিনে যখনি নিজের সাথে কথা বলে তখনি টের পায় ভেতরে একটা রাগ গজগজ করছে। মর্নিং ওয়াকের সময় সে সঙ্গে ছিল, এখনও ফিকে হয়নি সেটা। ঘড়িতে এখন সন্ধ্যে সাতটা।
ঠিকঠাক সময়ে অফিস থেকে বের হলে এতক্ষণ তার বাড়ীতে থাকার কথা। কিন্তু শেষ বেলায় একটা জরুরী কাজ মনে পড়ে গেল নীলুর বসের। একটা চিঠিটা না কি এক্ষুনি টাইপ না করলেই নয়। বসের পি এ মিস গোমস আছেন, তবু নীলুকে কাজ না করালে তার বসের যেন মনের সাধ মেটে না। আর তেনার সাধ মেটাতে গিয়ে নীলুর ঘণ্টা খানেক লেট হয়ে গেল।
অফিস থেকে বের হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে লাগল নীলু। ভেবে দেখল, আপাতত দুটো শয়তানকে আচ্ছা করে সাইজ করতে পারলে তার মনের রাগ কিছুটা অন্ততঃ মেটে। প্রথম শয়তান হল মিস্টার পি ঝুনঝুনওয়ালা। তার বস। একটা রোবটের মত মানুষ। হাসি নেই খুশি নেই। শালা প্রফিট ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না জীবনে। সারাদিন ধরে নানা কাজের বোঝা সে চাপিয়ে যাচ্ছে নীলুর ওপর। এদিকে তিন বছর ধরে মাইনে বাড়ানোর নামগন্ধটি পর্যন্ত নেই। মাইনে বাড়ানোর দাবী শুনলেই হুমকি দেয় ছাটাইয়ের। গোটা দশেক রামগাট্টা মেরে এই শয়তানের গুরুমস্তিষ্কে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে ইচ্ছে করছে নীলুর।
গুঁতো দিতে হবে হারাধনবাবুকেও। এনার বাড়ীর নীচের তলায় মাসিক ২০০০ টাকার ভাড়াটিয়া সে। দশ বাই বারোর ঘর, এটাচড টয়লেট। ভাড়া হিসেবে ২০০০ ড্যাম চিপ। এককথায় রাজী হয়ে কড়কড়ে ছ হাজার টাকা নীলু গুনে দিয়েছিল তার হাতে। পোশাকে ধুতি পাঞ্জাবী, গোলগাল চেহারা, বিনয়ী ভদ্র ব্যবহার। প্রথম দর্শনেই তাকে যেন ভগবান মনে হয়েছিল নীলুর। আসলে কম ভাড়ার একটা ঘরের খোঁজে শহর কলকাতার অলিতে গলিতে হন্যে হয়ে ঘুরেছে নীলু। তিনের নীচে কেউ নামতে চায়নি। হারাধনবাবুই একমাত্র মানুষ যিনি দু হাজারে রাজী হয়েছেন। সেই মানুষের ভেতর যে এত ধড়িবাজী ছিল তা কল্পনাও করতে পারেনি নীলু। হারাধনের পিছনে বেশ কয়েকটা কষাতে ইচ্ছে হল নীলুর।
প্রথম রাতেই ঘরের আসল গল্প টের পেয়েছিল নীলু। তখন মাঝরাত। ঘরের আলো জ্বালিয়ে রেখে ঘুমানো নীলুর ছোট বয়সের অভ্যাস। খুটখাট ঠুকঠাক আওয়াজ টের পাচ্ছিল নীলু। প্রথমে ভেবেছিল হয়ত ইদুর বা ছুঁচোর কীর্তি। আওয়াজ বেড়ে উঠতেই সেও আওয়াজ ছেড়েছিল, "কে রে?
- "আমি মদন"
চমকে উঠেছিল নীলু। বন্ধ ঘরে এ আবার কোন মদন এল? সাহস বজায় রেখে সে জিগ্যেস করল, "মদন কে?"
- আমি হারাধনের বাড়ীর চাকর। এই ঘরে থাকতুম। দেহ রেখেছিলাম এখানেই।
নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না নীলুর। অশরীরীর আওয়াজ! তবে আওয়াজটা তেমন ভীতিপ্রদ নয়। বরং এতটাই মহিলাসুলভ যে ভয় না পেয়ে বেশ মজাই পেল নীলু।
নীলু বলল, "তা মাঝরাতে কি মনে করে মদনবাবু?"
- না, মানে বলছিলাম কি, যত তাড়াতড়ি পারেন বাড়ীটা ছেড়ে চলে যান, মানুষের সাথে আমার তেমন পোষায় না।
- বাড়ী ছাড়ার হুমকি দিচ্ছেন নাকি?
- না হুমকি নয়, মানে এই বলছিলাম আর কি।
এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল নীলু। - মাঝরাতে মামাবাড়ির আব্দার পেয়েছেন না? আপনার মালিক যখন তিনমাসের কড়কড়ে আগাম নিল, তখন কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন নাকি?
- এই আপনি সর্ষের কথা বলছেন কেন ভাই? জানেন তো সর্ষেতে আমাদের সমস্যা।
নীলুর ইচ্ছে করছিল তার মাস্টারমশাই গৌরবাবুর কায়দায় মদনার কানটা কষকষিয়ে মলে দিতে। কিন্তু সে ইচ্ছে তো আর মেটার নয়। তাই মনের ইচ্ছে মনে রেখে সে গলা চড়িয়ে বলল, মাঝরাতে আমার ঘুম তাড়িয়ে নিজে স্বস্তি খুজছেন না? কঠিন মাল তো মশাই আপনি। শুনুন, মানে মানে কেটে পড়ুন, নয়ত আপনার ভাগ্যে ঐ সরষে পোড়াই নাচছে।
- সরষে পোড়া দেবেন না প্লিজ! আমার কথাটা একবার ভাবুন! কোথায় যাব বলুন তো? থাকার জায়গার যে বড় অভাব। চারপাশের গাছপালা যা ছিল সব তো সাফ হয়ে গেছে। পোড়ো বাড়ীগুলো অবধি গেছে প্রোমোটারের দখলে।
- জাহান্নমে যান আপনি, আর একটা কথাও বলবেন না, আমার মেজাজ গরম হলে কিন্তু আপনার কপালে দুঃখ আছে।
মদনের বকবকানি বন্ধ হল সে রাতের মত। কিন্তু সে আদৌ ঘর ছেড়েছে কি ছাড়েনি তা আদৌ স্পষ্ট হলনা নীলুর কাছে। একটা অস্বস্তি সত্ত্বেও ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলু।
সাতসকালে খোঁজ নিতে এসেছিলেন হারাধন বাবু। বললেন, "কি ব্যাপার, কাল সারারাত আলো জ্বলছিল আপনার ঘরে। ভয়টয় পাননি তো?
নীলু মনে মনে বলেছিল, "ন্যাকা চন্ডী, ঘরে ভূত পুষে রেখে সাধুপনা দেখানো হচ্ছে।" মুখে বলেছিল অন্য কথা - ভয়? আমার? শুনুন মশাই ওসব ভয়-ভীতির চ্যাপ্টার আমার জীবনে নেই। আলো জ্বালিয়েছিলাম পড়াশোনার জন্য।
সপ্তাহখানেক কাটতে না কাটতেই রাতে আলো জ্বালানো, অতিরিক্ত জলের ব্যবহার ইত্যাদি প্রভৃতি ইস্যুতে পেছনে লাগা শুরু করলেন হারাধন বাবু। বললেন, এই নামমাত্র ভাড়ায় এত পরিসেবা তো দেওয়া যাবে না ভাই। ভাড়া সাড়ে তিন করতে হবে, নয়ত ঘর ছাড়তে হবে।"
হারাধনের আসল রূপ দেখতে পেয়ে নীলু সামলাতে পারেনি নিজেকে। রাগের চোটে মেজাজ চড়িয়ে সেও শুনিয়েছিল দুচার কথা। বলেছিল, " সাড়ে তিন তো দূরের কথা। সাড়ে তিন পয়সাও বাড়াব না। আর বাড়ীও ছাড়ব না। তাতে যদি থানায় যেতে হয় যাব।"
তর্কাতর্কির ফল বিশেষ সুবিধের হয়নি নীলুর পক্ষে। হারাধনবাবুর হাত যে কতটা লম্বা তা টের পেল নীলু।
প্রথমেই এলেন লোক্যাল কাউন্সিলর শশধর দত্ত। চশমার ঝলক লাগিয়ে বললেন, "এই যে ভায়া, এসব কি শুনছি? অ্যাঁ? হারাধনবাবুর মত সজ্জন লোকের সাথে তুমি নাকি টকঝাল চালাচ্ছ? আবার নাকি থানায় যাবে বলেছ? তা থানায় নয় যাবে, কিন্তু থানার খোঁজখবর আদৌ কিছু রাখো ? শুনে রাখো ভায়া, এ এলাকার থানার দরজা জানলা পর্যন্ত আমাদের কথায় খোলা বন্ধ হয়। কাজেই বেশি চালাক হতে যেয়ো না। হয় ওনার কথা মেনে নাও, নয়ত পাড়া ছেড়ে কেটে পড়ো।"
শশধরের সাথে মুখ লাগায়নি নীলু। কিন্তু তার একটা কথাও মানেনি সে। চলতে লাগল নিজের মত করে। ফলস্বরূপ আরও এক আপদের হুমকির মুখে পড়তে হল তাকে।
গত রবিবার সাতসকালে বাড়ী বয়ে হুমকি দিয়ে গেল এলাকার গুন্ডা পেটো কালু। বলে গেল, "বেশি চালাকি চলবে না চাঁদু। জানের মায়া থাকলে চুপচাপ কেটে পড়ো। নয়ত কখন টপকে দেব টেরটিও পাবে না"
পুরনো কথার জাবর কাটতে কাটতে নীলু চলে এল পাড়ার কাছাকাছি। সমস্যা তার একটাই। নতুন আর একটা বাসা ভাড়া নেওয়ার মত রেস্ত নেই তার। তিন বছর ধরে মাইনে থেমে আছে সাড়ে আট হাজারে। আর তাই রাগটা বাড়ছে। অফিসের বসের ওপর যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে হারাধনের ওপর। একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না সে।
মোড়ের মাথায় রেস্টুরেন্ট "চেখে দেখো"। সেখানে রাতের রুটি-তড়কা অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো নীলু। আর ঠিক তখনি নিজের নাম ধরে পিছন থেকে ডাক শুনল সে। তাকিয়ে দেখল হারাধনবাবুর মেয়ে হাসিহাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে। বাড়ীর দোতলা থেকে মাঝে মাঝে একে উকিঝুকি দিতে দেখেছে নীলু, কিন্তু পরিচয় হয়ে ওঠেনি।
"এ আবার হাসে কেন? নিশ্চয়ই কিছু মতলব আছে মনে।" মনে মনে বলে উঠল নীলু।
নীলুর কাছাকাছি এসে মেয়েটি বলল, "অফিস থেকে ফিরছেন?" নীলু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে সে বলল, "আপনার সাথে কয়েকটা কথা ছিল, এখন কি সময় হবে আপনার?"
"আপাততঃ বাসায় ফেরা ছাড়া অন্য কোনও কাজ হাতে নেই, বলুন কি বলতে চান?"
- প্রথমেই আমার বাবার দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনার কাছে। আপনাকে যে হুমকি দেওয়া হয়েছে - তা আমি জানি। সত্যিই কি যে লজ্জা পেয়েছি, কি বলব! একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে - আমাদের ঘর টা যে ভূতুড়ে - তা কি জানতে পেরেছেন?"
- সেটা তো প্রথম রাতেই জেনেছি। তবে ভূতটা, মানে মদনবাবু, বিশেষ ঝামেলা করছে না। প্রথম রাতে বকুনি খেয়ে সে থেমে গেছে। কিন্তু আপনার বাবাকে তো থামাতে পারছি না।"
- থামাবেন কি করে, বাবার যে সীমাহীন লোভ। বাবা চায় ঐ ঘরে এক রাত্রি থেকেই ভূতের ভয় পেয়ে ভাড়াটে কেটে পড়ুক। আর বারবার এডভান্সের টাকা জমে উঠুক বাবার পকেটে। আপনি হয়ত জানেন না, বেশ কয়েকজন চব্বিশ ঘণ্টাও টিকতে পারেনি ও ঘরে। চুক্তির কাগজ দেখিয়ে বাবা এডভান্সের একটা টাকাও ফেরত দেয়নি তাদের। তবে আপনার সাহসকে ধন্যবাদ। বাবা ভাবেননি যে কেউ এ ঘরে টিকে যেতে পারে। তাই পেছনে লেগেছে। যেন-তেন-প্রকারেন তাড়াবে আপনাকে - এই হল প্ল্যান।
কথা গুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটা শুভেচ্ছা মিশে আছে - তা টের পেল নীলু। সে বলল, " আসলে সত্যিটা কি জানেন, বেশি ভাড়ার ঘর খুঁজে যে চলে যাব, তেমন উপায়টাও আমার নেই, তাই লেগে আছি।
- লেগে থাকুন, একদম ঘর ছাড়বেন না। তারপর যদি থানা পুলিশ হয়, তো আমি আপনার হয়ে সাক্ষ্য দেব"
নীলু কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। কোনও এক অজানা জাদুতে তার বাক যেন রুদ্ধ হয়ে আছে।
মেয়েটি আবার শুরু করল, আসলে কি জানেন, একই বাড়ীতে থাকি তো, একজন মানুষ ভূত আর গুন্ডার উপদ্রব সহ্য করে কি করে ঘরে আছেন - সেকথা ভেবে আমি নিজেই ঘুমোতে পারি না।"
সিগারেটে একটা টান দিয়ে নীলু বলল, "আমি কিন্তু দিব্যি ঘুমোই। মদনবাবু আর ডিস্টার্ব করে না। তবে আলোটা জ্বালিয়ে রাখি কেন জানেন - ওটা ছোটবেলা থেকে আমার অভ্যাস। অন্ধকার ঘরে আমি ঘুমোতে পারি না।
- আপনি আলো জ্বালিয়েই ঘুমোবেন। তারপর কে কি করে আমি দেখব। হাল ছাড়বেন না মোটে।
- ঠিক আছে তাই হবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
- ধন্যবাদ দেওয়ার মত কিছুই করিনি। সত্যিকারের তেমন কিছু করলে তখন দেবেন। আজ তাহলে আসি। পরে কথা হবে।
চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ সুন্দর করে হাসল মেয়েটি। একটি গজদাঁতের জন্য হাসিটা আরও সুন্দর হয়েছে। নীলু তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, " কি বাপের কি মেয়ে। ঠিক যেন দৈত্যকুলে লেডি প্রহ্লাদ।"
রাতের খাবার রুটি তড়কা নিয়ে টাকা পয়সা মিটিয়ে বাড়ীর পথ ধরল নীলু।
বাড়ী ফিরে সাত পাঁচ ভাবনা পেয়ে বসল নীলুকে। মনের মধ্যে বারে বারেই হানা দিচ্ছে হারাধনবাবুর মেয়ের কথাগুলো। তবু একটা সন্দেহকে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছে না নীলু - যেমনটা বলে গেল সবটাই সত্যি তো, নাকি নতুন কোনও জাল বিছানোর কৌশল?
রাতে খাওয়ার পরে আবার চিন্তায় ডুব দিল নীলু। কি করে রাত বাড়ল টের পেল না সে। হঠাৎ তার মনে পড়ল মদনবাবুর কথা। প্রথম দিনের পর তার সাথে আর বাক্যালাপ হয়নি। নীলু বলে উঠল "মদনবাবু কাছাকাছি আছেন নাকি?"
উত্তর এল সঙ্গে সঙ্গেই, "কোথায় আর যাবো বাবু। যাবার জায়গা নেই বলেই তো এ ঘরে থাকা। আপনি তো আমায় জাহান্নমে যেতে বললেন"
- ও তো সব কথার কথা। রাগের মাথায় বলেছি। কিন্তু আপনিই বা আমাকে তাড়াতে চাইছিলেন কেন?
- সে কি আর সাধে বাবু? সবই মনিবের ঠ্যালায়। আমার মনিবটি যে কত বড় ঘুঘু তা আপনি জানেন না বাবু। যখন বেঁচে ছিলুম তখন খাটিয়ে খাটিয়ে আমার হাড়-মাস এক করেছে। আর এখন চায় কোনও ভাড়াটেই যেন এক রাতের বেশি এখানে না টেকে। আমায় বলে রেখেছে, এই ঘরে থাকবি, ভাড়াটেকে দিনরাত জ্বালাতন করবি। ভাড়াটে যদি টিকে যায় তাহলে সবার আগে গুনীন ডেকে তোকে ঘরছাড়া করবো।
- আপনার মালিক তো তাহলে বেশ গোলমেলে মানুষ। এমন লোকের কাজ ছেড়ে পালালেও তো পারতেন নাকি?
- চেয়েছিলুম বাবু, পারিনি। একবার বৌয়ের অসুখের সময় বেশ কিছু ধারকর্জ নিয়েছিলুম। বৌকেও বাঁচাতে পারলুম না। আর নিজেও জড়ালুম ঋণের জালে। ঋণ শোধ দিতে সারাদিন বেগার দিতুম।"
মদনের কথা শুনতে শুনতে নিজের বসের মুখটা মনে পড়ছিল নীলুর। সে বলল, " মালিক জাতটাই এইরকম মদনবাবু। ও নিয়ে আর দুঃখ করবেন না।"
মদন বলল, "তবে মিথ্যে বলব না, মালিক খারাপ হলেও গিন্নীমা বেশ ভালো। আর মালিকের মেয়ে খুশী দিদিমণি পেয়েছে মায়ের ধাত। কি যে ভালো ব্যবহার কি বলবো!"
নীলু বলল, "তাই নাকি? তা খুশি দিদিমণির ঘরে তো রাত অবধি আলো জ্বলে দেখি। রাত জেগে কি করেন দিদিমণি"
- তা তো জানিনা বাবু। কলেজ পাশ দিয়েছে তা জানি। হয়ত পড়াশোনা করেন।
- একটু খোঁজ নিয়ে দেখলেই তো পারেন। আপনার তো আবার ইচ্ছেডানা। চাইলেই তো যাওয়া যায় নাকি।
- তা যা বলেছেন বাবু। আমার ইচ্ছেডানা। দিদিমনির খবর এক্ষুনি জানাচ্ছি আপনাকে।
মদন বাবু আছেন না গেছেন - বোঝার উপায় নেই। কোনও এক ভেতরের তাড়নায় একটা সিগারেট ধরাল নীলু। মনে তার কিসের কৌতূহল তা সে নিজেই জানে না। কয়েক টানেই হাফ হয়ে গেল সিগারেটটা। হঠাৎ একটা কাশির আওয়াজে ঘোর কাটল নীলুর। সে বলল, "কে মদনবাবু নাকি?"
- হ্যাঁ বাবু। দেখে এলাম, দিদিমণি জেগে আছেন।
- এমনি এমনি জেগে আছেন?
- না বাবু ছবি আঁকছেন।
- কি ছবি মদনবাবু?
মদন চুপচাপ। কোনও উত্তর নেই।
নীলু জিগ্যেস করল, " ও মদনবাবু, কিসের ছবি আঁকছেন দিদিমণি?"
- বলতে লজ্জা করছে বাবু।
- লজ্জার কি আছে, বলুন না?
- বাবু দেখলুম, দিদিমণি কি সুন্দর একটা ছবি এঁকেছে আপনার। পিঠে ব্যাগ, হাতে সিগারেট। আপনাকে খুশি দিদিমণি কি চেনেন বাবু?
এবার নীলুর লজ্জা পাওয়ার পালা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, "হয়তো দেখেছেন। একই বাড়ীতে থাকি তো।"
মদনবাবুর কাছে অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে নীলুর। কিন্তু লজ্জায় মুখ থেকে বেরোচ্ছে না কিছু। চিন্তা তার একটাই, আড়ালে থেকে মদনবাবু হয়ত তার ভেতরের উথাল পাথাল পড়ে ফেলছেন! অনেক চেষ্টায় একটা কথাই বের হল তার মুখ দিয়ে "আচ্ছা, তাহলে এবার আপনি বিশ্রাম করুন মদনবাবু"।
আজ প্রথমবার আলোটা নিভিয়ে শুতে গেল নীলু। ভয় তার একটাই, মদনবাবু হয়ত পড়ে ফেলবে তার চিন্তা। বিছানায় এল বটে, তবে ঘুম এল না নীলুর। ঘুম কি করেই বা আসে? বেশ কিছুদিন আগে গীটার শিখত নীলু। এখন সেই গীটারটা আবার বাজাতে ইচ্ছে করছে তার। বার বার মনে পড়ছে সেই হাসিটার কথা। গজদাঁত হাসিকে এত সুন্দর করে জানা ছিল না নীলুর। এই হাসির কথা ভাবতে ভাবতেই হয়ত আজ ভোর নামবে আকাশে। মনের গজগজে রাগটা কখন যে মিলিয়ে গেছে টের পায়নি নীলু। মনটা হঠাৎ করেই যেন বেশ খুশি খুশি।
তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা
বিষয়: তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: