সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

একা এবং একা (পর্ব ৬) : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২০ ২৩:৩২

আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:১০

 

ছয়

খুব কাছ থেকে পর পর দুটো গুলির শব্দ হল!

মারুফ আশ্চর্য হয়ে দেখে সশব্দে মুখ থুবরে পড়ল দলপতি, নৌকার পাটাতনে। আর তখনই  একটা লম্বা  ছিপ নৌকা থেকে লাফিয়ে উঠে এল কেউ একজন তাদের নৌকায়,  তার হাতে পিস্তল। পিস্তলটা চিনতে পারল মারুফ। স্কুলের ক্লাশ রুমে কুড়িয়ে পাওয়া সেই পিস্তল। জার্মানির তৈরী কোল্ট থার্টি টু। এসব বিষয়ে মারুফের আগ্রহ আছে।

- স্যার, আমি মবিন

মারুফের যেন অবাক হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে! বলল-

- তুমি এখানে কিভাবে?  মবিন তখন পিস্তল তাক করে আছে নৌকা ধরে থাকা সেই লোকটার দিকে।  খুব সম্ভব তার নাম রাজীব, সে কোন রকমে সাঁতরে এসে নৌকাটা ধরেছে উঠবে বলে, তখনই এই কান্ড; উল্টে গেছে দাবার ছক, দাবার বোর্ড সহ! তৃতীয় লোকটা নৌকার মাঝি, সে স্যালো নৌকার ইঞ্জিনের লিভারটা ধরে আছে,  তখনও বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করনীয়।  রাজীব লোকটা অবশ্য দেরী করলো না সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দিয়ে ডুব দিয়েছে, নদীর ঘোলা পানিতে।

- স্যার এরে কি করুম? মবিন এবার পিস্তল তাক করে আছে মাঝির দিকে। মাঝি থির থির করে কাঁপছে। মবিনের সঙ্গে আসা লম্বা লোকটা ততক্ষনে মারুফ আর মেয়েটার হাত-পা’র নাইলনের দড়ি কেটে দিয়েছে। মৃত দলপতির হাতের পিস্তলটা সে তার লুঙ্গির পিছনে গুজে ফেলেছে ইতোমধ্যে। লোকটা আর কেউ না মবিনের সেই শাহজাহান চাচা। তাকে এখন দেখে আর মনে হচ্ছে না সে নিরিহ মুখে স্কুলের গেটে সিঙ্গারা, সামুচা বা চপ ভাজতে পারে! 

- স্যার, এগো কি করুম? দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করে মবিন

- এদের দুজনের পেট ফাইড়া চুনা দাও, তারপর সেলাই  করে ... নদীতে ফেলে দাও, পাটাতনের নিচে চুনের ড্রাম আছে। মারুফ অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকায়। বেঁচে থাকার আনন্দে তার মুখটা ঝলমল করছে। সেই কথাটা বলেছে, হাসি হাসি মুখেই বলেছে। মারুফও হেসে ফেলে তার কথা বলার ভঙ্গিতে। হাসি খুবই সংক্রামক একটা জিনিষ। মবিন আর তার শাহজাহান চাচাও হাসতে থাকে। শুধু নৌকার মাঝি বুঝে উঠতে পারছে না আদৌ তার হাসা উচিৎ কিনা। তবে হাসা না হাসার এই দ্বিধা দন্দের মাঝখানে, সে হঠাৎ ঝাপ দিল নদীতে।

 

হাসা উচিৎ কিনা ইংরেজীর শিক্ষক রফিক স্যারও ঠিক বুঝতে পারছেন না। হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিবেন নাকি মেয়েটাকে দু কথা শুনাবেন, একজন শিক্ষক হিসেবে সে অধিকার তার আছে।

আজকে রফিক স্যারের মুডটা বেশ ভাল ছিল। বাড়িওয়ালাকে বেশ এক হাত নেয়া গেছে। বাড়ীওয়ালা আজকেও গাদা বন্দুক নিয়ে বেড়িয়েছিল তখন তিনি ঠান্ডা গলায় বলেছেন ‘ আমি আপনার নামে এটেমট টু মার্ডার কেসের মামলা দিব আজ, তারপর দেখি আপনার গাদা বন্দুকের দৌড় কতদূর যায়! ’ বাড়ীওয়ালা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেভাবে ছুটে এসেছিল সেভাবেই ছুটে ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। রফিক স্যার ভাবলেন এটাকে কি বলে সেলফ ডিফেন্স? মারুফ স্যার থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত।

আজ ক্লাশ নাইনের মেয়েদের সেকশানে তার ইংরেজী গ্রামার ক্লাশ।  সেই সকালের ভাল মুডে ক্লাশে এসে ভাবলেন আজ পার্টস অফ স্পিচের কচকচানীতে না গিয়ে ‘কমন মিসটেক ইন ইংলিশ’ নিয়ে কথা বলবেন, বিষয়টা তার পছন্দের। তার আগে একটু ফান করা যাক-

-মেয়েরা বলতো ‘ডাক্তার আসার পর রোগী মারা গেল’ এর ইংরেজী কি?

সবাই হাউ মাউ করে উঠল ‘স্যার হয় নাই হয় নাই।’ রফিক স্যার মজা পেলেন। তিনি জানেন এমনটাই হবার কথা।   

- কি হয় নাই?

- স্যার ‘ডাক্তার আসিবার পুর্বে রোগী মারা গেল’ হবে

- না, তোমরা এখন বলবে ‘ডাক্তার আসার পর রোগী মারা গেল!’

- না স্যার এটা হবে না। বেশ শক্ত গলায় একটা মেয়ে বলল। তাকিয়ে দেখেন একটা নতুন মেয়ে। মনে হয় নতুন ভর্তি হয়েছে।

- কেন হবে না? ডাক্তার আসার পর রোগী মারা যায় না?

- না যায় না। রফিক স্যার হতভম্ব হয়ে গেলেন তার বলার ভঙ্গিতে। এই সময় আশ পাশ থেকে অন্য মেয়েরা বলল ‘স্যার ও বদরুদ্দিন ডাক্তারের মেয়ে’ তখন রফিক স্যার বুঝলেন প্রভাবশালী এই ডাক্তারের মেয়ে হওয়ায় তার ইগোতে লেগেছে। রফিক স্যারের ভ্রু কুচকে গেল। একবার ভাবলেন হেসে উঠে ব্যাপারটা এখানে শেষ করে দিবেন। কিন্তু কেন?

- এই মেয়ে তোমার নাম কি?

- নাজিয়া, নাজিয়া আক্তার।

রফিক স্যার কড়া গলায় বললেন,

- এই মেয়ে তুমিতো দেখছি বেয়াদপ ... এই সময় ক্লাশের দরজায় ভারপ্রাপ্ত হেডস্যারকে দেখা গেল।

- রফিক স্যার, একটু বাইরে আসুন। 

 

রফিক স্যার মন খারাপ করে টিচার্স রুমে বসে আছেন। মজিদ স্যার বদরুদ্দীন ডাক্তারের মেয়ের সঙ্গে তার এই আচরণ পছন্দ করেন নি। তাই ডেকে বাইরে নিয়ে এসেছেন। তিনি তখন ঐ ক্লাশের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন।

- স্যার কিছু মনে করবেন না, আমাদের স্কুলটা এখন দাড়াচ্ছে এই সময় কারো সাথে কোনো কনফ্রনটেশনে যায়েন না।

- কি বলছেন মেয়েটা কি বলল আপনি জানেন?

- বাদ দেন, চা খান।

 

রফিক স্যার মাথা নিচু করে বসে রইলেন হেড স্যারের রুমে। চা ঠান্ডা হতে লাগলো।

- আমি কিছুই বলতে পারব না?

- না, সব জায়গায় সবাইকে সব কিছু বলা যায় না

 

ব্যাপারটা এখানে শেষ হলেই ভাল হত। কিন্তু শেষ হল না। একদিন এই মফস্বল শহরের সবচে বড় এবং প্রভাবশালী ডাঃ বদরুদ্দীন দুজন স্কুল মেম্বার আর মেয়র সাহেবকে নিয়ে স্কুলে এলেন। ভারপ্রাপ্ত হেডস্যারের সঙ্গে মিটিং করলেন ঘন্টা খানেক। চা সিঙ্গারা খেয়ে বিদেয় হলেন। কেউ জানলো না কি প্রসঙ্গে মিটিং। তবে তার ক’দিন পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষন মজিদ স্যার রফিক স্যারকে ডেকে পাঠালেন। সময়টা স্কুল ছুটির পর পর।

- রফিক স্যার?

- জি বলেন

- ইয়ে আপনার বিরুদ্ধে একটা খারাপ অভিযোগ আসছে। ভ্রু কুচকে গেল রফিক স্যারের!

- মানে? কে করল? কি অভিযোগ?

- বড় ক্লাশের দুটা মেয়ে লিখিত অভিযোগ করছে আপনার বিরুদ্ধে!

- কি অভিযোগ?

- বাদ দেন, খারাপ অভিযোগ। বুঝেনতো আজকাল মেয়েরা অভিযোগ করলে বিপদ। আমি বলি কি আপনি মান সন্মান নিয়ে অবসর নেন। এই যে এখানে সই করেন আর এইযে আপনার বকেয়া বেতন এই খামে আছে। রফিক স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন!

- কি বলছেন এসব?

- ভাই নতুন স্কুল কমিটির কাছে আমার হাত-পা বাঁধা। ব্যাপারটা গার্জেন লেভেলে চলে গেছে।

- আমি অভিযোগটা দেখতে চাই

- সম্ভব না, এটা এখন স্কুলের গভর্নিং বডির হাতে। পানি এখন অনেক ঘোলা হয়ে গেছেরে ভাই

- আমি মামলা করব

- সেটা করেন কোর্টে যান। কিন্তু এখন এখানে সই করেন। খামটা রাখেন

- অসম্ভব!

- ভাইরে মামলা মোকদ্দমায় ভাল কিছু হবে না স্কুলের বদনাম হয়ে যাবে, আপনার বদনামও ছড়িয়ে পড়বে, অন্য কোনো স্কুলে আর ঢুকতে পারবেন না। বলে তিনি ব্যস্ত হয়ে ফাইলপত্র দেখতে লাগলেন গভীর মনোযোগ নিয়ে।

 

রফিক  স্যার স্কুল থেকে বের হয়ে উদভ্রান্তের মত শহরের ভিতর ঘুরলেন কিছুক্ষন। একটা টংয়ের দোকানে বসে পর পর দু কাপ চা খেলেন। তারপর রাস্তা পার হয়ে এসে উল্টোদিকের ভাঙা কালভার্টের উপর বসে থাকলেন। বসে থেকে দেখলেন সরযু বিদ্যানিকেতনের কুদ্দুস হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে। রফিক স্যারকে দেখে থমকে দাড়াল সে।

- স্যার আপনে এইখানে?

- হু

- বাসায় যাইবেন না?

- যাব।

- স্যারের কি শরীর খারাপ? রফিক স্যার কথা বললেন না।

- স্যার চা খাইবেন? চা আনি এক কাপ?

- চা না একটা সিগারেট আন।

- কি সিগারেট?

- তুমি যেইটা খাও, সেইটা আন, জ্বালায় আন

- স্যার আমিতো সিগারেট খাই না।

- খাও না? তাইলে যাও। কুদ্দুস কি ভাবল। রাস্তা পার হয়ে একটা দামী সিগারেট কিনল। একটা দিয়াশলাইও কিনল।  তারপর রাস্তা পার হয়ে এসে স্যারকে দিল। রফিক স্যার সিগারেট খান না। কিন্তু তিনি সিগারেট ধরালেন। তার মনে পড়ছে তার ছোট চাচা মার্ডার কেসের আসামী, ফাঁসি হয়েছিল।  যেদিন ফাঁসি হয় সেদিন তার শেষ ইচ্ছে কি জানতে চাইলে নাকি তিনি সিগারেট খেতে চান। তিনি আসলে কখনো সিগারেট খেতেন না।

- স্যার আমি তাহলে আসি

- আস

- স্যার আপনেরে বাসায় আউগায়া দেই?

- না তুমি যাও 

 

রফিক সাহেব অনেক রাতে বাসায় ফিরলেন জ্বর নিয়ে, খামটা স্ত্রীর হাতে দিলেন। স্ত্রী মরিয়ম বেশ  অবাক হলেন।

- এত রাত কোথায় ছিলে? এটা কিসের টাকা?

- আমার বেতন

- এখন বেতন কেন?

- দিল, কি করব। আমাকে আর স্কুলে যেতে হবে না।

- মানে কি বলছ এসব?

- মরিয়ম, আমার চাকরী নাই। এই যে আমার পদত্যাগপত্র। ওরা আমাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছে।

- কেন তুমি কি করেছ ?

- বড় ক্লাশের দুইটা মেয়ে নাকি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে

- কি অভিযোগ?   

- আমি জানি না, মজিদ স্যার বলল খারাপ অভিযোগ। তিনি শার্ট খুলে খালি গায়ে আবার বের হলেন। পেছন থেকে স্ত্রী চেচালেন ‘কোথায় যাচ্ছ এখন?’

রফিক স্যার উত্তর দিলেন না।

- মেয়েদের অভিযোগ কি সত্যি?  রফিক স্যার এবারও উত্তর না দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন; বাড়ীওলার দরজায় নক করলেন জোড়ে জোড়ে। বাড়ীওলা দরজা খুলে অবাক! খালি গায়ের সরযুবালা স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক রফিকুদ্দীন আকন্দ বিএ বিটি দাড়িয়ে আছেন। চোখদুটো বেশ লাল!

- কি ব্যাপার? ভ্রু কুচকে গেল বাড়ীওলা মোতাব্বির সাহেবের।

- আপনার দোনলা বন্দুকাটায় কি গুলি ভরা আছে?

- আছে কেন?

- ওটা একটু দেন তো... আমার একটু কাজ আছে...

বাড়ীওলা আলহাজ্জ মোতাব্বির হোসেন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন রফিক স্যারের দিকে। লোকটা কি বলছে!

 

(চলবে)


একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top