সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

রাবেয়া খাতুন: ঢাকার প্রান্তিক জীবনের অনন্য রূপকার : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৪ জানুয়ারী ২০২১ ২২:৫১

আপডেট:
৫ জানুয়ারী ২০২১ ০০:০২

ছবিঃ কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন

 

রাবেয়া খাতুনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়ি পাউসন্নে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে। বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে আর দাদা ছিলেন শখের কবিরাজ। রাবেয়া খাতুনের জন্ম নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে- রাবেয়ার জন্মের সংবাদ শুনে তাঁর বাবা একসঙ্গে খুশি হয়েছিলেন, আবার দুঃখও পেয়েছিলেন। রাবেয়া যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর বাবা ছিলেন রাবেয়ার নানা বাড়িতে। সেকালে জামাইরা পিঠে খাবার দাওয়াত পেতেন শ্বশুরবাড়ি থেকে।  বেশ ঘটা করে খাওয়ানো হতো জামাইকে। বাবা আমন্ত্রিত হয়ে অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে খুশি মনে দাওয়াত খেতে গেলেন। বাবা গেলেন বৃহস্পতিবার আর রাবেয়া খাতুন জন্ম নিলেন শুক্রবার সকালে। তাই তাঁর বাবার আর থাকা হলো না। শ্বশুরবাড়ির নানারকম পিঠে-পুলি এবং আরও মজার মজার খাবার ছেড়ে চলে এলেন তিনি। রাবেয়া খাতুনের জন্মের খবর শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন ঠিকই তবে শ্বশুরবাড়ির খাবার-দাবার ছেড়ে চলে আসতে হবে ভেবে মনও খারাপ হয়েছিল তাঁর। সেই সময় কন্যাসন্তান জন্মালে পরিবারের লোকজন খুশি হতো না। কিন্তু রাবেয়া জন্মের খবর শুনে তাঁর পরিবারের লোকজন খুব খুশি হয়েছিলেন।

পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজার ও অন্যান্য শহরে কেটেছে তাঁর শৈশব। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। কবিরাজ দাদা তাঁকে প্রতীমা দেখার জন্য নৌকা করে নিয়ে যেতেন। ৷ ষোলঘর থেকে শ্রীনগর  খুব দূরে নয়। কিন্তু  যাতায়াত ছিল  কষ্টের। কচুরিপানায় ভরা থাকত নৌকা চলার পথ। এই পানা ঠেলে প্রতিমা দেখতে যাওয়া ছিল খুব কষ্টকর। কাকাদেরা প্রাণ নাকি বেরিয়ে যাবার উপক্রম হতো। তাঁর হাফিজ উদ্দিন আহমদ, মাস্টার কাকা খুব গাঁইগুঁই করতেন বৈঠা টানতে।  কিন্তু তিনি রাবেয়ার বাবাকে কিছু বলতে পারতেন না। কাকাদের যতই  কষ্ট  হোক রাবেয়ার খুব মজা লাগত।  হ্যাজাক বাতিতে রাতকে মনে হতো দিন। গান বাজনা হত। মিষ্টি,  মুড়কিভাজা  খাওয়া হত। রাবেয়ার দাদা ধুতির  প্রান্ত কিংবা আদ্দির পাঞ্জাবির পকেট থেকে দু পয়সা এক পয়সা করে তাঁকে হাতে দিতেন ইচ্ছেমত খরচ করার জন্য। নতুন ফ্রক, স্যান্ডেল পেতেন।  সে পয়সায় রাবেয়া খেলনা কিনতেন। পুতুল খেলার প্রতি রাবেয়ার খুব ঝোঁক ছিল। তিনি তাঁর পুতুলদের দিয়ে নার্স, ডাক্তার, হাসপাতাল সবই বানাতেন। তাঁর পুতুল খেলা তাই একটু ভিন্ন রকম ছিল। আরেকটা খেলা খেলতেন তিনি। সিনেমার বইয়ের ছবি কেটে কেটে গল্প বানাতেন। তাঁর খাতার ভেতরই এসব করতেন তিনি। এজন্য তাঁকে অনেক পরিশ্রম করতে হতো।

তাঁর বাবা ছিলেন মাছ ধরার ওস্তাদ। বাবার মৎস্য শিকারের সঙ্গে থাকতেন রাবেয়া। নৌকায় নাড়াচাড়া করে বকুনি খেতেন। বাবা বকা দিতেন ঠিকই কিন্তু মাছ ধরার সময় আবার তাঁকেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কারণ তিনি থাকলে নাকি মাছ ঘন ঘন টোপ গেলে।

তাঁর বয়স যখন পাঁচ- ছয় বছর তখন তাঁরা থাকতেন পুরানো ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন সর্দার লেনে। শোবার ঘরের ছিল একটা জানালা। জানালার বাইরে খানিকটা আকাশ দেখা যেত। আর সেই জানালার পাশে ছিল একটি বিশাল সজনে গাছ। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলেই তিনি দেখতেন, তাঁর বাবা জানালার ধারে নামাজের ভঙ্গিতে বসে ভায়রো রাগে গান গাইছেন। শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু এই ছবিটি সারাজীবন তাঁর স্মৃতির ভেতর প্রাণবন্ত হয়ে আছে। ছোটবেলায় গান শিখতেন রাবেয়া। কিন্তু নিয়মিত রেওয়াজ করতে পারতেন না। সেইসময় গানকে ভালো চোখে দেখা হতো না। তাঁদের বাসাটি ছিল মসজিদ লাগোয়া। তাই হারমোনিয়াম বাজানো ছিল নিষিদ্ধ। প্রায় দিনই খালি গলায় গাইতেন তিনি। যেদিন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতো সেদিন শুধু হারমোনিয়ামের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারতেন। কারণ বৃষ্টির শব্দে হারমোনিয়ামের আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যেত না। বৃষ্টির দিনে তাঁর বাবা বাজাতেন, তিনি আর তাঁর ছোট বোন সুফিয়া গাইতেন। গান খুব ভালবাসতেন তিনি।

পুরনো ঢাকায় তাঁরা থেকেছেন প্রায় ১০ বছর। এর মধ্যে তাঁর বাবা এ শহর সে শহর বদলি হয়েছেন।  বেশিরভাগ সময় তাঁদের কেটেছে ঢাকার বিভিন্ন ভাড়াটে বাসায়। তাঁদের আশপাশের অধিকাংশ লোকজনই ছিল আদিবাসী অর্থ্যাৎ ম‚ল ‘ঢাকাইয়া’। পরিবার থেকে প্রতিবেশীদের বাসায় যাওয়া তাঁদের জন্য নিষেধ ছিল। কিন্তু তিনি এসব নিষেধাজ্ঞার ভেতর দিয়েও সব বাসায় যেতেন। এ জন্য অনেক বকুনি শুনতে হতো তাঁকে।

রাবেয়া খাতুন আরমানিটোলা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (বর্তমানে মাধ্যমিক) পাস করেন ১৯৪৮ সালে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায়  বিদ্যালয়ের গন্ডির পর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়।

সেই সময়ে মুসলমান ছাত্রীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। মুসলমানদের সামাজিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুসলমান মেয়েরা লেখাপড়ায়  বেশিদূর এগোতে পারেনি। রাবেয়াও পারেননি।

শিক্ষকতা করেছেন তিনি। সাংবাদিকতা করেছেন- ইত্তেফাক, সিনেমা ও খাওয়াতীন পত্রিকায়। পঞ্চাশ দশকে তাঁর সম্পাদনায় ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা বের হতো । সাংবাদিকতায় আসা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাকারে রাবেয়া খাতুন বলেন-

‘আমি যখন সাংবাদিকতায় আসি তখন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। ফজলুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, জহির রায়হান ও আমি। তোমরা এখন যেমন সাক্ষাৎকার নিতে আসো, আমিও সে সময় সাক্ষাৎকার নিতে যেতাম লায়লা আরজুমান্দ বানু, আব্বাসউদ্দিনের, এখন তো সময় অনেক পরিবর্তন হয়েছে মেয়েরা ইচ্ছে করলেই আসতে পারছে। কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।’

 ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক এটিএম ফজলুল হকের সাথে রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয়। তাঁদের চার সন্তান:, ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী।

বিয়ে প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাবেয়া খাতুন বলেন-

‘জাহানারা ইমামের পত্রিকা খাওয়াতীন এ কাজ করতাম। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মহিলা পত্রিকা। জাহান আপার সঙ্গে প্রেস শো দেখতে গিয়ে দূর থেকে দেখেছি সম্পাদক ফজলুল হককে। বাসার পরিস্থিতি খুব খারাপ। বিয়ের কারণে আমার ওপর পরিবার রীতিমতো বিরক্ত। কোনো পাত্রই পছন্দ হয় না। আত্মীয় পরিজনরা হাসাহাসি করে, বলাবলি করে ও হবে এ দেশের বড় লেখিকা। আর ওর জন্য আকাশ থেকে আসবে রাজপুত্র। সত্যি এলো রাজপুত্র, তবে আকাশ থেকে নয়, জমিন থেকে ফজলুল হক আর কাইয়ুম চৌধুরী (এখন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী)। তখন জুটি হিসেবে সাইকেলে ঘোরাফেরা করে। প্রথমজন চালক আর দ্বিতীয়জন রডে বসা আরোহী। কাইয়ুম আমার বাড়ি চেনে। এক বিকেলে দু’জন এসে বাবার সঙ্গে আলাপ করে গেল। বাসা থেকে আমার ওপর এলো প্রবল চাপ। এরা কেনো এলো। আমি তো আসলেই কিছু জানি না। চিন্তাও করিনি এমন দুঃসাহস। জাহানারা ইমামের সঙ্গে প্রেস শো দেখতে গেছি প্রবোধ স্যান্নালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ মায়া সিনেমা হলে। এক ফাঁকে ফজলুল হক আমার সঙ্গে কথা বলতে এলো। প্রস্তাব রাখল আমি যদি রাজি থাকি তবে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে তার আত্মীয়স্বজন। টল, স্মার্ট, সুদর্শন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত যুবক। আপত্তি নেই জানিয়েছিলাম। দু’সপ্তাহের মধ্যে কাবিন হয়ে গেল। বাবা-কাকার মত ছিল না। চেনা জানা নেই, দূরদেশ (?) বগুড়ার ছেলে। কিন্তু ভীষণ খুশি হলো আমার মা। হকের বাড়িতে ওর বাবা ভাইবোন সবাই বেজায় খুশি। বেজার শুধু ওর মা কারণ তিনি স্থানীয় ধনী কন্যাকে ঠিক করে রেখেছিলেন। বায়ান্ন সালের তেইশে জুলাই আমাদের বিয়ে হয়। ঢাকার টিক্কাটুলীতে বাসা নেয়া হলো। আমার বয়স তখন উনিশ, রান্নাবান্নাও জানি না। অবশেষে বাবুর্চি এলো। দশটায় খেয়েদেয়ে দু’জনে অফিসে চলে যাই। কোর্ট হাউস স্ট্রিটের একটা বিশাল বাড়ির দোতলায় সিনেমা পত্রিকার অফিস। পত্রিকা চালায় ম‚লত তিনজন। ফজলুল হক, ওর ছোট ভাই ফজলুল করীম (এখন বিশ্ববিখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ) ও কাইয়ুম চৌধুরী। ওদের সাথে যুক্ত হলাম আমি। পরিচিত হতে লাগলাম উদীয়মান সাহিত্য প্রতিভাদের সঙ্গে। এক কথায় সাহিত্যাঙ্গনের স্বপ্নের মানুষদের সঙ্গে।’

রাবেয়া খাতুন ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন।  তাঁর লেখার হাতেখড়ি উপন্যাস দিয়ে। তাঁদের বাড়ির নিয়ম ছিল সপ্তাহে দু’টো বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমা দেখা। তাঁর উপন্যাসের কাহিনি তৈরি হতো সম্ভবত সেই বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমার কাহিনিকে কেন্দ্র করে। ভেতরে তাঁরই আঁকা ছবির ক্যাপশন থাকত। প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল নিরাশ্রয়া, পরে বিদায়, অশোক- রেবা এই ধরনের নাম। কিন্তু এই উপন্যাসগুলি কখনও গ্রন্থ আকারে বের হয়নি। ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের তলায় গল্পের বই লুকিয়ে রাখতেন তিনি। আর এটি দেখে তাঁর মা ভীষণ রেগে যেতেন। এছাড়া তিনি যখন গল্প লিখতে বসতেন তখনও তাঁর মা রেগে যেতেন খুব। কারণ সব মায়ের মতো তাঁরও স্বপ্ন ছিল মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হবে। সেসময় তাঁদের পড়াশুনা করানো হতো ম‚লত একটি ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্যই। কিন্তু তাঁর মা যেমনটি চাইতেন রাবেয়া ছিলেন ঠিক তাঁর উল্টো । পড়াশুনায় তিনি মোটেই ভাল ছিলেন না। কোন রকমে টেনেটুনে পরীক্ষায় পাশ করতেন তিনি। মা এজন্য দায়ী করতেন বাইরের বই পড়া ও গল্প লেখার নেশাকে।

 ১৯৪৮ সালে প‚র্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল সাপ্তাহিক ‘যুগের দাবী’তে ছাপা হয় ছোটগল্প ‘প্রশ্ন’। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘মধুমতী’। এরপর থেকে রাবেয়া লিখছেন অবিরাম। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- উপন্যাস : মধুমতী (১৯৬৩), অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৭), মন এক শ্বেত কপোতী (১৯৬৭), রাজবিনো শালিমার বাগ (১৯৬৯), সাহেব বাজার (১৯৬৯), ফেরারী স‚র্য (১৯৭৪), অনেক জনের একজন (১৯৭৫), জীবনের আর এক নাম (১৯৭৬), দিবস রজনী (১৯৮১), নীল নিশীথ (১৯৮৩), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪), মোহর আলী (১৯৮৫), হানিফের ঘোড়া ও নীল পাহাড়ের কাছাকাছি (১৯৮৫), সেই এক বসন্তে (১৯৮৬) ইত্যাদি। ছোটগল্প গ্রন্থ : আমার এগারটি গল্প (১৯৮৬), মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬), সুমন ও মিঠুর গল্প (১৯৭৮), লাল সবুজ পাথরের মানুষ (১৯৮১), তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা (১৯৮৪) ইত্যাদি। ‘একাত্তরের নয় মাস’ ও ‘স্বপ্নের শহর ঢাকা’ নামের দুটি স্মৃতিকথাম‚লক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। রাবেয়া খাতুন অনেক ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন, এগুলো হলো- হে বিদেশী ভোর, মোহময়ী ব্যাংকক, টেমস থেকে নায়েগ্রা, কুমারী মাটির দেশে, হিমালয় থেকে আরব সাগরে, কিছুদিনের কানাডা, চেন্নি ফোঁটার দিনে জাপানে, মমি উপত্যকা, ভ‚স্বর্গ সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি। তাঁর গবেষণাধর্মী লেখা- জীবন ও সাহিত্য, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, স্মৃতির জ্যোতির্ময় আলোকে যাদের দেখেছি। এছাড়া তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে বেশ কটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস মেঘের পর মেঘ অবলম্বনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র মেঘের পরে মেঘ। ২০১১ সালে তাঁর আরেকটি জনপ্রিয় উপন্যাস মধুমতি অবলম্বনে পরিচালক শাহজাহান চৌধুরী একই শিরোনামে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র মধুমতি। এছাড়াও অভিনেত্রী মৌসুমী ২০০৩ সালে তাঁর লেখা কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি অবলম্বনে একই শিরোনামে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি। এছাড়া তাঁর কাহিনি নিয়ে ১৯৬৪ সালে প‚র্ব পাকিস্তানে প্রথম কিশোর চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়। রেডিও ও টিভি থেকে প্রচারিত হয়েছে তাঁর রচিত অসংখ্য নাটক।

রাবেয়া খাতুন যে সময়ে লেখালেখি শুরু করেন, সেই সময়ে মুসলিম মহিলাদের শিক্ষার হার  ছিল খুব কম। একজন নারীর লেখক হিসেবে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো ছিল প্রায় অসম্ভব। জনাব ফজলুল হককে বিয়ে করার পেছনেও হয়ত ছিল তাঁর লেখক সত্তা। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন একজন লেখকের সংস্পর্শে আসলে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সহজ হবে।  এ প্রসঙ্গে তাঁর মতামত-

‘সামাজিক বাধাবিপত্তি অতীতে ছিলো, এখনো আছে। এ দেশের মহিলা সাহিত্যিকদের চলার পথ নানা কারণে দুর্গম। শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পীর অবদানের চেয়ে বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তিনি পুরুষ কি স্ত্রীলোক। বর্তমান সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের প্রকৃত নগ্ন চিত্র যদি উন্মোচিত হয় একজন পুরুষের হাত দিয়ে গর্বের সঙ্গে তখন জাহির করা হয় অভিজ্ঞতার সুফসল বলে। মহিলাদের ক্ষেত্রে তা দেখা হয় সম্প‚র্ণ ভিন্ন বিরূপদৃষ্টিতে।

 লেখালেখির ক্ষেত্রে পরিবার থেকে উৎসাহের বদলে পেয়েছি অবহেলা এবং সামাজিকভাবে চোখ রাঙানি। তখনকার বেশকটি পত্রিকায় নিয়মিত গল্প প্রকাশ হচ্ছিল। বিষয়টা বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে জানাজানি হলে তারা ইয়া লম্বা চিঠি পাঠালেন বাবার কাছে, যে লাইনগুলি এখনো ভুলিনি, আপনার পরিবারের একটি কন্যার হস্তাক্ষর বাইরের পর পুরুষেরা দেখিতেছে। উভয় খানদানের জন্য ইহা অত্যন্ত অসম্মান এবং লজ্জার ব্যাপার। বিষয়টির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাইতেছে-।’

রাবেয়া খাতুন তাঁর উপন্যাসগুলিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল। বিপুল, বহুমুখী তাঁর  রচনা।  ক্লান্তিহীন, নিরন্তর তিনি সৃষ্টি সাধনায় মগ্ন থেকেছেন।

রাবেয়া খাতুন লিখিত সাহেব বাজার উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, প্রকাশক- ওসমানিয়া বুক ডিপো।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ঢাকা শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর ভিত্তি করে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের চালচিত্র এই উপন্যাসটি। এদের কেউ ঘোড়াগাড়ির চালক, বাসাবাড়িতে কাজ করে খাওয়া শ্রমজীবী মহিলা, কেউ চোরাকারবারী। পড়াশুনা করার জন্য গ্রাম থেকে আসা বালকও আছে।

গ্রাম থেকে ঢাকা নগরে আসে পিতৃহীন ছেলে আলো। সে তার খালার কাছে থেকে পড়ালেখা করে। খালা অন্যের বাসায় কাজ করে সংসার চালায়। সৈয়দ আলী বয়সে বৃদ্ধ, ঘোড়া গাড়ির চালক ছিলেন। সালমা সৈয়দ আলীর মেয়ে। কাজেম সৈয়দ আলীর নাতী। সে চোরাকারবারী করে । এদের জীবন, জীবনের নানা সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত, দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও জীবনবোধের খণ্ড খণ্ড কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। প্রধান চরিত্র বা মুখ্য চরিত্র যাকে বলে তেমনটি এ উপন্যাসে নেই। অনেকগুলো

 চরিত্রের সাথে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে ঢাকার তৎকালীন পরিবেশ, মানুষের অবস্থা, সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা-সংঘাত ও বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস এই উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। এটি রোমাঞ্চভরা রোমান্টিক উপন্যাস নয়। কঠোর বাস্তবতায় ভরা জীবন সংগ্রামের ধ‚সর চিত্র । তাই এ উপন্যাস সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনচিত্র।

এ উপন্যাস যখন লেখক রচনা করেছেন, তখন  ঢাকা শহর এতটা আধুনিক হয়ে উঠেনি। শহরের সুযোগ-সুবিধেও তখন সেভাবে  ছিল না। ঢাকা শহরের চিত্র  লেখক এঁকেছেন এভাবে-

‘দু’ঘরের মাঝে যে দু-হাত জায়গা তা এক সঙ্গে উঠোন, বারান্দা, গোসলখানা- রাত্রি বেলার পেশাবখানারও কাজ করে। তাও আবার দু সংসার মানুষের। সংখ্যায় তারা যত কমই হোক, ভাবতেও অবাক লাগে আলোর। ঐ দুহাত জায়গার পরই দরজা। তার লাগালাগি আজেবাজে গাছে ভর্তি একটা জঙ্গল। ওপাশের খোলা বড় নর্দমার মুখ থেকে বিশ্রী বিকট গন্ধ আসছে। মিউনিসিপ্যালিটির দোষ নেই। ঢাকনী ছিলো এককালে। তার দু-এক টুকরো ভাঙ্গা অংশ এদিক ওদিক পড়ে আছে। বাকিগুলি উধাও। বাচ্চাদের পায়খানা করার ভয়ানক অসুবিধে তাহলে। এ পারে নর্দমা নেই কিন্তু ডাষ্টবিন আছে একটা। সেটার আগাগোড়া ভরাট রাজ্যের যত আবর্জনা দিয়ে। ছোট মাছি, রাঙামাছি, খোরমা মাছির নিশ্চিন্ত রাজ্য বিস্তার আর শাসনের তুমুল শব্দ সেখানে।’

দোলাইখালের বর্ণনা আছে উপন্যাসে -

 

‘ বোশেখের সেই অবিশ্রাম ধারাই যেন সেবারে বর্ষা ডেকে নিয়ে এলো তাড়াতাড়ি। দোলাইখালে পানি বাড়ছে। সারা বছর শুকিয়ে থাকা এক গাছি সুতোর মত দোলাইখালের শীর্ণ দেহ একটু একটু করে খোলা পানিতে ভরতে শুরু করে। ফুলে, ফেঁপে উপচে ওঠে এক সময়। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে এ খালের যোগ যে ‘কাজলা ঝুলির’ মধ্যে দিয়ে, সেই পথ দিয়ে পঞ্চাশ ষাট মণী চালানী নৌকা আসে এ সময়। গজারী, বাঁশ, আম-কাঁঠাল, মিষ্টি কুমড়ো, মেটে হাঁড়ি কলসীর নৌকোই আসে সাধারণত, আর আসে বেদে নৌকো।’

উপন্যাসে আছে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ চিত্র, দাঙ্গার বীভৎসতা। দাঙ্গায় সবকিছু হারানো মানুষের এক চিত্র আমরা পাই তাঁর বর্ণনায় -

‘পানির ট্যাঙ্কের কাছে সার্ট-প্যান্ট পরা একটি রক্তাক্ত কিশোরকে চোখে পড়লো। ধূলোর সঙ্গে লুটিয়ে আছে ছেলেটি, পারপাশে ছড়ানো খাতা, পেন্সিল বই। গীর্জার পেছনে বড় মানুষের লাশ একটা।’

কিংবা-

‘এ শহরে দাঙ্গার আগুন এই প্রথম জ্বলেনি। এই তো একচল্লিশ সালেও একবার তা ঘটে-মিটে গেল। আরও কতবার কত ক্ষুদ্র কারণকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে আগে। কিন্তু এবারের কারণ এ শহরের মানুষেরা নয়। সারা ভারতে যে রুদ্র তান্ডব নেচে নেচে বেড়াচ্ছে, তারই একটা হুল্কা নগরের দিক দিগন্ত ভরে তুলেছে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনীতে। মার মার কাট কাট সর্বগ্রাসী সারাক্ষণী আতঙ্ক একটা।’

উপন্যাসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনার বিবরণ ছাড়াও রাশিয়া, জার্মান ও হিটলারের কথা এসেছে, এভাবে-

‘ওদিকে আবার আক্রান্ত হয়েছে রাশিয়া। কিন্তু এবারে আর দৈবের সাহায্য নয় বলে বলিয়ান রুশ পরাক্রমের কাছে স্টালিনগ্রাদে সাংঘাতিকভাবে মার খেয়েছে জার্মানী। এদিকে জাপানের পার্ল হার্বার আক্রমণের ফলে আমেরিকা নির্লীপ্তের ভূমিকা ছেড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা একদল পাঠিয়েছে জাপানী বিক্রম ভাঙ্গতে, অন্যান্য দল এগিয়েছে ইংরেজ সহযোগিতায় উত্তর আফ্রিকার দিকে।’

পুরুষের দৃষ্টিতে নারীকে দেখার বিবরণও এসেছে -

‘মিয়া চাঁদের সঙ্গে আগাগোড়া সম্পর্ক ছিলো তার মারেরই, আদরের নয়। স্বামী তাকে দেখতে পারতো না ছোটবেলা থেকেই। বলতো, বৌ হবে ছোটখাটো বাঁধনের। যে কোনও বয়সেই মাথায় একটা বড় ঘোমটা থাকলেই যাকে বৌ বৌ দেখাবে। তা নয় কোত্থেকে ধরে নিয়ে এলো এক তালগাছ। অমন বড় গড়নের মেয়েরা এক স্বামীতে সন্তুষ্ট থাকে না কখনও।’

উপন্যাসের ভাষা সহজ ও সাবলীল। বর্ণনামূলক ভঙ্গিতে লেখা। পাতায় পাতায় অনেক প্রবচন ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন-

‘থাকতে রেখে খাও
দিন থাকতে হেঁটে যাও।’
বা
‘লাল বিবির জুতা পায়
চলো বিবি ঢাকায় যাই
ঢাকায় গিয়ে ফল খাই
ফলের বটু নাই
ডিমের মতো দেখতে তাই।’

তিনি বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার ছিলেন। বিভিন্ন সময় ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরীবোর্ডে বিচারক, শিশু একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার ও টেলিভিশনের 'নতুন কুড়ি'র বিচারক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জাতীয় বিতর্কের জুরীবোর্ডের বিচারক ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত আছেন বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কথা শিল্পী সংসদ ও মহিলা সমিতির সঙ্গে।

কথাসাহিত্যিক ও লেখক হিসেবে রাবেয়া খাতুন বহু পুরস্কার অর্জন করেন, এসব পুরস্কার হচ্ছে- বাংলা একডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), একুশে পদক (১৯৯৩), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জসীমউদ্দীন পুরস্কার (১৯৯৬), শেরে বাংলা পুরস্কার স্বর্ণপদক (১৯৯৬), শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশিন রিপোটার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০১), বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০২), শেলটক পদক (২০০২), মাইকেল মধুস‚দন পুরস্কার (২০০৫), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (২০০৫) ইত্যাদি। রাবেয়া খাতুনের গল্প ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি ও ইরানি ভাষায় অন‚দিত হয়েছে।

রাবেয়া খাতুন ভ্রমণ করেছেন বহুদেশ। এগুলো হলো- ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, জাপান, নেপাল, ভারত, সিকিম, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিসর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, তাসখন্দ, মারিশাস, মালদ্বীপ ও ইত্যাদি। এছাড়াও টরেন্টো ইউনিভার্সিটি বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ঘুরে এসেছেন কানাডা।

 সেই পঞ্চাশের দশক থেকে অবলীলায় লিখে পরিক্রম করেছেন দীর্ঘ পথ। তাঁর কলম থেকে অনায়াসে ঝরে  পড়েছে অজ¯্র শব্দ আর কথামালা। কিন্তু সব  লেখা থমিয়ে , সব কথামালা শেষ করে তিনি আজ ০৩.০১.২০২১ পাড়ি দিলেন অনন্তধামে। তবু তিনি পঠিত হবেন নিরন্তর। তাঁর স্মৃতি ও কীর্তির প্রতি রইলো শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

 

ড. আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top