একটি সত্যি প্রেমের গল্প : গৌতম সরকার
প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৩৪
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:০৩
বৃষ্টিটা ধরার কোনও লক্ষণ নেই। পরশুদিন বিকেল থেকে এইরকম চলছে। গতকাল শেষ বিকেলে একটু থেমেছিল, তারপর সন্ধেবেলা রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ হওয়ার পর সেই যে শুরু হয়েছিল আর থামেনি। একদম ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। অথচ পরশু দুপুরে যখন শান্ত নির্জন এই শৈলশহরে এসে পৌঁছলাম তখন প্রথম দর্শনেই জায়গাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম৷ ইচ্ছে ছিল গতকাল আর আজ এখানকার সৌন্দর্য্য চেটেপুটে উপভোগ করে আগামীকাল এখান থেকে ইলামের পথে রওয়ানা দেব। কিন্তু বিধি বাম, প্রকৃতি এই অভাগার সাথে এরকম মশকরা শুরু করবে কে জানতো! আটচল্লিশ ঘন্টা আগে হোটেলে ঢোকা ইস্তক বাইরে একটিবারের জন্য বাইরে পা ফেলতে পারলাম না।
পূর্ব নেপালের এই জায়গাতে ট্যুরিস্ট একেবারেই আসেনা। সেই কারণেই প্রকৃতি তাঁর স্বাভাবিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে পেরেছে। জায়গাটার নাম কণ্যম, পূর্ব নেপালের একটা আনকোরা গ্রাম। সারা অঞ্চল জুড়ে শুধুই চায়ের বাগান। রাস্তার পাশ থেকে শুরু হয়ে দিগন্তছোঁয়া সবুজ বাগানের অনন্ত বিস্তার আপনাকে অদ্ভুত মুগ্ধতা দেবে। চা বাগানে ছাওয়া ছোট বড় পাহাড়ের পাশ দিয়ে কালো পিচের মসৃণ সর্পিল রাস্তা যেন কোনও শিল্পীর ইজেলে আঁকা ছবি অলস মন্থনে পড়ে রয়েছে। কিন্তু এই বেরসিক বৃষ্টি চারপাশের সৌন্দর্য্য ঘন মেঘের আঁধারে ঢেকে দিয়েছে। বিকেলে বারান্দায় বসে থেকে মনখারাপের মেঘ মনের দখল নিয়ে নিল। একলা বেরোনোর এই অসুবিধা! দুজনে থাকলে গল্প গুজব করে সময় কাটানো যায়। কিন্তু বদ্ধ ঘরে একেলা গান শুনে আর বই পড়ে কাঁহাতক সময় কাটানো যায়। একঘেয়েমি কাটাতে চায়ের খোঁজে ডাইনিংয়ের দিকে এগোলাম।
কণ্যমে হোটেলের সংখ্যা হাতে গোনা। সেদিন দান্দু যেখানে এসে নামিয়ে দিয়ে জানালো, এটাই কণ্যম, সেখানে না ছিল কোনও হোটেল, না কোনও দোকানপাট। রাস্তার ধারে সিমেন্টের বাউন্ডারি দিয়ে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা 'আই লাভ কণ্যম'। দান্দুকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'এখানে থাকার জায়গা নেই?' দান্দুর উত্তর, 'মিলেগা, লেকিন বহোত জ্যাদা নেহি!' আমি আশপাশ তাকালাম, অনেক নিচে কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ল। সামনে কণ্যম ভিউপয়েন্ট লেখা একটা সাইনবোর্ড, তার পাশ দিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি উঠেছে একটা ছোট পাহাড়ের মাথায়, সেইদিকে কয়েকটা বাড়িঘর। এ ছাড়া বাকি নিসর্গ শুধু সবুজ চা বাগানে বন্দি। দান্দুর পশুপতি মার্কেটে হলেও এই অঞ্চলে আগে আসেনি। অগত্যা স্থানীয় একজনের সাহায্য নিয়ে নীলাদির এই হোটেলের খবর পেলাম। হোটেলে ঢুকেই নীলাদির উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছি। সত্তরের ওপর বয়স, এখনও যথেষ্ট সক্ষম। সবদিকে নজর, হোটেলটা ছোট হলেও সুন্দর করে সাজানো। মূল বাড়ির ডানদিকে সবজি বাগান, বাঁদিকে ফুলের বাগান। এখন এই শীত ছেড়ে যাওয়ার বেলাতেও রংবেরংয়ের গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়ার সম্ভার দেখে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু সবটাই ভন্ডুল করে দিচ্ছে এই অসময়ের বৃষ্টি।
ডাইনিংয়ে কাউকে চোখে পড়লো না। সংলগ্ন রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। আমি কিচেনের কাছে গিয়ে হাঁক পারলাম, 'বিপান!' বিপান আসা থেকে আমার দেখাশোনা করছে। ভিতর থেকে কোনও উত্তর এলনা। আমি কিছুটা অপেক্ষা করে চলে আসবো ভাবছি এমন সময় কিচেনের দরজা দিয়ে যে বেরিয়ে এল তাকে আগে দেখিনি। এসে জিজ্ঞাসা করল, 'কেয়া বাবুজি? আপ কুছ মাংতা হ্যায়? ম্যায় ইয়ে হোটেল কা কুক হুঁ!' আমি পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম, 'বিপাণ কাঁহা?' ও উত্তর দেওয়ার আগেই ডাইনিংয়ের অন্য দরজা দিয়ে নীলাদি ঢুকে বললেন, 'বিপান কো থোড়া বাজার মে ভেজা! পরশো সে আপকো মছলি নেহি খিলায়া। ম্যায় আচ্ছা সে জানতা হুঁ বাঙালি লোক মছলি বিনা নেহি রহ সকতে!' আমি খুব লজ্জা পেলাম। বললাম, 'দিদি আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না, আপনি অযথা বেচারিকে বৃষ্টির মধ্যে পাঠালেন।' নীলাদি ধীরে ধীরে একটা চেয়ারে বসে আমাকেও বসতে ইশারা করলেন। আমি বসার পর বললেন, 'ইয়ে ইনক্লিমেন্ট ওয়েদার কে সাথ ফাইট করনা হামারা আদত হ্যায়! কুছ নেহি হোগা, পরন্তু ইয়ে বিপাণকা ডিউটি হ্যায়।' এরপর উনি হাঁক দিলেন, 'ঠাকুর, দো কাপ চায় ভেজিয়ে'। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই দুকাপ কে তিনকাপে পরিবর্তন করতে হল যখন ঐ বৃষ্টির মধ্যে এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ মানুষ রেইনকোটে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ডাইনিংয়ে প্রবেশ করলেন। ভদ্রলোক ঢোকার পরই নীলাদির ব্যবহারের পরিবর্তন আমার চোখ টানলো। কিছুটা অনুরাগ আর অনেকটা ধমক মিশিয়ে বলে উঠলেন, 'তোমার এই ঝড় জলের রাতে না এলে চলছিল না?' ভদ্রলোক দিদিমণির কাছে বকুনি খাওয়া অনুগত ছাত্রের কৈফিয়ত দেওয়ার মত থেমে থেমে বললেন, 'না মানে কাল বৃষ্টির জন্য আসতে পারিনি, তাই ভাবলাম... আজ একবার...' অল্প আলোতেও চোখে পড়ল নীলাদির সত্তরোদ্ধ গালে গোলাপী আলো ছুঁয়ে গেল, উনি গলা তুলে বললেন, 'ঠাকুর তিনকাপ চা চাপাও, একটা চিনি ছাড়া'। ভদ্রলোক ঘরের এক কোণে গিয়ে রেইনকোটটা খুলে হুকে ঝুলিয়ে রাখলেন। পকেট থেকে তোয়ালে বার করে হাত ও মাথা মুছে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। একটা চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে আমার দিকে চোখ পড়ল। কৌতূহলের চোখে নীলাদির দিকে তাকালে উনি জানালেন, 'দুষ্মন্তবাবু আমাদের গেস্ট, গত পরশু এসেছেন।' ভদ্রলোক মৃদু হেঁসে বললেন, 'নমস্তে বাবু।' আমি প্রতিনমস্কার জানানোর আগেই নীলাদি বলে উঠলেন, 'দুষ্মন্তবাবু একজন ট্রাভেল রাইটার। উনি এবার আমাদের এই জায়গা নিয়ে লিখতে এসেছেন, কিন্তু আকাশের অসহযোগিতায় বেচারি ঘরের মধ্যে আটকা পড়েছেন।' ভদ্রলোক এবার ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলতে লাগলেন, 'সহি বাত! ইয়ে ত নেহি হোনা চাহিয়ে! ইয়ে বারিষ কা সিজন নেহি হ্যায়! পরন্তু... অর টুরিস্ট লোগ ঘুমনে কি লিয়ে আতা হ্যায়।' তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, 'এই অঞ্চলে আপনি প্রথম এলেন?' আমি ঘাড় নাড়তে বললেন, 'শুধু কণ্যম! নাকি আর কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা আছে?' আমি বললাম, 'ইচ্ছে তো আছে এখান থেকে শ্রীঅন্তু ঘুরে ইলাম হয়ে মাইমাজুয়া যাবার। সেখানে দুয়েকদিন থেকে চিন্তা ফু আর সন্দাক ফু ট্রেক করবো ঠিক করে এসেছি। কিন্তু সে কি আর!' ভদ্রলোক বেশ জোর দিয়ে বলেন, 'পারবেন না, গত দুদিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ের অনেক জায়গায় ধস নেমেছে। তাছাড়া ইলাম থেকে মাইপোখরি পর্যন্ত কোনোভাবে পৌঁছতে পারলেও, তারপর আর পারবেন না। এরপর গোটা রাস্তাটাই কাদামাটির, এই বৃষ্টিতে তার মধ্যে কতপথ ভেসে চলে গেছে কে জানে!' আমি প্রমাদ গণলাম।
পরের সকালে বিপাণ যখন চা নিয়ে এল তখনও আমি কম্বলের তলায়। ভোর থেকে বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে, তাই আজও কিছু করা যাবেনা বুঝে ঘুমের জগতে বিচরণই ভালো মনে হয়েছে। বিপাণ আসতে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলাম। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, 'আজও ত একই অবস্থা বিপাণ!' ও হেঁসে ঘাড় নাড়ল। আমি বললাম, 'এভাবে ঘরে বসে বসে তো আর পারা যাচ্ছেনা!'
বিপাণ প্রস্তাব দিল, 'সাব, ফিক্কল জায়েগি? ম্যায় জিপ লে কর যা রহি হ্যায়
আমি বললাম, 'ফিক্কল কেন?
‘সবজি খতম হো গিয়া! কাল বাজার মে মছলি ভি নেহি মিলা। মাজি ফিককল জানে কি লিয়ে বোলা।' আসলে গত তিনদিন বৃষ্টির কারণে কন্যমে বাজার বসতে পারেনি।
আমি বললাম, 'এখান থেকে কতদূর?'
ও বলল, 'য্যাদা দূর নেহি।হ্যায়, লগভাগ আট-দশ মিল হোগা।' অর্থাৎ আট-দশ মাইল রাস্তা। এবার একটু মিচকি হাঁসি দিয়ে জানালো, 'মা জি বোলা বাঙালি সাবকো মছলি খিলানা হোগা।' ওর বলার ধরন দেখে আমিও হেঁসে ফেললাম। আমাকে হাঁসতে দেখে বলল, 'সাব, যায়েগা মেরে সাথ?' আমি তো এককথায় রাজি। কম্বল ফেলে লাফিয়ে উঠে বলি, 'নিশ্চয়ই যাবো! বাবা এই তিনদিন ধরে এই ঘর আর এই বিছানা! চল চল বেরিয়ে পড়ি!' বিপাণ আমার অবস্থা দেখে আরও হেঁসে ফেলে,
‘আরে সাব ধীরে! বহুত টেইম হ্যায় হামারা পাস! আপ পহলে হাত মুখ ধো লিজিয়ে, নাস্তা করনে কি বাদই যায়েগি।' বলে হাসতে হাঁসতে এঁটো কাপ-প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেল। সবকিছু সেরে নিচে নেমে যখন জিপে উঠলাম তখন দেখলাম পিছনের সিটে কালকের সেই ভদ্রলোক বসে আছেন।
রমেশ ভট্ট খুব ছোটবেলায় বাবামায়ের সাথে পোখরা ছেড়ে চলে আসে নেপালের ইলাম জেলার কন্যম গ্রামে। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। একদম ছোটবেলার কথা রমেশের সেভাবে মনেই পড়েনা। তাঁর স্মৃতিতে আছে এখানকার প্রাইমারি স্কুলে পড়ার দিনগুলো। মাস্টারমশাই, সহপাঠী আর সেইসব বন্ধুবান্ধবের দল যাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়ে, খেলাধুলা আর সাতসতের মজা করে শৈশবের দিনগুলো পেরিয়ে এসেছে। সেইসময় কণ্যমে কোনও হাইস্কুল ছিলনা। ছেলের পড়াশোনায় খুব আগ্রহ, তাই বিশ্বনাথবাবু বাধ্য হয়ে একমাত্র ছেলেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ইলামের একটা হাইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন। থাকার ব্যবস্থা হল স্কুল সংলগ্ন হোস্টেলে। প্রিয়জন ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট সেই শুরু রমেশের জীবনে। মা বাবাকে তো ছাড়তেই হল, তার সাথে ছাড়তে হল শৈশবের সবথেকে কাছের বন্ধু যার সাথে ঝগড়া, অভিমান, আড়ি না করে একটা দিনও কাটতো না সেই নীলাকে। হোস্টেলে যাওয়ার আগের দিন খেলার মাঠের ওপারে গুরাস গাছটার নিচে রমেশকে জড়িয়ে ধরে নীলার সে কি কান্না! মনে হচ্ছিল, রমেশ যেন সারা জীবনের জন্য নীলাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রমেশ নিজেকে সামলে যত বলে, আরে বোকা মেয়ে আমি তো ছুটিতে ছুটিতে বাড়ি আসবো, তখন আবার দুজনে মিলে ঘুরে বেড়াবো, খেলবো, তামাং ঠাকুমাকে লুকিয়ে গাছ থেকে কমলালেবু ছিঁড়ে খাবো, ততই মেয়ের কান্নার দমক বেড়ে যায়। বহু কষ্টে জমানো পয়সা দিয়ে লিম্বুকাকার দোকান থেকে একজোড়া কানের মাকড়ি কিনে দিলে তবে মেয়ে চোখের জল মুছে তার পিছু পিছু বাড়ি ফেরে। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। ইলাম থেকে শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে মাস্টার্স করে যখন আবার কণ্যমে ফেরার ফুরসত হল তখন রমেশের বয়স চব্বিশ আর নীলার বাইশ। এই প্রদেশে এটাই ছেলেমেয়ের বিয়ের যথার্থ বয়স। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুজনের অবচেতনেই শৈশবের সেই খেলনাপাতির বন্ধুত্ব অনেক বড় নির্ভরশীল সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। নীলা শেষ দুবছর ধরে বাড়ির লোকের ব্যবস্থা করা বিয়ের সম্পর্কগুলো এটা ওটা বলে ঠেকিয়ে রেখেছিল আর মুখ বুজে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছে। এখানে আসার ছয়মাসের মধ্যে রমেশ যখন এলাকার একমাত্র গভর্নমেন্ট স্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচারের চাকরি পেয়ে গেল তখন আর কোনও বাধা রইল না। দুজনেই নিজের নিজের বাড়িতে সম্পর্কের কথাটা জানাতে মনস্থ করল। বহুদিন ধরে এই দুই পরিবারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক, তাদের দুজনেরই ধারণা ছিল ভিতরে ভিতরে দুই পরিবারই তাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলল। নীলার বাড়ির লোকেরা সরকারি চাকরি করা সচ্চরিত্র ছোটবেলা থেকে চোখের সামনে বড় হতে দেখা ছেলেকে জামাই করতে রাজি হলেও বাধাটা এল রমেশের পরিবার থেকে। রমেশের বাবা মা ছোট থেকেই নীলাকে পছন্দ করতেন, যদিও তখন ছেলের বৌ করার চিন্তাভাবনা তাঁদের ছিলনা, এখন যখন ছেলের নিজের পছন্দ তখন তাঁদের আপত্তি থাকতে পারেনা। আপত্তিটা এল রমেশের ঠাকুমার দিক থেকে। বুড়ির তখন আশি বছর বয়স কিন্তু শরীর মন দুটোই টনটনে। ভট্টরা উচ্চবংশ, সেই বংশে উনি ওনার জীবদ্দশায় ছেত্রীর মেয়েকে বউ হয়ে ঢুকতে দেবেননা, এটা তাঁর শ্বশুর কুলের অপমান! এই ঠাকুমাই তখন পরিবারের প্রধান। বাবা-মা কেউই ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা না করে একটা কাজও করতেন না। সেখানে পরিবারের ছেলের বিয়ের মত ব্যাপারে তাঁর আপত্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত মানসিক শক্তি তাঁদের ছিলোনা।
এই ঘটনার পর থেকেই নীলা আর রমেশের আসল প্রেমপর্ব শুরু হল। সত্যি কথা বলতে এর আগে তারা প্রেম করার সময়টাই বা পেল কই? এগারো বছর বয়সে রমেশ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই বয়সে ভালো বন্ধু হারানোর কষ্ট পেয়েছিল, প্রেমের বোধ আসার কথা নয়। একটু বড় হওয়ার পর যখন ছুটিতে বাড়ি আসত তখন সবাই মিলে হৈহুল্লোড় করে কখন সময় কেটে যেতা, দুজনে আলাদা করে মেলামেশার কথা ভাবতো না। সেই অর্থে আসল প্রেম শুরু হল বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর। তারপরও নীলার বেশ কিছু সম্বন্ধ এসেছে, রমেশও লীলাকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু লীলা নিজ সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। সেই সময়কালে ওইরকম একটা জায়গায় একজন মেয়ের সারাজীবন কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত যে কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল ভাবা যায়না। রমেশ চিরকালই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, পড়াশোনার জগতেই ডুবে থাকত। তাঁর মা একবার বিয়ের কথা তুলেছিলেন, মায়ের সাথে কি কথাবার্তা হয়েছিল জানা যায়নি, তবে তারপর বিয়ের ব্যাপারে তার পরিবার আর কোনও উদ্যোগ নিতে সাহস করেনি। শোনা যায়, ঠাকুমার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা হাল্কা করে নীলাকে বিয়ে করার কথা বলেছিলেন৷ তখন রমেশ বলেছিল, ' বাবা! বিয়েটা পুতুলখেলা নয়, বিয়ে হল একটা পবিত্র বন্ধন, তাই তাকে এতটা খেলো করে তুলোনা।' এরপর স্বভাবতই বাবা-মা আর কিছু বলার সাহস দেখাননি, সারাজীবন নিজেদের দোষী ভেবে কষ্ট পেয়েছেন। রমেশ-নীলা খোলাখুলিভাবে মিশত, কোনও লুকোছাপা ছিলনা। দুই পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল ঠাকুরমার মৃত্যুর পর সেটাও আস্তে আস্তে কেটে গেল। ওদের দুজনের পছন্দের জায়গা ছিল দুটো, এক, সেই গুরাস গাছের তলা, যেখানে শৈশবে রমেশকে জড়িয়ে ধরে নীলা কেঁদে ভাসিয়েছিল আর দুই, নদীর ধার। একদিন নদীর বুকে পাথরের ওপর বসে নীলা হাঁসতে হাঁসতে বলেছিল, 'ঈশ্বরের কি অসীম কৃপা দেখো! এই বেশ ভালো হল। বিয়ে হলে অল্পদিনেই প্রেম শুকিয়ে যেত, আমাদের প্রেম চিরন্তন হবে।'
রমেশ তর্ক জোরে, 'কেন শুকিয়ে যেত কেন? তোমার যত আজগুবি কল্পনা!'
'চারদিকে কি হচ্ছে দেখছ না! সম্পর্কের সিলমোহর পড়ে যাওয়া মানেই তো অধিকার আর দায়িত্বের দাঁড়িপাল্লায় সবকিছুর মাপামাপি শুরু হয় যায়।'
'সবক্ষেত্রে তা হতে হবে কে বলল!', রমেশ তখনও নিজের যুক্তি ছাড়তে রাজি নয়।
'তুমি অস্বীকার করতে চাইলেও এটাই বাস্তব। প্রেমিক রমেশ ভট্ট আর স্বামী রমেশ ভট্ট কখনোই এক লোক হতে পারেনা। যখনই আমি তোমার বউ হব, তুমি অবচেতনেই চাইবে বউ হিসেবে আমি তোমার আর তোমার পরিবারের সেবা করি, তোমার বাবামায়ের বাধ্য হই। এককথায় আদর্শ বউ বলে যেটা বোঝায় তেমন যেন হই।'
তখনও গোঁ ধরে রাখে রমেশ, তর্কের গলায় বলে,
'আমার পরিবার অমন নয়, সেটা তুমি ভালোভাবে জানো!'
নীলা হেঁসে ওঠে। হাল্কা গলায় বলে, 'দেখলে তো আমরা বিয়ে করিনি, তবুও বিয়ের কথা উঠতেই কেমন ঝগড়া শুরু করে দিলাম!' তারপর একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে রমেশের গালটা ধরে একটু আদর করে বলে ওঠে, 'বাবুর রাগ হয়েছে। আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আমার ঘাট হয়েছে! আমার রমেশবাবু কখনোই এসব করত না, আমি তো অন্য সবার কথা বলছিলাম।' এবার রমেশও হেঁসে ফেলে। এরপর বাকি সময়টা দুজনে হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি বসে পাহাড়ি নদীর পাগলা স্রোতের তালে-সুরে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়।
এইসব ঘটনা নীলাদির মুখে শোনা। সেদিন ফিক্কল গিয়ে রমেশবাবুর সাথে ভালোভাবে আলাপ হল। সারাটা পথে উনি ওনার স্কুলের গল্প শোনালেন। অবসরের পর তিনি কণ্যমে গরীব বাচ্চাদের জন্য একটা হোস্টেল খুলেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের বাচ্চারা যারা পড়তে চায় অথচ যেখানে স্কুল নেই তারা এই হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে পারে। থাকা-খাওয়ার খরচ নগণ্য। কণ্যমে অনেকদিন আগেই হাইস্কুল হয়েছে তবে কলেজ নেই, ফিক্কলে ডিগ্রি কলেজ আছে। এখানে স্কুল থেকে পাশ করে বাচ্চারা ফিক্কলের কলেজে ভর্তি হয়। যাদের সঙ্গতি আছে তারা শিলিগুড়ি যায়, কেউ কেউ কলকাতা বা শিলং। হোস্টেলে ছেলেদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন রমেশবাবু আর মেয়েদের জন্য নীলাদি। একটি স্হানীয় মেয়ের সাহায্য নিয়ে রান্নাঘরের দায়িত্বও নীলাদিকে সামলাতে হয়। ফেরার পথে হোস্টেল দেখার নিমন্ত্রণ জানিয়ে রমেশবাবু ওনার বাড়ির সামনে নেমে গেলেন।
ফিক্কলে গিয়ে যে খবরটা পেলাম সেটা আমার পক্ষে সুখকর নয়। ইলামের পর রাস্তায় জায়গায় জায়গায় ধস নেমেছে, গাড়ি চলার রাস্তা পুরোপুরিভাবে বন্ধ। ধসের কারণে বহু পাহাড়ি গ্রাম মূল জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি না ধরলে প্রশাসনের তরফে ত্রাণ পাঠানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বুঝলাম আমার এবারকার ভ্রমণ এই কণ্যমেই শুরু আর এখানেই শেষ করতে হবে। এইমুহুর্তে শিলিগুড়ি ফেরাও দুষ্কর। প্রথমত, কোনও ড্রাইভার যেতে রাজি হবেনা, শিলিগুড়ির পথেও যে কোনও ধস নামেনি বা নামবে না কে বলতে পারে? তাই আপাতত এখানেই মাথা গুঁজে পড়ে থাকতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি এদের সাথে একটু মিশে যাওয়ার পর সেই একঘেয়েমিটা আর নেই। এখন সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলে নিচে চলে আসি। ভোরবেলায় সবাই সবজিবাগানে কাজ করে। বিপাণ আর আরেকটি ছেলে সবজি গাছের গোড়াগুলো আলগা করে জল দিচ্ছে। ওদিকে ফুলের বাগানে এক বৃদ্ধ মালি কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর রমেশবাবু এসে তার সাথে যোগ দেবেন। এরমধ্যে নীলাদি একটা বাস্কেটে আজকের রান্নার জন্য সবজি তুলছেন। সকালে এখানকার রান্নার ব্যবস্থা করে উনি হোস্টেলে যাবেন। সেখানেও বাগান আছে, অর্গানিক সবজির চাষ হয়। সব কাজ করে হোস্টেলের বাচ্চারা। এইভাবে সারাদিন হোমস্টে আর হোস্টেলের মধ্যে চরকি পাক চলে নীলাদির। এই বয়সে ভদ্রমহিলার কর্মক্ষমতা দেখে অবাক হতে হয়। আমি বসে বসে ওদের কর্মকাণ্ড দেখি। কখনও কখনও বিপানের হাত থেকে খুরপি নিয়ে গাছের গোড়া খোঁচাই। এরমধ্যে কুক এসে সবার হতে চায়ের কাপ ধরিয়ে যায়। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাজ আর গল্পগুজবে সুন্দর সময় কাটে।
সেদিন ব্রেকফাস্টের পর একাই রওয়ানা দিলাম হোস্টেল দেখতে। সেদিন ফেরার পথে রমেশবাবু হোস্টেলটা দেখিয়েছেন। ওনার বাড়ি সংলগ্ন একটা দোতলা বাড়ি। আজ রোববার, স্কুল কলেজ ছুটি। আমি যখন পৌঁছলাম তখন নিচের তলার প্রার্থনা কক্ষে বুদ্ধবন্দনা চলছে...বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি....ধর্মং শরণং গচ্ছামি। আমি ঘরে ঢুকে পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরমধ্যে রমেশবাবুও হোমস্টের বাগানের কাজ সেরে পৌঁছে গেছেন। আমার দিকে চোখ পড়তে ইশারায় বসতে বললেন। আমি পিছনের সারিতে বসে বাচ্চাগুলোর সাথে গলা মেলালাম।
হোস্টেলে মেয়েদের ওপরে আর ছেলেদের নিচে থাকার ব্যবস্থা। এই মুহূর্তে বারোটা মেয়ে আর পনেরজন ছেলে আছে। কোনও কোনও সময় মোট সংখ্যাটা পঞ্চাশে পৌঁছে যায়। ওপরে নিচে চারটে করে ঘর আছে, প্রতি ঘরে ছজন করে থাকতে পারে। রান্নাঘর আর খাবার ঘর আলাদা। ওখানে পৌঁছে জানলাম, শুধু থাকা নয় এখানে পড়াশুনোরও ব্যবস্থা আছে। রমেশববু তো আছেনই, তার সাথে স্থানীয় দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে বাচ্চাগুলোকে নিয়মিত পড়ায়। প্রতিদিন সন্ধ্যে ছটা থেকে নটা পর্যন্ত ক্লাস হয়। থাকার জন্য নির্দিষ্ট কোনও খরচ নেই, যার যেমন ক্ষমতা তেমন দেয়। কয়েকজন এতই গরীব যে কিছুই দিতে পারেনা। বেশিরভাগটাই যোগাড় করতে হয় রমেশবাবু আর নীলাদিকে। ইদানিং কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিছু কিছু সাহায্য করে। আসলে মানুষ দুটি চিরকালই প্রচার বিমুখ, নাহলে আজকের যুগে এই ধরনের উদ্যোগকে সাহায্য করতে অনেক ব্যক্তি ও সংস্থা এগিয়ে আসছে। মনে মনে ঠিক করলাম ফিরে গিয়ে কিছু একটা করতে হবে। সারা হোস্টেল ঘুরে বাচ্চাদের সাথে আলাপ করে বেশ কিছুটা সুন্দর সময় কাটিয়ে নীলাদির সাথে ফিরে এলাম। রমেশবাবু বিদায় জানিয়ে বলেন, 'সন্ধ্যেবেলা দেখা হবে।'
সেদিন সন্ধ্যায় রমেশবাবুর মুখে এই হোস্টেল তৈরির নেপথ্য কাহিনী শুনলাম। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর এই শান্ত শৈলশহরে সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলল। আস্তে আস্তে নীলার ছোট বোনের বিয়ে হল, ভাই চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল। তার আগে এখানেই নিজের পছন্দের এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করল। নীলা সব কাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করল। যদিও সবসময়ই সে রমেশকে পাশে পেয়েছে। রমেশের ওপর নীলার বাবামাও ভরসা করতেন। তাঁরা এও জানতেন চোখ বোজার পর তাদের মেয়ে একেবারে একা হয়ে যাবেনা, রমেশ সবসময় পাশে থাকবে। ভাই চলে যাওয়ার পর বুড়ো বাবা-মায়ের দায়িত্ব পুরোপুরি নীলার ওপর পড়ল। তখন তার আর কতই বা বয়স, খুব জোর তিরিশ পেরিয়েছে। সারাদিন রান্না আর বুড়ো বাবামায়ের সেবা করতে করতে অবসাদের শিকার হল। যতই রমেশ সময় দিক, স্কুল সামলে নিজের বৃদ্ধ মা-বাবার তদারকি করার পর নীলাকে যতটা সময় দেওয়া উচিত ছিল সেটা দিতে পারতো না। নীলার এই পরিবর্তনে রমেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বুঝতে পারলেন নীলার একটা নিজস্ব জগৎ দরকার যেখানে সে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে। রমেশের নিজের কাজের জগৎ আছে, স্কুল তার প্রাণ; আর নীলা! সত্যিই তো ওর কিছুই নেই। সারাজীবন অন্যের জন্যই কাটিয়ে দিল। তখনই এই হোস্টেলের কথা মাথায় আসে। নিজের শৈশবে অতটুকু বয়সে পরিবার পরিজন ছেড়ে পরভূমে কাটাতে হয়েছে। সেই কষ্ট তার বুকে রয়ে গেছে। আজ কণ্যমে হাইস্কুল হয়েছে, কিন্তু এখনও পূর্ব সিকিমের অনেক জায়গা আছে যেখানে হাইস্কুল কেন একটা প্রাইমারি স্কুলও নেই। সেখানকার ছেলেপুলেরা নিরক্ষরই থেকে যায়। তাদের মধ্যে অন্তত কয়েকটা বাচ্চাকেও যদি লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়া যায়। ব্যাপারটা নিয়ে কদিন খুব ভাবল রমেশ, তারপর নীলার কাছে প্রস্তাবটা পাড়ল। নীলা তো প্রথমে ভয় পেয়ে গেল, বলে উঠল, 'না না এ আমি পারবো না। এতগুলো বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া কি মুখের কথা! তাছাড়া পরের বাচ্চা, কিছু হলে ওদের বাবা-মায়েরা কি আমাদের ছেড়ে দেবে? শেষে থানা-পুলিশ হবে।' একদিনে হয়নি, দিনের পর দিন বোঝাতে বোঝাতে সাহস দিতে দিতে একসময় নীলা রাজি হয়েছে। তারপর থেকে রমেশকে আর কিছু বলতে হয়নি। বুক দিয়ে আগলে রেখেছে হোস্টেলটাকে, আর হোস্টেলের প্রত্যেকটা বাচ্চাকে। নীলা মাঝে মাঝে রমেশকে বলে, 'তোমায় বিয়ে করলে খুব জোর একটা কি দুটো বাচ্চার মা হতাম। ঈশ্বর এখন আমায় দুহাত ভরে সন্তান দিয়েছেন।' কথাটা যখন বলে রমেশের সাহস হয়না তার চোখের দিকে তাকাতে, কারণ সে নিশ্চিত কথাগুলো বলার সময় নীলার মুখে এক অপার্থিব আলো খেলে যায়।
আজ সন্ধ্যে থেকে নিজের ঘরেই আছি। এইমাত্র রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ শেষ হল। বৃষ্টি থেমেছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস- কাল মেঘহীন আকাশ, রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। তবে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পাহাড় পুরোপুরিভাবে সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমি এবার অস্থির হয়ে পড়েছি। এভাবে তো সব কাজকর্ম ফেলে অনন্তকাল এখানে বসে থাকা সম্ভব নয়। আমার অস্থিরতা দেখে রমেশবাবু একটা ব্যবস্থা করেছেন। কাল সকালে স্থানীয় থানা থেকে একটা পুলিশ ভ্যান শিলিগুড়ি যাচ্ছে। যদিও কতদূর যেতে পারবে সেটা ওরাও জানেনা। গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ নেই গত তিনদিন, মোবাইল নেটওয়ার্ক, নেট কিছুই কাজ করছে না। তবে সুযোগটা ছাড়লে চলবে না। যতটা এগিয়ে যেতে পারি ততটাই ভালো। আমি একা মানুষ, ঠিক কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাড়ি ফেরার একটা উত্তেজনা অনুভব করছি। আজ তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের সকাল এল পাখির ডাকে। বৃষ্টির মধ্যে পাখিগুলো কোথায় ছিল কে জানে? আজও হোমস্টের প্রাত্যহিক কাজকর্মে কোথাও ব্যত্যয় নেই। শুধু আমি সকালের জমায়েতে অংশগ্রহণ করিনি। আমি আমার পার্থিব জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত। বিপাণ যন্ত্রের নিয়মে চা দিয়ে গেছে একটা কথাও বলেনি। হয়তো আমার ব্যস্ততা দেখে সাহস করেনি। আটটার সময় কুক এসে জলখাবার দিয়ে গেল। গাড়ি আসবে নটায়। তৈরি হয়ে যখন নিচে গেলাম তখন সবাই গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। থানার গাড়ি এসে গেছে। আমি সবার দিকে তাকালাম। কেউ কোনও কথা বলল না। প্রত্যেকের হাতে একটা থলি, থলির ভিতর ডান হাত মালা জপে চলেছে। সবার মুখ অদ্ভুতভাবে নির্বিকার। আমি রমেশবাবুর মুখের দিকে তাকালাম, নীলাদির দিকে তাকালাম, বিপাণ, কুক, মালি সবাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু কেউ আমার দিকে তাকালো না। সবাইয়ের দৃষ্টি স্থির কিন্তু যান্ত্রিকভাবে মুখ আর হাত নড়ে যাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে জিপে উঠে বসলাম। সত্যিই এই মুহূর্তে প্রথাগত বিদায় শুভেচ্ছা বড় খেলো হয়ে যেত। জিপ শিলিগুড়ির পথে এগিয়ে চলল।
গৌতম সরকার
অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা
বিষয়: ড. গৌতম সরকার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: