সীতাহার বিভ্রাট : প্রদীপ দে
প্রকাশিত:
৩ জুলাই ২০২১ ২১:২০
আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৫৮
আমি প্রনয়ী সাজতে ভালোবাসি। ইচ্ছা আছে উপায় নেই। অভাবের ঠিক নয় তবে স্বচ্ছল পরিবারও নয়। স্বামী প্রাইভেট কোম্পানির এক চাকুরে। যা আয় হয় তাতে সংসার চলে যায় তবে বিশেষ কিছু জমে না। সখ আহ্লাদে কেরামতি করতে হয়। চাইলেই কিছু পাওয়ার নেই। যেটা পাওয়া যায় তা স্বামীর অফুরন্ত ভালোবাসা। প্রনয় আমাকে খুবই ভালোবাসে। সেখানে কোন খামতি নেই। দুজনাই দেখতে যেমন, মনের দিক থেকে তেমনই উদার।
বন্ধুরা লোভ দেখায় –
-তোকে দেখতে এত সুন্দর,সাজলে আর কত না ভাল লাগবে!
আমি হেসে উড়িয়ে দিই,
-আমার স্বামীকে দেখেছিস কত সুন্দর? সুন্দরকে সাজতে হয় না, বুঝলি?
জানালা দিয়ে চাঁদকে দেখে মন ভরাচ্ছি, স্বামী এসে কড়া নাড়তেই চিটকানি খুলে দিলাম। আর দরজা বন্ধ করার সুযোগ পেলাম না, প্রনয় আমাকে জড়িয়ে ধরেই বেশকয়েকটা চুমু বসিয়ে দিল গালে মুখে আর
-এমাঃ এমাঃ কি করো, ছাড়ো ছাড়ো, দরজা যে খোলা - ছিঃ ছিঃ ……
-না না ছাড়বো না -ওঃ কিচ্ছু হবে না।
আমি জোরে ছিটকে বেরিয়ে গেলাম। মুখ ভেঙালাম
-এক্কেবারে অসভ্য!
হাত পা ধুয়ে এলে আমি চা বিস্কুট দিলাম। সব দূর থেকে করতে হচ্ছে কখন যে ওর হাতে ধরা পড়ে যাবো! কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়ে গেল। চমকে গেলাম ওর কথায় আর কাজে। একটা জুয়েলারি বাক্স খুলে দেখাতেই - ঝকঝকে আলো ঠিকরে বের হল যেন, - নীল ভেলভেট বাক্সে সাদা মুক্তোর একটি সীতাহার!
থাকতে না পেরে সামনে চলে গেলাম আর ও আমাকে টেনে কোলে বসিয়ে নিল - দেখো --দেখো সোনা এটা কত ঝলমলে?
- এটা কোথায় পেলে?
আমার চোখে বিষ্ময়ের সুর।
-না সোনা এটা আমার নয়। আমার এক বন্ধু হিতেশের, ওরা বাইরে যাচ্ছে -তাই আমার হেফাজতে রেখে গেল -- ফিরিয়ে দিতে হবে।
- ওহঃ তাই বলো - আমি লোভ সামলে নিলাম।
নেশা কিন্তু চোখে লেগে রইলো - স্বামীর আদর মাথায় এলো না।
একদিন প্রনয়ের বাড়ি ফিরতে দেড়ি দেখে নিজের মত সাজতে লাগলাম। সাজার শেষে আয়নায় বারবার নিজেকে দেখি আর ভাবি কখন আমার স্বামীকে দেখাবো। হঠাৎই কি যে হল আলমারিতে রাখা সীতাহারের বাক্সটার দিকে নজর গেল। স্বামীকে তাক লাগাতে সীতাহার গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ঝলমল করে উঠলো সব কিছু, আমি নিজেই চমকে গেলাম। আর তখনই কড়া নড়ে উঠলো। স্বামী এসে গেল, অনেক আগেই। প্রনয় আমার সাজা দেখেই মজা পেয়ে গেল - ওহঃ শব্দে আমায় জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলো অনেক। কিন্তু একটুও রাগ করলো না। ওর মোবাইলে আমার কয়েকটি ছবি তুলে নিল। আমাকে যে আর ছাড়ে না। আমিও কায়দা করলাম –
- সব সাজ নষ্ট হয়ে যাবে যে...
ও ভুল বুঝে ছেড়ে দিল। কিন্তু আবদার করলো-- চলোনা পাশের লেকে একটু বেড়িয়ে আসি। এত সুন্দর সেজেছো সবাই দেখুক একটু।
কি মনে হল রাজী হয়ে গেলাম।
পাশেই লেক। সন্ধ্যা সাতটা হবে। কিন্তু আলোগুলো সব নেভানো ছিল। কিরকম খারাপ লাগলো। ভয়ও পেলাম। আর স্বামী সুযোগ পেয়ে গেল অন্ধকারে আমাকে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। কি আর করা যাবে স্বামী যে! - ধরা দিলাম।
হঠাৎই খসখসে আওয়াজ ঘাস মারানো, চটি জুতোর শব্দ আমাদের ঘিরে ধরলো। চারটে লোক হাতে চকচকে ছুঁরি নাচাচ্ছে। ভয়ে হাত পা পেটে ঢুকে যাওয়ার উপদ্রব। বুঝতে বাকি রইলো না - ওরা আমার চকচকে হার দেখে ফেলেছে। সে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। প্রনয় বাঁধা দেওয়ার জন্য ছটফট করছিল। আমি একহাত দিয়ে ওকে চেপে ধরলাম যতদুর দৃষ্টি যায় সাহায্যের খোঁজ করলাম। কাউকেই পেলাম না। যা ও দু একজন দুরে ছিল হঠাৎই হাওয়া হয়ে গেল। প্রনয় চেঁচাবার চেষ্টা করতেই ওরা ছুঁরিটা ওর গলায় চেপে ধরলো।
আমি অসহায় হয়ে এতটাই ভীত হলাম নিমেষে গলার সীতাহার খুলে দিয়ে দিলাম। ওরা ওটা নিয়েই দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমার হাত পা কাঁপছিল। ভয়ে আর লজ্জায় চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। প্রনয় হতচকিত তবু আমায় চেপে ধরে স্বান্তনা দিতে থাকলো।
ভয়ে ভয়ে দুদিন দুজনায় কাটালাম।আমি এতটাই লজ্জায় পড়ে গেলাম যে স্বামীর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলাম। আমার নিজেকে সাজানোর লোভ এতবড় বিপদ ডেকে আনলো। নিজেকে বড় ছোট মনে হল। অবাক কান্ড, স্বামী প্রনয় কিন্তু আমাকে ভুল বুঝলো না। উপরন্তু আমাকে কাছ ছাড়া করতে চাইলো না। তাই অফিসেও গেল না।
সমস্যা হলো প্রনয়ের বন্ধু হিতেশের ফেরার সময় এসে গেল। প্রনয় আমাকে নিয়ে বসে পড়লো। ব্যাঙ্কের জমা, আমার অলংকার যোগ করেও তেমন সুবিধা হলো না। শেষে অফিসে লোনের আবেদন করে দিল। লোন পাওয়া গেল, মাসে মাসে মোটা টাকা কেটে নেওয়ার চুক্তিতে। স্যাঁকড়ার দোকানে গিয়ে মোবাইলে তোলা ছবি দেখিয়ে হুবহু আরো একটা মুক্তোর সীতাহার তৈরী করা হল। সব হল ঠিকই কিন্ত মনের মধ্যে একটা দগদগে ঘা রয়েই গেল।
ভয় পেলাম এইভেবে আমাদের এই অভাবের সংসারে অভাব আরো বাড়বে।
যথা সময়ে হিতেশ বাড়ি চলে এল গয়না ফিরিয়ে নিতে। আসলে প্রনয়ই ওকে বাড়িতে ডেকেছিল। ওর ভয় হয়ে গেছিলো, গয়না নিয়ে বাইরে যেতে।
আমি সঙ্কোচের সঙ্গে চা বিস্কুট দিলাম।
প্রনয় ওর জুয়েলারি বাক্সেই ওটা ফেরত দিল। হিতেশ কোন সন্দেহ করলো না। হিতেশ ওটা নিয়ে উঠতে যাচ্ছে এমন সময়ে আমার স্বামী অনুরোধ করলো ---
- একটু দেখে নিস প্লিজ!
- আরে দেখার কি আছে ?
-না না আছে, বন্ধু আছে। সব কিছু দেখে নিতে হয়।
- আরে ধুৎ। তুই কিযে বলিস ?
বলতে বলতে হিতেশ বাক্সটি খুলে সীতাহারটি দেখলো। বন্ধ করতে গিয়ে আবার দেখলো। কিছুক্ষণ চিন্তা করে জিজ্ঞাসা করলো, --
- এটা যেন আরো চকচকে লাগছে মনে হচ্ছে ? ব্যাপারটা কি ?
প্রনয় বুঝলো সে ধরা পড়ে গেছে। বন্ধুকে বসিয়ে সব কথা বলে দিল। ও চায়নি পরে ঝামেলা হোক।
আমি পাশে দাঁড়িয়ে- 'সব দোষ আমার' বলে স্বীকার করে নিলাম।
হিতেশদা হো হো করে হেসে উঠলো। আমরা আবার ভয় পেয়ে গেলাম।
- আরে নারে না, ওটতো নকল সীতাহার ছিল আর এটা যে এক্কেবারে আসলী!
অবাক হয়ে আমরা চেয়ে আছি।
হিতেশদা জানালেন,
- আমার পরিচিত অনেকেরই এই সীতাহারটার প্রতি লোভ ছিল। ওরা জানতো এটা আসল মুক্তো আর সোনা দিয়ে তৈরি এবং মহা মূল্যবান। নকল সীতাহার বাড়িতে রেখে গেলে চোর ভুল বুঝে উপদ্রব করতে পারে কারণ এটা এটতাই সুন্দর ছিল, তাই ওটিকে সরিয়ে রাখতেই চেয়েছিলাম। এখন দেখছি ভুল করে ফেলেছি। তোদের বিপদ দিলাম। আমাকে বন্ধু ভেবে একবার জানালে তোদের এই কষ্ট পেতে হত না। যাক অন্য আরো একদিক দিয়ে ভালোই হল -- কষ্টে -সৃষ্টে বৌদির একটা সোনার হার হয়ে গেল। বৌদিকে এটা সুন্দর মানাবে। এটা তোদেরই থাকবে। আমারটা নকল ছিল চোরেদের কাছে থাক। হা - হা - হা -
করে হেসে হিতেশ বিদায় নিল।
আমরা একেবারে বোকা বনে গেলাম দুজনায়।
আমি প্রনয়ী যার এত সাজার ইচ্ছা ছিল নিমেষের মধ্যে তা আমার মাথা থেকে বেড়িয়ে গেল। কিছুটা হাল্কা লাগলো। আর আমার দুষ্ট স্বামী প্রনয় আমায় তক্ষনাৎ সেই সীতাহার আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে পুরো সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ছাড়লো।
ওরা দুজনই খুব ভাল তাই একটু আনন্দ করুক। আমাদের আর এগিয়ে লাভ নেই …
প্রদীপ কুমার দে
কোলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
বিষয়: প্রদীপ কুমার দে
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: