সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

না ফেরার দেশে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহ : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২১ ২০:৫৫

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১১

ছবিঃ ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহ

 

বাংলা   সাহিত্যের  কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বুদ্ধদেব গুহ আজ আমাদের মধ্যে নেই। তিনি অমৃতলোকে পথে পাড়ি দিয়েছেন। ছয় দশক ধরে বাঙালির হৃদয় মানচিত্রে অনুভবে, অনুপ্রেরণায় হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চলে গেলেন আমাদের ঋজুদা। পড়ে থাকলো তাঁর অমলিন সৃষ্টিকর্ম। এক বর্ণময় বহু কৌণিক ব্যক্তিত্ব। সাজিয়ে রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টি সম্ভার আগামী প্রজন্মের জন্য। গতকাল কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে হৃদয়রোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। মহা জন্মাষ্টমীর দিনে রাজ্য জুড়ে শোকের ছায়া নেমেছে। যেতে নাহি দেব, তবু যেতে দিতেই হয়। কালের অমোঘ নিয়মে। ৮৫ টি বসন্ত পেরিয়েও তিনি ছিলেন চিরসবুজ। বেশ কিছু দিন আগে আলো ঝলমল পরিবেশে ঘরোয়া ভাবে জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। চুরাশিতেও যিনি আটচল্লিশ বা আঠারো। জন্মদিনে ভাবেন না বগিটা মৃত্যু নামক টার্মিনাল স্টেশনের কাছে চলে এল। বরং নিজেকে ছুঁয়ে দেখেন ঝলমলে ভালবাসার মধ্যে। নিজেকে খোঁজেন আরও বেশি করে। “বাঙালি এত ভাবে চেয়েছে আমায়!”— বিস্মিত এক চিরতারুণ্য কথা বলে ওঠে।

করোনার আবহে কেড়ে নিল প্রবীণ অসাধারণ জনপ্রিয়  সাহিত্যিককে। বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। গত ৩১ জুলাই থেকে দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন বুদ্ধদেব। সেখানেই রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। চলতি বছরের এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন অশীতিপর এই সাহিত্যিক। সেই সময় শহরের একটি হোটেলে নিভৃতবাসে থাকার পর, তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়। ৩৩ দিন লড়াইয়ের পর করোনামুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন বুদ্ধদেব। তবে এ বার আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরা হল না তাঁর। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার পাশাপাশি বুদ্ধদেব গুহর  মূত্রনালীতে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। এ ছাড়া তাঁর লিভার এবং কিডনিতেও সামান্য সমস্যা ছিল বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ফের কোভিড পরীক্ষাও করা হয়েছিল। তবে তাতে সংক্রমণ ধরা পড়েনি। দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভোগা বুদ্ধদেব  গুহ বয়সজনিত নানা সমস্যাতেও ভুগছিলেন।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে নিজের জায়গা গড়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জঙ্গল মহল’-এর পর থেকে ‘মাধুকরী’, ‘কোজাগর’, ‘অববাহিকা’, ‘বাবলি’— একের পর এক উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। কিশোর সাহিত্যেও ছিল অবাধ বিচরণ। তাঁর সৃষ্ট ‘ঋজুদা’ বা ‘ঋভু’র মতো চরিত্র আকৃষ্ট করে রেখেছে কয়েক প্রজন্মের বহু কিশোর-কিশোরীর মনকে।
১৯৩৬ সালের ২৯শে জুন কলকাতায় জন্ম বুদ্ধদেব গুহর। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এই প্রাক্তণীর পেশাদার জীবন শুরু হয়েছিল চার্টার্ড অ্যাউন্ট্যান্ট হিসাবে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। তাঁর অসংখ্য উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৭৭ সালে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি।

বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন। 

 'বাংরিপোসির দু' রাত্তির ''বাবলি' না 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'কোয়েলের কাছে' - কোনটা পড়ে  হঠাৎ তাঁর লেখার প্রেমে পড়েছিলাম সেটা আজ আর   মনে নেই। এক কৌতূহলী কৈশোরে তিনি হয়ে উঠেছিবলেন প্রিয় লেখক। মুগ্ধতার আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম। তবে আমাদের বসন্তের দিনগুলোতে পাকা হলুদ রং ধরিয়েছিলেন উনিই। যৌবনের কত রাত নির্ঘুম কেটেছে ওনার সৃষ্টির সঙ্গে। 'মাধুকরী' থেকে 'কোজাগর' হয়ে 'কোয়েলের কাছে' পৌঁছেছিলাম যখন তখন বুঝেছিলাম এ নেশা মহুয়ার কড়া নেশা। সহজে কাটার নয়। তারপর কবে যেন বুদ্ধদেব গুহ নামটা দূরের সাহিত্যিক থেকে বেরিয়ে এসে মনের কাছাকাছি মিশে গিয়েছিল। ঋজুদা স্রষ্টার কলম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এবারে বিশ্রামের পথে পাড়ি জমিয়েছে। ও সোনার কলম অমরত্ব লাভ করে তবেই বিশ্রাম চেয়েছে। তবুও মনখারাপ হয়। যখন শুনি 'জঙ্গল মহল' স্তব্ধ হলো। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আপনি আমাদের মনে। শ্রদ্ধা রইল অফুরান। 
প্রকৃতি আর জঙ্গল বার বার ফিরে এসেছে যারা লেখায়, সেই বুদ্ধদেব গুহ আজ প্রয়াত। মাকলাস্কিগঞ্জের মহুয়ার গন্ধে ভরা থাক ওনার স্মৃতি।বিচিত্রতা এবং অভিজ্ঞতায় ভরপুর এই লেখকের জীবন। তিনি বিশ্বের বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন যেমন ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলিতে। সেই ছাপ পড়েছে তাঁর লেখায়।
প্রথম দিকের সাহিত্য জীবনে তিনি কেবল শিকার নিয়েই লিখেছিলেন, কিন্তু পরে তিনি মূল সাহিত্যে ফিরে এসেছেন। লেখালেখি ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ে তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
পূর্ব ভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয় তাঁল লেখাতে পাওয়া যায়। তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল 'কোয়েলের কাছে', 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'বাবলি', 'হলুদ বসন্ত', 'কোজাগর' ইত্যাদি। তাঁর রচিত মাধুকরী উপন্যাসটি বহু দিন ধরে বেস্ট সেলার। তাঁর সৃষ্ট 'ঋজুদা' নামের গোয়েন্দা চরিত্রটি কিশোর সাহিত্যে ভীষন জনপ্রিয়। এছাড়া তিনি বেশকিছু অসাধারণ প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন।

 
বহু কৌণিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় এক নতুন ঘর না সৃষ্টি করেছিলেন।  অভিনব শৈলীতে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বুদ্ধদেব গুহর পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল চাটার্ড অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তিনি ছিলেন একজন নামী চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত করেছিল। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অডিশন বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন তিনি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। একদা বামফ্রন্ট আমলে তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড পশ্চিমবঙ্গ বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ড এবং নন্দন উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে পরিচালন সমিতির সদস্যও নিযুক্ত হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব গুহ খুব সুন্দর ছবিও আঁকেন। নিজের লেখা একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন।
'জঙ্গলমহল' তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তারপর বহু উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লেখক হিসেবে খুবই অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার বিতর্কিত উপন্যাস 'মাধুকরী' দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার। ছোটদের জন্য তার প্রথম বই- 'ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে'। ঋজুদা তার সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় অভিযাত্রিক গোয়েন্দা চরিত্র। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৭ সালে। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ঋতু গুহ তার স্ত্রী। সুকণ্ঠ বুদ্ধদেব গুহ নিজেও একদা রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। পুরাতনী টপ্পা গানে তিনি অতি পারঙ্গম। টিভি এবং চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার একাধিক গল্প উপন্যাস।
 
বর্ণময় সৃষ্টি সম্ভার:  কোজাগর, আয়নার সামনে, অভিল্বাহিক, অববাহিকা, অবরোহী, অদ্ভুত লোক, আলোকঝারি, চন্দনপুরের কড়চা, বাংরিপোসির দু রাত্রির, বাসনা কুসুম, বাতি ঘর, চবুতরা, চান ঘরে, গানচারকন্যা, চারুমতি, ছৌ, পরিযায়ী, একটু উষ্ণতার জন্য, গুঞ্জা ফুলের মালা, হলুদবসন্ত  জগমগি, যাওয়া আসা, ঝাঁকিদর্শন, জঙ্গল মহল, বনোবাসার, লবঙ্গীর জঙ্গলে, খেলা ঘর, কোয়েলের কাছে, মান্ডুর রুপমতীমহরা, নগ্ন নির্জন, ওয়াইকিকি, কাঁকড়িকিরা, পামরি জল ছবি, পারিধি, রাগমালা, কুর্চিবনে গান, রিয়া সুখের কাছে ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য।


বুদ্ধদেব গুহের জটিল এক ভালোবাসার প্রেক্ষাপট নিয়ে ঝরঝরে উপন্যাস 'বাংরিপোসির দু' রাত্তির'। বাংরিপোসি, মূলত একটা জায়গার নাম, ভারতের উড়াষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলায়  অবস্থিত। সবুজ ঐ জনপদে বেড়াতে যায় গল্পের নায়িকা কিশা ও তার স্বামী সন্তান, নায়ক অরি। 
ছত্রিশগড়ের আরাকু উপত্যকার কেশকালঘাটির আরণ্যক পটভূমিতে এক বিরাট, বর্ণময় ও বেগবান উপন্যাস। গানে যেমন সম থাকে। এই উপলব্ধিই বুদ্ধদেব গুহর যাদুকলমে উদ্ভাসিত হয়েছে।এ শুধুই প্রেমের উপন্যাস নয়, এতে এম.সি.সি- র ছেলেরাও আছে এবং তাদের প্রতি লেখকের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। 
বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন বাংরিপোসির দু’রাত্রির...আমি ঘুরে এলাম গত দুদিন আগে বাংরিপোসিতে এক কাক ভোরে।
অনেকদিন থেকেই বাংরিপোসি যাবার ইচ্ছা ছিল। একজনকে পেয়েও গেলাম। জানতে চাইলাম ভাই, বুড়িবালাম নদী কোন দিকে। বলল, সে তো অনেকটা দূর। এই রাস্তাটা চলে গেছে। আমাকে আর পাই কে ? যত হাঁটছি, বাংরিপোসি তার সব রকম রূপের ঝাঁপি একটা একটা করে আমার সামনে খুলছে।
বাংরিপোসি যে এত সুন্দর, এত বুনো আমি আশা করি নি। সময় কি ভাবে কেটে গেল। সোজা রাস্তা ছেড়ে একবার ডান, একবার বাম দিক থেকেও ঘুরে নিলাম। গরুর গাড়ির খবর পেয়ে এক গ্রামেও চলে গেলাম। গ্রামের লোকেরা জানালো ধান  রোপন শেষ হয়েছে। শুধু সবুজের সমারোহ। সবুজের গন্ধেমাখা সবুজের সমুদ্রে অবগাহন করলাম। এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশকে পটভূমি করে বুদ্ধদেব গুহর কালজয়ী উপন্যাস বাংরিপোসির দু'রাত্তির"।
সবুজের গন্ধ মাখা বুদ্ধদেব গুহর স্মৃতি বিজড়িত বারিংপোসি - সিমলিপাল। অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতিতে প্রাধান্য পেয়েছে জঙ্গল। সবাই জঙ্গলমহল রূপে চেনে ও জানে। গাঢ় সবুজ অরণ্য দিগন্তে প্রসারিত, নীচেও তার সবুজের সমুদ্র। আর লালমাটির কাঁকুড়ে মায়া মাখানো স্বপ্নময় পথ। এই দীর্ঘ সবুজ জঙ্গল ঘিরেই এখানকার প্রান্তভূমির সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনের এক অনুপম ছন্দ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের গ্রাম দিয়ে ঘেরা এই এলাকা। উপছে পড়া বন্য রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বুকে আছে অতীতের না বলা বর্ণময় নীরব ইতিহাস। সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খুজে পাওয়া যায় বুদ্ধদেব গুহর কালজয়ী উপন্যাসে। বুড়াবুড়ি পাথরকুসি, বিদ্যাভান্ডার নামের নানান পাহাড় চারদিকে ঘিরে রেখেছে রূপসী বাংরিপোসিকে। ছমছমে আরণ্যক পরিবেশে নানা দিক দিয়ে ব্রাহ্মণ কুন্ডে যাওয়ার পথ রয়েছে। সে পথ কখনো পীচের, কখনো কংক্রীটের, কখনো বা স্রেফ লাল মাটির। 

“১০ বছর বয়সে বাবার হাত ধরেই প্রথম জঙ্গলে যাওয়া৷ মা বারণ করতেন বাঘ খেয়ে নেবে বলে৷ বইটা উৎসর্গ করেছিলাম বাবা আর মাকে৷ বাবা আর মার জন্যই প্রথম জঙ্গলে যেতে পেরেছিলাম৷ এই বইয়ের বেশিরভাগ গল্পই প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে৷ সেই গল্পগুলোকে একসঙ্গে ‘জঙ্গলমহল’ নাম দিয়ে বের করেছিলাম ....
 আমি বন্দুক চালাতাম আর গুলি গিয়ে লাগত বাঘের কপালের ঠিক মাঝখানে৷ বাবা আমাকে সাবাস বলতেন৷ একসময় প্রচুর শিকার করেছি৷ তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে কত পাখি যে মেরেছি৷ এই বৃদ্ধ বয়সে সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে অনুতাপ হয়৷ ১৯৭২-এ শিকার বেআইনি হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি আর বন্দুক রাইফেলে হাত দিইনি৷ শিকারের অনেক ভালো দিক আছে৷ এই যে অজন্তা, ইলোরা, তারপর নৈনিতালের লেক-সবই তো শিকারিদের আবিষ্কার৷ শিকারি ছাড়া কে ওইসব দুর্গম জায়গায় যাবে? আদিবাসীদের নিয়ে যে আমারে এত লেখা, শিকারে না গেলে তাদের সঙ্গে না মিশলে পারতাম নাকি? শিকারে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশেছি,কলকাতায় ফিরে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করেছি৷ তারপর মোটা মোটা উপন্যাস লিখতে  পেরেছি।"

 

সমকালীন বাংলা সাহিত্যে পাকাপাকি ভাবে নিজের জায়গা গড়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জঙ্গল মহল’-এর পর থেকে ‘মাধুকরী’, ‘অববাহিকা’, ‘বাবলি’ - একের পর এক উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। কিশোর সাহিত্যেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর সৃষ্ট ‘ঋজুদা’ বা ‘ঋভু’র মতো চরিত্র আকৃষ্ট করে রেখেছে কয়েক প্রজন্মের বহু কিশোর-কিশোরীর মনকে। 'সবিনয়ে-নিবেদন', 'চাপরাশ' প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। রাজ্যের সম্মাননীয় নাট্যব্যক্তিত্ব,সাহিত্যিক ও শিক্ষামন্ত্রী শ্রী ব্রাত্য বসুর সাম্প্রতিকতম ছবি 'ডিকশনারি' বুদ্ধদেব গুহর 'বাবা হওয়া' এবং 'স্বামী হওয়া' দুটি ছোট গল্পের আধারে তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহুল চর্চিত। ১৯৭৬ সালে তিনি 'আনন্দ-পুরস্কার' পান, এবং পরবর্তীকালে 'শিরোমনি-পুরস্কার' এবং 'শরৎ-পুরস্কার' সম্মানে ভূষিত হন। পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকদের কাছে তিনি ছিলেন অগ্রজপ্রতিম। তিনি বেঁচে থাকবেন সব সময় পাঠকের হৃদয়ের মানচিত্রে চিরজীবী হয়ে।

তথ্যসূত্রঃ নানান ধরনের গবেষণা মূলক পত্রিকা ও আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা, ফিচার, অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত  

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top