নাটা (ছোট গল্প) : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৬ নভেম্বর ২০২১ ০১:২২

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩১

ছবিঃ : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

পাঁচটা দোকান ঘুরে তবে জুতোটা পেল সুখেন, নতুন জুতো কিনতে গেলেই এই সমস্যাটা পোহাতে হয়, ইঞ্চি তিনেক হিল না হলে সুখেনের চলে না, ছেলেদের জুতোয় অতটা হিল খুঁজতে একটু বেগ পেতে হয়, তারপরেও পাপিয়া ফ্ল্যাট চটি পরবে, না কি হিল, তার উপর নির্ভর করে; সুখেন ওর পাশে পাশে হাঁটবে না দু’ফুট আগে পিছে।

অথচ ক্লাস টেনে পড়ার সময় যখন সুখেন পাপিয়াকে প্রেম নিবেদন করেছিল তখন সে পাপিয়ার থেকে পুরো এক ইঞ্চি লম্বা ছিল। সেই সময় বারাসাত আরিফগঞ্জের ছেলে সুখেনকে পুরো বারাসাত মহকুমা এক ডাকে, ‘বাইসাইকেল সুখেন’ নামে চিনত, পাঁচ ফুটের আন্ডারহাইটের ফুটবল টুর্নামেন্ট মানেই সুখেনের বেস্ট প্লেয়ার, টপ স্কোরারের পুরস্কার বাঁধা, আর বাইসাইকেল কিকে ও গোল করবেই, ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো শূন্যে শরীর বেঁকিয়ে মারা সেই কিকের খ্যাতিতে তার নামের আগে, ‘বাইসাইকেল’ তকমা লেগে যায়, তখন রীতিমতো নায়ক সুখেনকে পাড়ার মেয়ে পাপিয়াও নায়ক মেনেছিল। তারপর কেন জানে সুখেনের হাইট পাঁচ ফুটেই আটকে গেল, কলেজের থার্ড ইয়ারে এসেও সুখেন পাঁচ ফুট, পাপিয়া কিন্তু এখন পাঁচ ফুট দুই, বড্ড হীনমন্যতায় ভোগে সুখেন, বন্ধুরাও এখন, ‘নাটা’ বলে ডাকে। বাইসাইকেল সুখেন এখন পরিণত হয়েছে, নাটা সুখেনে। যবে থেকে সুখেন বুঝল, পাপিয়া তাকে মাথায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে তবে থেকেই ফুটবলও সুখেনকে ছেড়ে গেল, মন দিয়ে খেলতেই পারল না, পাপিয়াও ছেড়ে যাবে হয়তো, কোন মেয়ে আর নিজের থেকে বেঁটে ছেলেকে বিয়ে করবে? সুখেন সব বোঝে, তবু পাপিয়াকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না।
এলাকার উঠতি প্রোমোটার রতন আজকাল পাপিয়ার পেছনে খুব লেগেছে, ওর অনেক ক্ষমতা।

পাড়ার ক্লাবে রবিবার সন্ধ্যায় সুখেন তার তিন বন্ধু সুদীপ, বিমল আর অতীনের সঙ্গে ক্যারম খেলছিল, যদিও ওর মন পড়ে ছিল ক্লাব ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। আটটা নাগাদ পাপিয়া নাচের ক্লাস থেকে ফিরবে, সুখেনের নতুন তিন ইঞ্চি হিল ওকে সেই সময় ক্লাবের বাইরে এসে পাপিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলার ভরসা যোগাচ্ছে। সুখেন বন্ধুদের, “নাটা, খেলায় মন দে।” খোঁচায় সংবিৎ ফিরে পেল। ওর বন্ধুরা কেউ নাটা নয়, সুদীপ আর বিমল তো রীতিমতো লম্বা, অতীনও মাঝারি উচ্চতার।

সুখেনের হাতে স্ট্রাইকার, বেসের একটা ঘুঁটি ফেলবার জন্য লক্ষ স্থির করছে, তখনই আর্তনাদটা শুনল সুখেন, পাপিয়া একটা চিৎকার করে দৌড়ে তাদের ক্লাবে ঢুকে এসেছে, পেছনে রতন, ওর একহাতে একটা ভোজালি, অন্য হাতে পাপিয়ার ওড়না, অশ্লীল একটা গালাগাল দিয়ে রতন সুখেনদের বলল, “সরে যা, মাগীটা বহুত ছেনালি করছে, তুলে নিয়ে গিয়ে আজ ফুলশয্যা করব।” সুখেনের বন্ধুরা আতঙ্কে চুপ, ক্যারম বোর্ডের আলোয় রতনের ভোজালিটা ঝলসে উঠল, সুখেন ফ্লাডলাইটের আলোয় দেখল বলটা বক্সের মাথায় ভেসে আসছে, অনেকদিন পরে সুখেন শরীরটা শূন্যে ভাসিয়ে দিল, বাইসাইকেল কিকটা অব্যর্থ লক্ষে রতনের চোয়ালে আছড়ে পড়ল, ছিটকে পড়া রতনের ভোজালি আর পাপিয়ার ওড়না তুলে নিয়ে যখন সুখেন উঠে দাঁড়াল, তখন নাটা সুখেনের মাথা ক্লাবের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে।

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top