সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

পাখি ও স্বপন কবিরাজের বউ : হাসান আলী


প্রকাশিত:
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:৩০

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:২৮


তখন বয়স আমার চৌদ্দ। নবম শ্রেণীতে পড়ি। সারাদিন কাটে খেলাধুলা আর সাঁতার কেটে। পড়াশোনায় একদম মন নেই। একটা কবিতা আমার খুব মনে ধরেছিল। কবিতায় একটি লাইন হলো, তোমরা না হয় শিখছ পড়া মানুষ হওয়ার জন্য-আমি না হয় পাখি হবো পাখির মতো বন্য। আমার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত পরিবারের সদস্যদের চাপের মুখে স্কুলে যেতে শুরু করলাম। স্কুলের শিক্ষকদের কঠিন তদারকি আমাকে অস্থির করে তুললো। স্কুল পালানোর জন্য মনটা আকুল হয়ে উঠলো। এ রকম জটিল সময়ে স্কুলে নতুন অতিথি আসলো। সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হলো। মেয়েটির নাম আলেয়া আকতার পাখি। গ্রামের জীর্ণশীর্ণ হাই স্কুলটি যৌবনে ফিরে এলো। ছাত্র-শিক্ষক সবাই উৎসুক হয়ে উঠে পাখির স্কুলে যাওয়া-আসার সময়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ছাত্রদের পোশাক-আশাক, চলন-বলন বদলে যেতে লাগলো। আমি পাখির প্রেমে পড়লাম। মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চাল-ডাল-পাট-মরিচ বেচে দুটো শার্ট বানালাম এবং দুটো লুঙ্গি কিনলাম। পাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য স্কুলের খেলাধুলা-নাটক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় থাকলাম। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হলাম। পুরস্কার নিয়ে যাবার সময় পাখি আমাকে দেখে হাসলো। ছুটির পর বুঝতে পারলাম স্কুলের দশ-বারজন ছেলে পাখির সাথে প্রেম করতে চায়। আমি হতাশ হলাম। কারণ, আমি মোটামুটি গরিব এবং দেখতে শুনতে ভালো না। পাখির মন পেতে যে লড়াই চলছে তাতে আমি হারবো নির্ঘাত। সমবয়সী এক ফুফুকে পাখির কথা বললাম। ফুফু আমাকে বললো, 'তোর পিঠের ছাল তুলে ফেলবে পাখির বাপ। বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াস্ না।' সারাক্ষণ পাখির কথা মনে পড়তো। কিভাবে পাখিকে আমি পাবো সেই চিন্তা করতে থাকতাম। অবশেষে মাথায় বুদ্ধি আসলো। বুদ্ধিটা হলো স্বপন কবিরাজের কাছে যাওয়া। তিনি আমাদের এলাকার বিখ্যাত কবিরাজ। যাদু-টোনা-বান-তাবিজের জন্য সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। জ্বীন-ভূত-প্রেত তার শিষ্য। একদিন সকাল বেলা চুপিচুপি স্বপন কবিরাজের বাড়িতে হাজির হলাম। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বললাম, পাখিকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমার কথা শুনে স্বপন কবিরাজের ছোট বউ মুখে আঁচল ঢেকে উঠে গেলো। কবিরাজ আমাকে বললো, 'কাজটা কঠিন। খরচ-পত্র লাগবে। তোমার দাদা শুনলে আমাকে বকবে।' আমি নাছোড়াবান্দা। অবশেষে কবিরাজ রাজি হলো। আমি কবিরাজকে জানলাম হরিণের চামড়া ছাড়া আর সবকিছু যোগাড় করতে পারবো। কবিরাজ হরিণের চামড়ার দায়িত্ব নিলেন। আমি মায়ের গলার সোনার তাবিজ চুরি করে এনে কবিরাজের হাতে দিলাম। কবিরাজ আমাকে একটা তাবিজ দিলেন। সেটা বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে পাখিদের বাড়ির পাশের খালের মাঝখানে পুঁতে দিতে হবে। জোয়ার-ভাটার সময় বাঁশের কঞ্চি নড়বে তাতে পাখির মনটা আমার জন্য নড়বে। আরেকটা তাবিজ স্কুলের যে বেঞ্চিতে পাখি বসে তার নিচে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দিতে হবে। আরেকটা তাবিজ পাখিদের দরজার সামনে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। পাখিদের বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজার সামনে তাবিজ পুঁতে রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ওদের বাড়ির কুকুরগুলো ভয়ঙ্কর। অবশেষে এক বৃষ্টির রাতে লাঠি হাতে পাখিদের বাড়িতে তাবিজ পুঁতে এলাম।

একদিন স্কুলের টিউবওয়েলে পানি খাচ্ছিলাম। এমন সময় পাখি টিউবওয়েলের কাছে আসলো। আমাকে দেখে হাসলো। বললো, 'মুকুল ভাই টিউবওয়েলটা চাপেন আমি পানি খাবো।' মুহূর্তে আমি আকাশে ভেসে বেড়াতে লাগলাম। পানি খেয়ে পাখি হন হন করে হেঁটে স্কুলে চলে গেলো। শুধু এটুকুতেই দারুণ সুখ পেলাম। স্বপন কবিরাজের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, খুব বেশি দেরি হবে না পাখিকে পেতে। তারপর দিন যায় সপ্তাহ যায় মাস যায় পাখি আর আমাকে পাত্তা দেয় না। স্বপন কবিরাজের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে হরিণের চামড়ার উপর লেখা তাবিজ দিলেন। এটির হাদিয়া ছিলো একশ' টাকা। বহু কষ্টে এই টাকা যোগাড় করেছি। এই তাবিজ রাতে এক গ্লাস পানিতে ছুবিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খেতে হবে। এভাবে একুশ দিন খেয়েছি। কোনো কাজ হলো না। পাখি কথা বলে দশম শ্রেণির কাজলের সাথে। স্কুল ছুটি হলে দশম শ্রেণীর সিরাজের সাথে বাড়ি যায়। ডাকাবুকা সিরাজকে দেখলে আমি ভীষণ ভয় পাই। পাখির জন্য উতলা অনেকেই। চার পাঁচজন ছাড়া বাকিদের পাত্তা নেই। স্বপন কবিরাজের বাড়িতে আবার গেলাম। কবিরাজ বাড়িতে নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। কবিরাজের ছোট বউ বৈঠকখানায় আমাকে গুড়-মুড়ি আর এক গ্লাস দুধ খেতে দিল। কবিরাজের বউ আমার সামনে বসলো। মাথায় শাড়ির আঁচল নেই। মাথাভর্তি চুল। গলায় সোনার তাবিজ। আমার মায়ের সোনার তাবিজ বলে মনে হলো। আমার বউকে এ সোনার তাবিজগুলো মা দেবেন বলেছিলেন। কবিরাজের বউটার বয়স ষোল সতের হবে। তিনি শান্তু কণ্ঠে বললেন, 'কবিরাজের তাবিজে কিছু হয় না। তুমি শুধু শুধু কষ্ট করছো।' আমি বললাম, 'আমরা যে শুনি আপনাকে তাবিজ করে পাগল বানিয়ে কবিরাজ বিয়ে করেছে। এটা কি মিথ্যে?' কবিরাজের বউ খিল খিল করে হেসে উঠে বললো, 'বাবা আমাকে কবিরাজের কাছে বেচে দিয়েছেন।' হঠাৎ করে পাখির মুখের ছবিটা কবিরাজের বউয়ের মুখে এসে বসলো। পাখির মুখ আর কবিরাজের বউয়ের মুখ এক হয়ে গেলো। আমার গা কাঁপতে লাগলো। চোখ জ্বালা করতে লাগলো। মাথা ঘুরতে লাগলো। হড়হড় করে দরজার বাইরে গিয়ে বমি করলাম। কবিরাজের ছোট বউ আমার মাথায় ধরে রাখছে। হাত ধরে এনে চকিতে শুইয়ে দিল। ভিজা গামছা দিয়ে মুখ মুছে দিল। এক গ্লাস পানি খাওয়ালো। কবিরাজের বউয়ের স্পর্শ আমাকে দ্রুত শান্ত করে দিল। কবিরাজের বউয়ের স্পর্শ আমাকে দ্রুত শান্ত করে দিল। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। জেগে দেখি, কবিরাজ আমার পাশে বসে রয়েছেন। কবিরাজকে দেখে আমার ভীষণ রাগ হলো। তাকে বললাম, 'আপনার তাবিজ ভুয়া, কোনো কাজ হয় না। আমার টাকা পয়সা ফেরৎ দেন।' কবিরাজ আমাকে বসিয়ে নতুন তাবিজ লিখলেন। নিশ্চয়তা দিলেন সাত দিনের মধ্যে কাজ হবে। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। সাত দিনের মধ্যেই পাখির বিয়ে হলো এক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। অবশেষে পাখি উড়ে গেল। স্বপন কবিরাজের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো। কোমরে চাকু গুঁজে কবিরাজের বাড়ি হাজির হলাম। বৈঠকখানায় কবিরাজকে একা পেয়ে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কবিরাজের চিৎকারে ছোট বউ এসে আমাকে ঝাপটে ধরলো। কবিরাজ আমার হাত থেকে ছুটে পালিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে কবিরাজকে গালাগালি করছিলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। কবিরাজের ছোট বউ আমাকে দু' হাত দিয়ে বুকে আটকে রাখলেন। আমাকে শান্ত করতে গালে-কপালে বেশ কয়েকটি চুমু দিলেন। ততক্ষণে বেশ কিছু লোক জড়ো হলেন। নানাজন নানা রকম মন্তব্য করলেন। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। পাখির কথা ভাবতেই পাখির মুখটা দ্রুত কবিরাজের ছোট বউয়ের মুখের মতো হয়ে যায়। আবার কবিরাজের ছোট বউকে ভাবলে পাখির মুখ এসে পড়ে।

লেখক : বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top