সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

মনসা দেবী ও পূজার ইতিহাস : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২২ ০১:৪৮

আপডেট:
২৪ আগস্ট ২০২২ ০১:৫০

 

মনসা হলেন সাপের দেবী। ভারতবর্ষে সাপের পূজা একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। তিনি মূলত লৌকিক দেবী। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনসা দেবীর পূজা করে থাকে। মনস্ শব্দের উত্তর আপ প্রত্যয় যোগ করে মনসা শব্দের উৎপত্তি। বুৎপত্তিগত অর্থে মনসা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পূরাণ মতে সর্পভয় হতে মনুষ্যগণকে পরিত্রাণের জন্য ব্রহ্মা কাশ্যপ মুনিকে মন্ত্র বা বিদ্যা বিশেষ আবিষ্কারের জন্য আদেশ করেন। ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ মুনি যখন মনে মনে এ বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করছিলেন তখন তার মন থেকে এক দেবীর সৃষ্টি হয়। প্রথমত মনসা কশ্যপ মুনির মানসকন্যা। কারণ মানব কল্যাণে ঔষধ আবিষ্কারের কথা ভাববার সময় মধ থেকে দেবীর সৃষ্টি হয় বলে তার নাম মনসা (দেবী ভাগবত পূরাণ)। মনসা একজন লৌকিক ও সাপের দেবী। প্রধানত বাংলা এবং উত্তর ও উত্তর পূর্ব ভারতে অন্যান্য অঞ্চলে মনসা দেবীর পূজা প্রচলিত আছে। সর্প দংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্প দংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্য লাভের উদ্দেশ্যে তার পূজা করা হয়। মনসা হলেন বাসুকীর ভগিনী এবং ঋষি জগৎকারুর স্ত্রী এবং কশ্যপ মুনির কন্যা। তার অন্য নাম হল বিষহরি ও পদ্মাবতী। অন্যদিকে পুরাণ অনুসারে মনসার পিতা শিব ও স্বামী জগৎকারু। স্বামী জগৎকারু মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মনসার সৎমা চণ্ডী তাকে ঘৃণা করতেন। এ কারণে মনসা অত্যন্ত উগ্র স্বভাবের এবং অসুখী এক দেবী। জন্ম সংক্রান্ত সমস্যার কারণে মনসার পূর্ণ দেবীত্ব প্রথম অস্বীকার করা হয়েছিল। তাই মনসার উদ্দেশ্য ছিল তাকে দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। অথর্ব বেদ অনুসারে সর্প দেবী হিসেবে মনসার প্রথম উন্মেষ পাওয়া যায়। পূরাণে তাকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগজননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে। ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত মনসা প্রজনন ও বিবাহের দেবী হিসেবে চিহ্নিত হন। মঙ্গলকাব্য অনুসারে মনসার দেবী হলেন শিবের মানসকন্যা এবং নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী। পদ্ম পাতায় জন্ম বলে মনসার আরেক নাম পদ্মাবতী। নিজ কন্যাকে কৈলাসে নিয়ে আসলে দেবৈ পার্বতী মনসার একটি চোখ নষ্ট করে দেন। মহাদেব বুঝতে পারেন মনসা কৈলাসে থাকলে বিপদ হতে পারে। মনসা কে দেখভালের জন্য দূরে নেত্রী নামক এক দাসীর কাছে রেখে আসেন। নেত্রী আবার স্বর্গের দেবতাদের কাপড় কাচেন মানে ধোপা। মনসা ও জগৎকারু র পুত্র সন্তানের নাম আস্তিক। একদিন সামান্য কারণে মনসার স্বামী মনসাকে পরিত্যাগ করেন।
কিংবদন্তী অনুসারে শিব বিষ পান করার পর মনসা তাকে রক্ষা করেন এবং বিষহরা বা বিষহরি নামে পরিচিত হন। শেষে শৈব ধর্ম এই আদিবাসী দেবীকে ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
মনসার মূর্তি তে সর্প পরিবেষ্টিত নারী রুপে দেখা যায়। তিনি একটি পদ্মের উপর বসে থাকেন। সাতটি গোখরা সাপের ফনা তার মাথার উপর বিরাজ করে। কোন কোন মূর্তিতে মনসার কোলে একটি শিশু দেখা যায়। সম্ভবত তার পুত্র আস্তিক। তার এক চোখ কানা। কিংবদন্তী অনুসারে তার সৎমা চন্ডী তার একটা চোখ পুড়িয়ে দিয়েছিল। বিপ্রদাসের মনসা বিজয় কাব্য অনুসারে বাসুকীর মাতা একটি বালিকার মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। সেই মূর্তিতে শিবের বীর্য নিক্ষিপ্ত হলে তা থেকে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী মনসাকে নিজ ভগিনী বলে মেনে নেন। বাসুকী মনসাকে বিষের কতৃত্ব প্রদান করেন। মনসা শিবকে পিতৃপরিচয় দান করলে শিব মনসাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান।
মনসামঙ্গলের আরেক কাহিনী মতে মনসার জন্ম কোন নারীর গর্ভে হয় নাই। শিবের বীর্য পদ্মপাতায় রাখলে সেখান থেকে তা পদ্মনাল বেয়ে পাতালে নেমে যায়। সেখানেই মনসার জন্ম হয়।

দেবী মনসার জন্ম সম্পর্কে পদ্মাপূরাণে লিখিত আছে, মহাদেব শিব হিমালয়ে উত্তরে অবস্থিত তাঁর বাসস্থান কৈলাসে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কালিদহের তীরে আসন গ্রহণ করেন। সেই সময়ে তাঁর সম্মুখে পার্বতির সৃষ্ট পুষ্পকাননের শোভা ভেসে ওঠে এবং তা দেখে তিনি মুগ্ধ হন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী-পার্বতিকে মনে পড়ে এবং বীর্যস্খলন হয়। মহাদেব তা সংরক্ষণের জন্য পদ্মপাতার ওপরে রেখে দেন। কিন্তু একটি পাখি তা খেয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে ডিম পাড়ে, সেই ডিম পাতালপুরীতে বাসুকিরাজের প্রাসাদে পতিত হয় এবং ডিম থেকে পদ্মার জন্ম হয়।
এক সময় মনসা মানবভক্ত সংগ্রহের জন্য মর্ত্যে নেমে আসেন। প্রথম দিকে মানুষ উপহাস করলেও মনসার রোষানলে পড়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে তার পূজা করেন। এক সময় মুসলমান শাসক হাসানকে মনসা ভক্ত বানিয়ে নেন। লক্ষ্মী সরস্বতী র মতো দেবী হতে চাঁদ সওদাগরের পূজা গ্রহণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চাঁদ তার পূজা করবেন না বলে সংকল্প করেছিলেন। মনসা একে এক চাঁদের ছয় পুত্রকে হত্যা করেন সর্প দংশনের মাধ্যমে। এক সময় মনসা ইন্দ্রের রাজসভার দুই নর্তক নর্তকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। তাদের নো ছিল ঊষা এবং অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ চাঁদ ও সনকার সপ্তম পুত্র রুপে জন্মগ্রহণ করল। তার নাম লখিন্দর। আর ঊষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করেন উজানী নগরে সায়বেনের কন্যা রুপে। এক সময় বেহুলা ও লক্ষিন্দরের বিয়ে হয়। মনসা লোহার বাসরঘরে সাপ দিয়ে লক্ষিন্দরকে মেরে ফেলে। লোহার তৈরি বাসরঘরে মনসা বিশ্বকর্মাকে ভয় দেখিয়ে একটি ছিদ্র রেখে দেয়। সেই ছিদ্র দিয়ে কালনাগিনী ঢুকে লক্ষিন্দরকে ধ্বংসন করলে লক্ষিন্দর মারা যায়। বেহুলা স্বামীর লাশ নিয়ে ভেলায় ভেসে ইন্দ্রপুরীতে যায়। সেখানে নৃত্য করে দেবতাদের খুশি করলে তারা লক্ষিন্দরের জীবন ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়। তবে শর্ত থাকে মনসার পূজা করতে হবে চাঁদ সওদাগর কে । বেহুলা তূ স্বামী লক্ষিন্দর ও চাঁদের ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে আনে মনসার পূজা দেবার বিনিময়ে। শেষে চাঁদ সওদাগর মনসার দিকে না তাকিয়ে বা হাতে ফুল দিয়ে পূজা করেন। মনসূ এতেই খুশি হয়ে চাঁদ সওদাগরের পুত্রদের জীবন ফিরিয়ে দেন। এভাবে পৃথিবীতে মনসার পূজা চালু হয় এবং আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top