মুক্তির মিছিল : মশিউর রহমান
প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৩৯
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩১

১.
অরণ্য। পাহাড়ি অরণ্য। অবাধে মনের আনন্দে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য গাছগাছালি। সেগুলো এত ঘন যে সূর্যের আলো নিচের মাটিতে পড়ার সুযোগ খুব বেশি পায় না। বছরের এ সময় প্রচণ্ড শীত থাকে। তবে এবারের মাঘ মাসটি ছিল অনেকটাই উষ্ণ। গ্রামের মানুষ অনেকেই চাদর-মাপলার ছেড়েছে। পাতা ঝরার দিন। গোটা অরণ্যভূমি ঝরাপাতায় ঢেকে যাচ্ছে। ঝরাপাতার কত যে রং! কোনোটি জাফরানের মতো হলুদ, কোনোটি ওয়াইনের মতো লাল, কোনোটির রং সোনারোদের মতো চকচকে, কোনোটি ধূসর, আবার কোনোটি মিশ্র রঙের। বুড়িয়ে যাওয়া পাতাগুলো সামান্য বাতাসেই মাটিতে ঝরে পড়ছে। টুপটাপ। চুপচাপ। দিন কিংবা রাত যার যখন সময় হচ্ছে তখনই সে ঝরে পড়ছে। ঝরা পাতাগুলো জমতে জমতে অরণ্যের নিচেটা একটা পুরু কার্পেট বিছানোর মতো হয়ে গেছে। পাতাগুলোর সতেজতা হারানো কিংবা রস শুকিয়ে গেলেও একধরনের বুনোগন্ধ রয়ে গেছে। অরণ্যের মৃত্তিকা পর্যন্ত সূর্যের প্রবেশাধিকার নেই। তারপরও কখনো কখনো কোনো গাছের ডালের ফাঁকফোকর গলে এক-আধটু সূর্যের আলো ঝরা পাতাগুলোর উপর ক্ষণিক পরশ বুলিয়ে যায়। প্রচণ্ড শনশনে বাতাস কিংবা মাঝারি আকারের ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া অরণ্যে আশ্রিত পতঙ্গগুলো ঝরাপাতার উপর ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে ঝরাপাতার কার্পেটের নিচে ঝিঁঝিপোকা, পাহাড়ি ইঁদুরসহ নানা জাতের ক্ষুদে প্রাণির নিরাপদ আশ্রয়।
২.
কেরামত ও করিমন এরা স্বামী-স্ত্রী। চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে বসবাস। কেরামতের বয়স আশি ছুঁইছুঁই। করিমনের বয়সও ষাটের কাছাকাছি। তাদের ঘরে চার পুত্র আর দুই কন্যা। ছোটকন্যার বিয়ে হয়েছে বছর চারেক। তারপর থেকেই কেরামত ও করিমন একেবারে নিঃসঙ্গ। এখন তাদের দেখাশোনার কেউ নেই। নিজেরা নিজেদের মতো করে নিজেদের নাওয়া-খাওয়া থেকে শুরু করে সকল প্রয়োজন মেটায়। একজন আরেকজনের পরিপূরক।
দিন কাটে। মাস যায়। বছর পেরিয়ে বয়ে যায় সময়। কখনো কখনো পুত্র-কন্যারা খবর নিয়ে যায় বৃদ্ধ পিতামাতার। তারা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজের মতো করে দিন কাটাচ্ছে। বৃদ্ধ পিতামাতার ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবার খুব বেশি সময় তাদের হয় না। ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে করিমন কখনো কখনো উতলা হয়ে ওঠেন। ছেলেমেয়েদের দেখতে ইচ্ছে হয়। দেখা মেলে না।
কেরামত করিমনকে আশা-ভরসার কথা শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখেন। তিনি বলেন, আমি যতক্ষণ আচ্ছি কিংবা তুমি যতক্ষণ আছ ততক্ষণ আমরা চিন্তা না করি। উতলা না হই। তোমাকে বারো বছর বয়সে ঘরে এনেছিলাম। সবাই তোমাকে খুকি বলে ডাকত। সেদিনের সেই খুকি এখন বৃদ্ধা করিমন।
দুজনের মুখেই একচিলতে মিষ্টি হাসির রেখা। কেরামত করিমনের কোলে মাথা রাখেন। আবার সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে যান। করিমন কেরামতের মাথায় পাতলা হয়ে আসা পাকা চুলের মধ্যে বিলি কাটেন।
৩.
মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন এলো প্রকৃতিতে। অরণ্যের গাছের সব পাতা ঝরে যাচ্ছে। একটি গাছের একেবারে শেষ শাখায় দুটি পাতা তখনো অবশিষ্ট। বৃষ্টি, কুয়াশা, ঠাণ্ডা ও বাতাসের দাপটের মাঝেও কোনো অজ্ঞাত কারণে পাতাদুটো ঝরে পড়েনি। কেন ঝরেনি তা তারা নিজেরাও জানে না। একটি পাতা ঝরে যায় আরেকটি পাতা রয়ে যায় কেন? এর কারণ কি কেউ বলতে পারে? কিন্তু ওই পাতাদুটোর বিশ্বাস যে তাদের দু’জনের পরস্পরের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা রয়েছে, তার মধ্যেই এ প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে। একটি পাতা আরেকটির চেয়ে আকারে সামান্য বড়, তার বয়সও কয়েকদিন বেশি সে একটু উঁচুতে আর আরেকটি পাতা একটু নিচুতে অবস্থান। তবে দুজনের মধ্যে নিচের পাতাটি দেখতে সতেজ, সবুজ ও আকর্ষণীয়। যখন ঝোড়ো বাতাস বয়, মুষলধারে বৃষ্টি ঝরে কিংবা শিলাবৃষ্টি হয়, তখন একটি পাতার জন্য অন্য পাতার কিছুই করার থাকে না। তা সত্বেও সুযোগ পেলেই ওরা একে অপরকে সাহস যোগায়। ঝড়-বৃষ্টির সময় যখন বজ্রপাত হয়, বিদ্যুৎ চমকায় তখন ওরা একে অপরের জন্য খুবই চিন্তায় থাকে। প্রবল বাতাস শুধু পাতাই উড়িয়ে নেয় না, কখনো কখনো গাছের ডালও ভেঙে ফেলে। উপরের পাতাটি তখন নিচের পাতার কাছে আবেদন জানায়, ভয় পেয়ো না সোনা। আঁকড়ে থাক। সকল শক্তি দিয়ে নিজেকে আঁকড়ে রাখো।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও ঝড়ের রাতগুলোতে নিচের পাতাটি ভীত হয়ে বলে, আমার ঝরে পড়ার সময় এসে গেছে, কিন্তু তুমি যেন ঝরে পোড়ো না। আঁকড়ে থাক।
কেন? প্রশ্ন করে উপরের পাতাটি, তুমি যদি না থাক তাহলে আমার জীবন অর্থহীন। তুমি যদি ঝরে পড়, আমিও তোমার সাথে ঝরে পড়ব।
বড়ো পাতাটি বলে, না সোনা, তুমি এটা কোরো না। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ টিকে থাকতে পারে ততক্ষণ তার ঝরে পড়ার কথা ভাবা ঠিক নয়।
নিচের পাতাটি জবাব দেয়, সব কিছুই নির্ভর করে তুমি আমার সাথে থাকছ কিনা, তার উপর। দিনের বেলা আমি তোমার দিকে চেয়ে থাকি। তুমি যে কি সুন্দর! আমি প্রাণভরে তোমার সৌন্দর্য উপভোগ করি। রাতের বেলায় তোমার সুগন্ধ অনুভব করি। তুমি ঝরে গেলে আমি একা এই গাছের ডাল আঁকড়ে থাকতে পারব না। কখনোই না।
৪.
ফাল্গুনের শুষ্ক আবহাওয়া। বাতাসে একটুও আর্দ্রতা নেই। কেরামত ও করিমন একে অপরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বিশ্বাস আর নির্ভরতা নিয়ে এতোটা বছর একসাথে কাটিয়েছে। কেরামত করিমনকে বলে, আমি প্রথমদিন যে খুকিকে দেখেছিলাম এখনো তুমি আমার চোখে তেমনি খুকিটিই আছ। আমার চোখে তুমি কখনোই বড়ো হবে না। বুড়ো হবে না। আজও তুমি আমার চোখে চিরনতুন।
করিমন বলে, তোমার কথাগুলো যে কি মিষ্টি! কিন্তু সব তো সত্য নয়। তুমি খুব ভালোই জানো যে, আমি আর সুন্দর নই। দ্যাখো, আমার শরীরে ভাঁজ পড়ছে, শিরাগুলো কুঁচকে যাচ্ছে। হাতের আঙুলের শিরাগুলো দড়ির মতো মোটা হয়ে উঠছে। তবে এখনো আমার মধ্যে যেটা অপরিবর্তিত আছে তা হচ্ছে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। অগাধ ভালোবাসা। অগাধ বিশ্বাস। অপরিসীম নির্ভরতা।
কেরামত বলে, এটাই কি যথেষ্ট নয়? আমাদের সকল শক্তির মধ্যে ভালোবাসা হচ্ছে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম। যতদিন আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব ততদিন এখানে থাকব। পৃথিবীর কোনোকিছুই আমাদেরকে আলাদা করতে পারবে না। তোমাকে আমি একটি কথা বলতে চাই করিমন।
করিমন বলে, বলো। নির্ভয়ে। নিঃসঙ্কচে।
কেরামত বলে, তোমাকে আমি এখন যতটা ভালোবাসি, আগে আর কখনো এতটা ভালো বাসিনি। তোমাকে আমি এখন যতটা নির্ভর করি আগে কখনো এতেটা নির্ভর করিনি।
করিমন বলে, সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে সংসারের সমস্ত কাজকর্মে ব্যস্ত থেকে তোমাকেও আমি এতোটা উপলব্ধি কখনো করিনি। তুমিই যে আমার ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল সেটা এতোদিনেই বুঝেছি।
৫.
প্রকৃতিতে ফাল্গুনের শেষ।
অরণ্যে গাছ আঁকড়ে থাকা উপরের পাতাটি বলে, কোনো বাতাস, কোনো বৃষ্টি, কোনো ঝড়-তুফান আমাদের ধ্বংস করতে পারবে না।
নিচের পাতাটি বলে, কেন? আমি তো এখন সৌন্দর্য, রূপ-লাবণ্য সব হারিয়ে হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেছি। যেকোনো সময় ঝরে পড়ব।
উপরের পাতাটি বলে, কে বলেছে যে, যখন সবুজ ছিলে তখনই তুমি সতেজ আর সুন্দর ছিলে, আর এখন একটু হলুদ একটু ফিকে হয়েছো বলে তুমি সুন্দর নও? আমার চোখে তোমার সব রংই সমান সুন্দর।
উপরের পাতাটির কথা বলা শেষ হওয়ার পরপরই একটা দমকা বাতাস ধেয়ে এল এবং ডালের সাথে আঁকড়ে থাকা বন্ধন নড়বড়ে করে দিল। তার অবস্থা দেখে নিচের পাতাটি ভয়ে-আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। তার মনে হল, সেও বোধহয় এখনই ঝরে পড়বে। সর্বশক্তিতে সে ডাল আঁকড়ে থাকতে চাইল।
নিচের পাতাটি বিস্ফারিত চোখে দেখল- উপরের পাতাটি আর নিজেকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারল না, সে ঝরে পড়ল এবং বাতাসে পাক খেতে খেতে নিচের দিকে নেমে গেল।
গাছের ডালে আঁকড়ে থাকা পাতাটি তখন ঝরে যাওয়া পাতাটির উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, ফিরে এসো সোনা, ফিরে এসো। তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়। আমি একদিনও এখানে থাকতে পারব না।
কথা শেষ হবার আগেই ঝরে পড়া পাতাটি চোখের আড়ালে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর মাটিতে জমে থাকা অন্য ঝরা পাতাদের সাথে মিশে যায়। গাছে শুধু এখন একটি পাতা। নিঃসঙ্গ। দুর্বল। অসহায়। সঙ্গীবিহীন।
৬.
প্রকৃতিতে ফাল্গুন পেরিয়ে চৈত্রের আগমন।
কেরামত ও করিমন দুজনই অসুস্থ। তবুও একে অপরের প্রতি নির্ভরতা দুজনকেই টিকিয়ে রেখেছে। প্রকৃতি এমনই। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার যাওয়ার সময় না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃতি তোমাকে কোনো-না-কোনোভাবে আগলে রাখবে। একসময় কেরামতের যাবার সময় হলো। বেশ কিছুদিন ধরেই তার বুকের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। একসময় কেরামতের বুকের ভেতর টনটনে ব্যথা শুরু হলো। গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো ঘড়ঘড়ে শব্দ। করিমন পাশে পানির গ্লাস নিয়ে বসে আছে। করিমনের বাবার মৃত্যুর সময়ও সে বাবার শিয়রের পাশে পানির গ্লাস নিয়ে বসে ছিল। তখন সে একেবারেই তরুণী। মায়ের পাশে বসে করিমনও সেদিন নিজের বাবার মৃত্যুক্ষণটা উপলব্ধি করেছিল। কিন্তু আজ তার স্বামীর শেষ সময়ে তার পাশে কেউ নেই। করিমন নিজে বুঝতে পারছে কেরামত আর ফিরবে না। তার সকল বাঁধন, নির্ভরতা, ভালোবাসার বাঁধন ছিন্ন করে কেরামত চলে যাবে। তার দুচোখ বেয়ে অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে অশ্রু গিয়ে পড়ছে কেরামতের খোলা হাড়জিরজিরে বুকের উপর। কেরামত শেষ সময়েও তা উপলব্ধি করল। করিমনের চোখের অশ্রু মোছানোর জন্য সে তার ডান হাতটা করিমনের চোখ পর্যন্ত ওঠাতে গিয়েও ওঠাতে পারল না।
করিমন অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, কেরামত তুমি যেয়ো না। আমাকে একা করে যেয়ো না। ফিরে এসো। ফিরে এসো। আমাকেও সাথে করে নিয়ে যাও।
বাতাস যেন পাড়াপ্রতিবেশীদের কানে কেরামতের মৃত্যু খবর পৌঁছে দিল। প্রতিবেশীদের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের কাছেও বাবার মৃত্যু খবর পৌঁছে গেল। সন্তানদের কেউ কেউ বাবার মৃতদেহটা শেষবারের জন্য দেখার জন্য এলেও ছোটকন্যা ও আরও দুই সন্তান আসতে পারেনি।
যতক্ষণ দিনের আলো রইল, ততক্ষণ কোনোরকমে কেরামতের শোক ভুলে থাকল করিমন। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকার যখন ঘন হয়ে এল, তখন তীরের ফলার মতো নিঃসঙ্গতার তীব্র যন্ত্রণা ও হাহাকার এসে করিমনের গায়ে বিঁধতে থাকল। করিমনের মন গভীর হতাশায় ছেয়ে গেল।
৭.
চৈত্রের দিনগুলোতে প্রকৃতি রুদ্র, রুক্ষ। বাতাসের আগুনের ফুলকি।
গাছের ডাল আঁকড়ে থাকা শেষ পাতাটি বুঝতে পারল, পাতাদের দুর্ভাগ্যের জন্য গাছই দায়ী। পাতারা ঝরে পড়ে কিন্তু গাছের কাণ্ড দীর্ঘ, বলিষ্ঠ ও দৃঢ়ভাবে মাটিতে শিকড়ের বিস্তার ঘটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠুনকো বাতাস, মুসলধারের বৃষ্টি বা বজ্রপাত তার কিছুই করতে পারে না। একটি গাছ শুধু প্রবল সুনামি কিংবা প্রবল ঘূর্ণিঝড়েই তার অস্তিত্ব বিসর্জন দেয়। দীর্ঘসময় কিংবা চিরদিন বেঁচে থাকে যে গাছ, তার কাছে একটি পাতা ঝরে যাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। নিঃসঙ্গ পাতাটির মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সমান সুযোগ দেয় না। কয়েক মাসের জন্য সবুজ পাতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা একটি গাছকে সাজায়। তারপর পাতাঝরার দিন আসে। গাছ থেকে সব পাতা ঝরিয়ে ফেলে। পাতাগুলোকে ততদিনই প্রাণরস যোগায় যতদিন সৃষ্টিকর্তার মন চায়। তারপর সেগুলোকে শুকিয়ে মারে। নিঃসঙ্গ পাতাটি সৃষ্টিকর্তার কাছে করুণ কণ্ঠে আবেদন জানায়, তার সঙ্গিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য, যাতে করে আবার তাদের জীবনে আনন্দময় সেই দিনগুলো ফিরে আসে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার কাতর আবেদনে সাড়া দেয় না।
৮.
রাত যে এত দীর্ঘ হতে পারে, এত ঘন অন্ধকার, এত কুয়াশাচ্ছন্ন করিমনের তা আগে জানা ছিল না। সে কেরামতের উদ্দেশ্যে কথা বলতে থাকে, মনে আশা যে কেরামত বোধহয় তাকে জবাব দেবে। কিন্তু কেরামতের কাছ থেকে কোনো জবাব মেলে না, সে যে আছে তার কোনো আভাসও পাওয়া যায় না।
করিমন সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলে, তুমি যখন ওকে নিয়েছ, তখন আমাকেও নাও। আমি একা কেমন করে থাকব?
করিমনের এ আবেদনেও সৃষ্টিকর্তার সাড়া মেলে না। কিছুক্ষণ পর করিমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ঠিক ঘুম নয়। অদ্ভুদ এক তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব।
গাছের নিঃসঙ্গ পাতাটিও সকালের আলোই চোখ খুলে আশ্চর্য হয়ে দেখে- সে আর গাছের ডালে ঝুলছে না। সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন বাতাস তাকে উড়িয়ে এনে মাটিতে ফেলেছে। গাছে থাকার সময় সূর্যোদয়ের সাথে সে ঘুম থেকে জেগে উঠত। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি, অন্য এক অনুভূতি। তার সকল ভয় ও উদ্বেগ মিলিয়ে যায়। জেগে ওঠার সাথে সাথে এক ধরনের সতর্কতা তার মধ্যে কাজ করে যা সে আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। সে বুঝতে পারে যে সে আর বাতাসের করুণার উপর নির্ভরশীল একটি পাতা মাত্র নয়, সে এখন রহস্যময় মহাবিশ্বের অংশ। বুঝতে পারে আণবিক, পামানবিক, ইলেকট্রন ও প্রোটনের সমন্বয়ে গঠিত অপরিসীম শক্তির অধিকারী সে। আর তা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনার অংশ মাত্র।
করিমন ঘুমের ঘোরে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল সে জানে না। হঠাৎ লক্ষ্য করে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে কেরামত। তার বয়স কমে এসেছে। প্রথম যৌবনের স্পর্শ পায় সে। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে তার। গভীর ভালোবাসায় একে অপরকে অভিনন্দন জানায়, যে ভালোবাসার গভীরতা সম্পর্কে আগেও সচেতন ছিল তারা। এটা হঠাৎ ঘটা কিংবা বানোয়াট কোনো ভালোবাসা নয়। এই ভালোবাসা রহস্যময় মহাবিশ্বের মতোই চিরন্তন ও চিরশাশ্বত। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার পর একে একে যখন সবাই তাদের থেকে অনেক দূরে চলে যায়, যখন তারা দুজন প্রতিনিয়ত একজন আরেকজনকে হারানোর ভয়ে দিন ও রাত মৃত্যুর ভয়ে ভীত থাকে। অবশেষে সেই মৃত্যুকে তারা আলিঙ্গন করেছে, কিন্তু তা নিছক মৃত্যু না হয়ে পরিণত হয়েছে তাদের পুনরুজ্জীবনে।
হঠাৎ দমকা বাতাস মাটি থেকে পাতাদুটোকে উড়িয়ে নেয়। এবার তারা মোটেই ভয় পায় না। তাদের মনে হয়, তারা এখন মুক্ত। তাদের চারপাশে অসংখ্য ঝরাপাতা অবিরাম সুখ ও মুক্তির আনন্দে শ্লোগান তুলছে। সেই মুক্তির স্বাদ অনুভব করতে করতে আর বাতাসে পাক খেতে খেতে কোথায় যেন মুক্তির মিছিলে হারিয়ে যায়।
মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড (২০১৬) এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত (১৪২৩ বঙ্গাব্দ)।
প্রকাশক, সৃজনী
অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচাল, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।
বিষয়: মশিউর রহমান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: