সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতপিটে সাঁথিয়া (পর্ব ছয়): হাবিবুর রহমান স্বপন


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২২ ০০:২০

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ১৫:৩১

 

ব্যবসা বাণিজ্যে সাঁথিয়ার জনগণ ছিল পিছিয়ে, এখনও তার তেমন উন্নতি হয়নি।
ছোটখাটো ব্যবসা থাকলেও বড় ধরনের ব্যবসা বলতে যা বোঝায় তা সাঁথিয়ায় ছিল না।
আবার বড় অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থও ছিল না। মাঝারি মানের কিছু গৃহস্থ ছিল। জমিতে একটি বা দুটি ফসল ফলতো। আবার তার ফলনও ছিল খুবই কম। এখন যেমন প্রতি বিঘা জমিতে ২০/২৫ মন ধান উৎপাদন হয়, তখন হতো ৫/৬ মন। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও তাই।
কৃষককে ফসল ফলাতে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। গরু দিয়ে হাল কর্ষণ করে মাটিকে চাষের উপযোগী করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো। কৃষক পরিবারের খাদ্য ছিল ভাত, মাছ ও ডাল।
পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা মরিচ চটকে সকালের নাস্তা অথবা বাসি ভাতের সঙ্গে শুকনা মরিচ ও পিঁয়াজ চটকে খাওয়া।
দুপুরের খাবারে মাছ শাক থাকতো। রাতে ডাল ভর্তা এবং ডাল।
যেহেতু সাঁথিয়া এলাকায় পটল, মরিচ বিভিন্ন সব্জি আবাদ হতো তাই নিজেদের উৎপাদিত সব্জি খেতে পারতো সকলেই কম বেশি। গমের চাষ হতো হেতু কৃষক পরিবারের সদস্যরা রুটি খেতো। যবের ছাতু গুড় অথবা আম দিয়ে খাওয়া হতো।
টমেটোর আবাদ শুরু হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে। সাধারণ লোকজন টমেটো খেতো না হেতু আবাদও করতো না।
রাসায়নিক সার এর ব্যবহার নিয়েও কৃষকদের মধ্যে দ্বিধা কাজ করতো।
কাঠমোল্লারা প্রচার করতো সার ব্যবহার করা মানে আল্লাহর সঙ্গে নাফরমানী করা। কৃত্রিম সার ব্যবহার করা মানে আল্লাহকে অমান্য করা আল্লহর উপর পোদ্দারি। মাত্র ৪ আনা সের ইউরিয়া সার তাও বিক্রি হতো না।
চা'য়ের দোকান এখন যত্রতত্র। তখন ১৯৬৩-৬৪ সালে সাঁথিয়া বাজারে ফ্রি বা বিনা পয়সায় চা পান করতে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করা হতো। দুধ-চিনি দিয়ে তৈরি চা বিনা পয়সায় খাওয়ানো হতো বাজারের জবান্যা নামের এক ব্যক্তির দোকানে। শুনেছি দোকানদারকে চা সমিতি থেকে ফ্রি চা পাতা দুধ ও চিনি সরবরাহ করা হতো। দোকানদারকে বিনা পয়সায় কেটলি, কাপও দেয়া হয়েছিল। লোকজন চা পান করতো দল বেধে। ভোটের সময় বেশ জমতো ফ্রি চায়ের আসর। গরম চা পান করে কত লোকের যে জিহŸা পুড়েছে তার হিসাব নেই।
আমার বাড়ির সামনে মনি দাসের একটি চা'য়ের দোকান ছিল। সেখানে সাধারণ কেউ চা পান করতে পারতো না। কারণ নগদ পয়সায় চা পান করতে হতো মণি দাসের দোকানে। তখন মানুষের হাতে নগদ টাকা পয়সা ছিল না বললেই চলে। দুই আনায় এক কাপ চা পান করার মতো সঙ্গতি বেশিরভাগ মানুষেরই ছিল না। দুই আনায় এক সের আটা মিলতো।
দুধ ছিল সস্তা। দুই আনা সের। মাটির হাঁড়িতে বাজারে গৃহস্থরা দুধ বিক্রি করতো। বেশিরভাগ দুধ কিনতো ঘোষ বা গোয়ালারা। ঘোষেরা দুধ কিনে ঘি, দই, মাঠা, ঘোল ইত্যাদি তৈরি করতো। ঘোষ পরিবারে কেউ মারা গেলে বা তাদের বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান থাকলে সেদিন তারা দুধ কিনতো না। অতএব সেদিন দুধের ক্রেতাও থাকতো না। দুধ বিক্রি করতে এসে মহাবিপাকে পড়তো গৃহস্থরা। অনেক দিন দুধ বিক্রি করতে না পেরে গৃহস্থরা রাগে গোস্বায় বাজারে দুধ ঢেলে রেখে চলে যেতো।
কৃষকদের মধ্যে বেগার প্রথার প্রচলন ছিল। কোন গৃহস্থের জমি আবাদ অথবা ফসল কর্তনের সময় অনেক শ্রমিকের দরকার হয় হেতু কৃষি শ্রমিকদের কাজের জন্য ডাকা হতো। দলবেঁধে কৃষি শ্রমিকরা কাজ করতো। বিনিময়ে দুবেলা পেটপুরে ভালো খাবার দিতে হতো গৃহস্থকে। ভালো বলতে মাংস-ভাত, ঘোল কিম্বা মাঠা এবং অবশ্যই তেলে ভাজা পিঠা ও জাউ। তেলে ভাজা পিঠা ও জাউ তৈরিতে আখের গুড় অথবা খেজুরের গুড় ব্যবহার করা হতো। জাউ রান্নায় চাল ও গুড় লাগে। পায়েশ রান্নায় গুড়ের সঙ্গে দুধের সংমিশ্রণ আবশ্যক। বেগারকে কেন্দ্র করে
ছোট-খাটো উৎসব হতো গৃহস্থের আঙিনায়।
খাওয়ার প্রতিযোগিতা হতো। যে বেশি খেতে পারতো তাকে (খাদককে) পুরস্কার দেওয়া হতো। পুরস্কার হিসেবে লুঙ্গি গামছা অথবা ছাতা দেওয়া হতো।
লাঠি খেলা, হাডুডু এবং বদন (দাড়িয়া বান্ধা) খেলা হতো বড় গৃহস্থের বাহিরাঙ্গনের উঠানে।
আমি আমার বাড়ির পাশে কুঞ্জলাল বাবু, মনি বাবু এবং আরও কয়েক জনকে পাশা খেলতে দেখেছি।
গ্রামের কৃষকরা অবসর সময়ে মাটিতে দাগ কেটে একধরনের খেলা খেলতো যার নাম 'পাইত' খেলা। এটাও অনেকটা দাবার মতো বুদ্ধি মত্তার খেলা। রাখালরা গরু ছাগল চড়াতে যেয়ে ফসলের আইলে অথবা পতিত জমিতে ডাঙ্গুলি খেলতো। এটা ক্রিকেটর বাংলা সংস্করণ। আমার শিক্ষক জ্যোতিন্দ্রনাথ পাল বলতেন ইংরেজরা বঙ্গদেশের ডাঙ্গুলি খেলা দেখে ক্রিকেট খেলা আবিস্কার করেছে। রাখালের লাঠি (লড়ি) দিয়ে একটি ছোট কাঠিকে আঘাত করে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে রান নেয়া। এটারই ইংরেজি সংস্করণে কাঠির পরিবর্তে ব্যবহার হয় ক্রিকেটে বল।

 

হাবিবুর রহমান স্বপন
লেখক ও সাংবাদিক

 

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া: পর্ব ১
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ২)
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ৩)
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ৪)
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (র্পব ৫)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top