সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব দুই) : হাবিবুর রহমান স্বপন


প্রকাশিত:
১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:২৬

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৫:৪১

ছবিঃ হাবিবুর রহমান স্বপন


ইছামতি নদী সাঁথিয়ার হার্ট। সাঁথিয়ার চতুর্দিকে বেশ কয়েকটি ছোট বড় বিল আছে। পূর্ব দিকে গাঙভাঙ্গা, কাটিয়াদহ, পশ্চিমে দৌলতপুরের পশ্চিম ও খানমামুদপুরের উত্তরে ছোট্ট একটি বিল, দক্ষিণ-পশ্চিমে সোনাই বিল, চুন্ননি বিল, মুক্তাহার বিল ইত্যাদি। দক্ষিণে ঘুঘুদহ বিল, উত্তরে সোনাতলা পাথার (বর্ষাকালে বিস্তীর্ণ এই পাথার বাঘাবাড়ি থেকে পয়াম বিল পর্যন্ত অথৈ জলে নিমগ্ন হতো)। এ ছাড়াও ছোট ছোট জলাধার অনেক।
নদী ও বিলে প্রচুর শামুক ও ঝিনুক থাকতো। সাঁথিয়া ও ধূলাউড়িতে নইলা সম্প্রদায় ঝিনুক সংগ্রহ করতো। ঝিঁনুক পুড়িয়ে তৈরি করতো চুন। ঝিঁনুক থেকে মতি সংগ্রহ করা হতো।
এসব বিলের পানিতে বর্ষাকালে নানা প্রকার মাছের প্রজনন হতো। তিন/ চার মাস ধানের ক্ষেতে পানিতে মাছ সাঁতার কেটে বেশ বড় হতো। আশ্বিন মাসে পানি কমে যাওয়ার সময় জালে ঝাঁকে ঝাঁকে নওলা, কাতল, টাকি, পুঁটি মাছ ধরা পড়তো। ছিল রয়না, বেলে, বাইম, কাকলে ও শৈল মাছ। সাঁথিয়ার ঘুঘুদহ বিলের কৈ মাছ এবং সোনাই বিলের পুঁটি মাছের সুনাম ছিল দেশব্যাপী। প্রায় সকল গৃহস্থ পরিবারের মাছ শিকারের জন্য জাল, পলো, খাদুম, চারো ছিল।

নিচু জলাভূমি পরিবেষ্টিত স্যাঁতসেঁতে মাটিতে ফসল ভালই ফলতো। তবে কোন কোন বছর বন্যার পানিতে ফসল ডুবে যেতো। প্রধান ফসল ছিল বোনা আমন ধান (আজল দীঘা, কাজল দীঘা, মোল্লা দীঘা, সরসরি ইত্যাদি) ও পাট। গ্রীষ্মের ফসল ছিল ছোলা, মসুর ও খেসারী ডাল। কিছু জমিতে পটল মরিচ ফলতো। শীতকালে গম ও যব হতো বেশ কিছু এলাকায়। বোয়াইলমারী বাজার ছিল পটল মরিচ এবং পাটের বড় মোকাম। বেশিরভাগ জমি ছিল এক এবং দু'ফসলী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যমুনা ও পদ্মা নদী শাসন করে বাঁধ নির্মাণের সূচনা করেন। বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ এই বাঁধ নির্মাণ করার পর এক ও দুই ফসলি জমি তিন ফসলী জমিতে রূপান্তরিত হয়।
এতে কৃষকের লাভ হয়েছে, তবে প্রকৃতির আসল রূপের ব্যত্যয় ঘটেছে।
ইছামতী নদীতে স্রোতধারা বহমান ছিল এবং বড়াল, হুরাসাগর এবং যমুনার সঙ্গে ইছামতী নদীর সংযোগ ছিল হেতু কচ্ছপের প্রজনন জলাভূমি ছিল সাঁথিয়া অঞ্চল।
প্রতিবছর সাঁথিয়ায় নির্দিষ্ট সময় উড়িয়ারা আসতো কচ্ছপ শিকার করতে। ভারতের উড়িষ্যা থেকে কচ্ছপ শিকারী উড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা আসতো জৈষ্ঠ্য মাসের শেষ সপ্তাহে। ১২/১৩ জনের একটি দল এসে আমাদের বাড়ির বহিরাঙ্গনের ঘর ভাড়া নিয়ে অবস্থান করতো উড়িয়ারা। কটর-মটর ভাষায় কথা বলতো ওরা। তবে বাংলাও ভালো বলতো।


জৈষ্ঠ্য মাসের শেষে এসেই ওরা বাঁশ সংগ্রহ করতো। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাঁশ কিনে এনে ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই বানা তৈরি করতো। লম্বা লম্বা বানা তৈরি করতো নারিকেলের ছোবরার তৈরি সুতলি দিয়ে তৈরি করা হতো বানা। বন্যার পানি যখন নদীতে প্রবেশ করতো তখন উড়িয়া কচ্ছপ শিকারীরা বানা দিয়ে নদীর এপার-ওপার কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। কচ্ছপ স্রোতের টানে নদীর পানিতে সাঁতরে চলাচলের সময় বানার ধাক্কায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ডাঙায় উঠে আসতো। তখনই শিকারী উড়িয়ারা সেগুলোকে ধরে ফেলতো। সামনের এক পা এবং পিছনের এক পা আঁড়াআড়ি করে বড় সূঁচ দিয়ে গেঁথে আমাদেরই নদী তীরবর্তী খালের মধ্যে সংরক্ষণ করতো (বর্তমানের ওভারহেড ওয়াটার ট্যাঙ্ক এর উত্তর বরাবর)। খালটির চতুর্দিকে বানা দিয়ে মজবুত করে আটকে দিতো, যাতে কচ্ছপ বাইরে চলে না যেতে পারে। কচ্ছপগুলো বড় কাঠের বাক্সের মধ্যে ভরে ৭/৮ দিন পর পর পাঠানো হতো উড়িষ্যার রাজধানী কটকে। তখন কটক ছিল উড়িষ্যা রাজ্যের রাজধানী (বর্তমান রাজধানী ভুবনেশ্বর)। সিরাজগঞ্জ থেকে মেইল ট্রেন যাতায়াত করতো কলকাতা হয়ে কটক পর্যন্ত। কচ্ছপের বাক্স পারসেল ডাকে পাঠানো হতো কটক। সাঁথিয়া থেকে নৌকায় করে কচ্ছপ ভর্তি বাক্সগুলো নিয়ে যাওয়া হতো বড়াল ব্রিজ স্টেশনে (ভাঙ্গুরা)।



এভাবে উড়িয়ারা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত কচ্ছপ শিকারের জন্য সাঁথিয়ায় আসতো। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে ভারতের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে উড়িয়াদের আসা বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু উড়িয়া কচ্ছপ শিকারীরা আমার বাড়ির বহিরাঙ্গনের ঘরে থাকতো, তাই তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং চালচলন আমার বেশ মনে আছে। সুঠাম দেহের অধিকারী উড়িয়াদের গায়ের রং বেশ কালো।
প্রায় প্রতিদিনই ওরা কচ্ছপের মাংস এবং মাছ খেতো। লাল টকটকে ঝাল তরকারি ছিল ওদের প্রিয় খাবার।
অগ্রাহায়ণ মাসের প্রথম দিকে উড়িয়ারা আপাতত তাদের মৌসুমি কচ্ছপ শিকার শেষ করে পাত্তারি গুটিয়ে চলে যেতো। আবার পরবর্তী বছরের নির্দিষ্ট সময়ে (জৈষ্ঠ্য মাসে) চলে আসতো।
এরপর অগ্রাহায়ণের শেষ সপ্তাহে যখন আমন ধান কাটা শুরু হতো তখন আসতো কাবুলি ওয়ালারা। ওরা আসতো কাবুল থেকে। লম্বা নাসিকা এবং দীর্ঘকায়া কাবুলি ওয়ালারা ঢিলেঢালা কাবুলি সালোয়ার কামিজ পরিধান করতো। উড়িয়ারা বিদায় নেওয়ার পর ওরা আমাদের বহিরাঙ্গনের বাড়ির ঐ ঘরেই উঠতো। অপর দলটি থাকতো গৌরচন্দ্র সাহার দোকান সংলগ্ন ঘরে (বর্তমানে যেটি মোজাম্মেল হক স্যারের স'মিল)। নানা প্রকার হালুয়া, সিরাপ এবং খেজুর, বাদাম, কিসমিস, আখরোট, তাবিজ কবজ বিক্রি করতো। এছাড়াও টুপি, আতর, সুরমা, যায়নামাজ, আলোয়ান বা মোটা শীতবস্ত্র ও তসবিহ্ বিক্রি করতো। হালুয়া তৈরি করতো মধু, কাজু বাদাম, আখরোট, কাঠ বাদাম, চিনি, গুড় ইত্যাদি দিয়ে। সিরাপ নানা প্রকার বেনেতি দ্রব্য দিয়ে তৈরি করতো।

উভয় দলে ৮/১০ জন থাকতো কাবুলি ওয়ালারা। গ্রামে গ্রামে হাটে হাটে ওরা বিক্রি করতো পণ্য সমূহ। পাওনাদারদের বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হতো বাঁকি নিয়ে। ওরা বকেয়া টাকা আদায়ে বেশ পারঙ্গম ছিল। কাবুলি ওয়ালারা হাতের উপর বড় বড় রুটি তৈরি করে বড় তাওয়ায় ছেঁকে নিতো। তরকারিতে প্রচুর পরিমাণ পিঁয়াজ রসুন খেতো। প্রতি হাটবারে মোরগ মুরগী কিনতো। মাছ খেতো না। মূলা ও টমেটো চিবিয়ে খেতো। তবে তখন টমেটো খুব কমই মিলতো।
আমার বয়স তখন ৭/৮ বছর, আমার ছোট ভাই দুলালের বয়স ৫/৬ বছর। ওদের দলনেতা আমাদের ডেকে হাতে খেজুর, বাদাম আখরোট দিতো। ওরা পুরো শীতকাল পর্যন্ত থাকতো তারপর দেশে ফিরে যেতো।
১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর উড়িয়াদের মতো কাবুলিওয়ালাদের আসাও বন্ধ হয়ে যায়।
চলবে


হাবিবুর রহমান স্বপন
লেখক ও সাংবাদিক

 

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া: পর্ব ১

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top