সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া: পর্ব ১ : হাবিবুর রহমান স্বপন


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২২ ০১:৫৯

আপডেট:
১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:২৫

 

৬০ এর দশকের সাঁথিয়া কেমন ছিল। সাঁথিয়ার প্রাণ ইছামতি নদী ছিল চলমান। স্রোতধারা প্রবাহিত হতো নদীতে বর্ষায়। আষাঢ় এর শুরুতেই ইছামতিতে বন্যার পানি আসতো। জোয়ারের পানিতে থাকতো প্রচুর কচ্ছপ, জোঁক ও পানিপোকা। মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যে নদী ভরাট হয়ে পানি উপচে দুকূলের বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত পানিতে পূর্ণ হয়ে যেতো।
মাছে ভরা ছিল নদীর পানি। আমরা গোছলে যেয়ে মাছ ধরতাম হাতড়িয়ে। কখনও ঝাঁকি জাল ও বরশিতে। নদীতে অসংখ্য খোঁড়া জাল বসতো। বন্যার পানি যখন নেমে যেতো তখন সোঁতি জাল লাগানো হতো এখন যেখানে ওভার হেড পানির ট্যাঙ্ক তার ঠিক পশ্চিম বরাবর। নদী ছিল আরও আশি থেকে এক'শ ফুট প্রশস্ত। ১৯৮৪-'৮৫ সালে নদী পুণঃখননের সময় প্রস্থ কমানো হয়। ইছামতী নদীতে কোন ব্রীজ ছিল না। বাজারে স্কুলে ওপারের দৌলতপুর, পোরাট, ধোপাদহ, মনমথপুরের লোকজন আসতো খেয়া নৌকায়। খেয়া ঘাট ছিল বর্তমানে যেটি সাঁথিয়া-দৌলতপুর ব্রিজ সেখানেই। এই ব্রিজটি নির্মাণ হয় ১৯৮৯ সালে।
বন্যার সময় প্রায় প্রতি বছরই বাজারের মধ্যে পানি প্রবেশ করতো। বর্ষার সময় বড় বড় নৌকা আসতো নদী পথে। এসব বিশালাকৃতির মালবাহী নৌকায় সাঁথিয়া বোয়াইলমারী বাজার থেকে ধান, পাট, পিঁয়াজ, সরিষা ইত্যাদি চলে যেতো ঢাকা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে। নৌকায় আসতো লবন, কেরোসিন, আলকাতরা, ঢেউটিনসহ নানা পণ্য।
আমরা নদীতে সাঁতার কাটতাম৷ মাছ ধরতাম এবং নৌকা চালাতাম। প্রতিবছর জমজমাট নৌকা বাইচ হতো ইছামতী নদীতে। নৌকা বাইচের প্রধান আকর্ষণ ছিল গীত। সুর করে বৈঠা চালানোর সময় যে আনন্দধারা মানুষের মনে প্রকাশ পেতো তা ছিল নির্মল আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।
সাঁথিয়া থেকে লঞ্চ চলতো আতাইকুলা এবং বেড়া হয়ে নাকালিয়া পর্যন্ত। তার আগে পঞ্চাশ এর দশকে লঞ্চ চলাচল করতো পাবনা পর্যন্ত। তারও আগে ত্রিশের দশকে নৌকায় এই ইছামতী নৌপথেই শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর যাতায়াত করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর ইছামতী কবিতায় সোনাতলা গ্রামের কথা লিখেছেন। আতাইকুলার উত্তরের জোলা হয়ে বড় বিল পাড়ি দিয়ে আবার কখনও ধুলাউড়ি জোলা পথে পয়াম বিল হয়ে তাঁর নৌকা চলতো সোনাতলার উত্তরের বলেশ্বর নদী হয়ে পাটগাড়ির নিকট দিয়ে চয়রা গ্রামের নিকটে হুরাসাগর নদী হয়ে করোতোয়া নদী হয়ে শাহজাদপুরে।
ইছামতী নদীর সঙ্গে যোগসূত্র ছিল অনেকগুলো জোলা বা ক্যানেলের। যেমন ধূলাউড়ি জোলা (এটির সংযোগ ছিল গুমানি ও বড়াল নদীর সঙ্গে), হলুদঘর জোলা, ধোপাদহ জোলা, গাগড়াখালি জোলা, পোরাট জোলা, মনমথপুর জোলা, সোনাতলা জোলা ইত্যাদি। সোনাইবিলের সঙ্গে ইছামতী নদীর সংযোগ ছিল বর্তমান ফায়ার সার্ভিসের পূর্ব দিকের কোনাবাড়িয়া ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত জোলা পথে। এই নৌপথে বিলমহিষার চর, শুকচর, ইকরজানা, মাছখালি, বন্দিরামচর, শঙ্করপাশা, পিয়াদহ ইত্যাদি গ্রামের লোকজন সাঁথিয়ায় আসা যাওয়া করতো। এসব জোলা ১৯৮৫-'৮৬ সালে পাবনা প্রকল্পের কাজের সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে ইছামতী নদী থেকে নৌকায় আর দৌলতপুর ও খানমামুদপুরের মধ্যবর্তী জোলা দিয়ে ধোপাদহ ও পোরাটের মধ্যবর্তী জোলা পথে সোনাতলা পাথারে যাতায়াত করা যায় না। তবে জোলাটি এখনও বিদ্যমান। নদীর সংগে সংযোগস্থান বা মুখ বন্ধ।
নদী পথে কৃষকরা দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে আসতো বোয়াইলমারী হাটে। হাটে প্রচুর লোক সমাগম হতো। হাটের দিনে গমগম শব্দ হতো। বিকিকিনি হতো প্রচুর লবন, কেরোসিন তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। জিলিপি ও রসগোল্লা ছিল অন্যতম হাটুরে মিষ্টান্ন। লবন, সোডা, জিলিপি বিক্রি হতো পদ্ম পাতায় মুড়িয়ে। হাটের দিন সকালে প্রচুর পদ্মপাতা আসতো গরু-মহিষের গাড়ি ও নৌকায়। পদ্মপাতা আসতো ঘুঘুদহ বিল, বিল গ্যারকা ও গাজনা বিল থেকে। এসব পাতা নামতো আমার বাড়ি সংলগ্ন আম বাগানে (বর্তমানে এটি তাহের এর ভূষির দোকান)। এখানেই প্রতি শুক্রবার ও সোমবার দিবাগত রাতে শতাধিক গরু-মহিষের গাড়িতে গুড় বেড়া হাটের উদ্দেশ্যে জড়ো হতো। পরদিন ভোরে আজানের সময় এসব গুড় বোঝাই গাড়ি রওনা হতো বেড়া হাটের উদ্দেশ্যে। অতএব সারারাত বাজারে লোকজন থাকতো সে সময়।
পদ্মপাতায় মোড়ানো গুড়ের জিলিপির স্বাদ ও গন্ধ ছিল অপূর্ব।
হাটের দিন প্রচুর ইলিশ মাছ উঠতো। কৃষক ও তাঁতীরা হাটবারে ইলিশ কিনতো। চার আনায় এক হালি ইলিশ বিক্রি হতো (১৯৬৪-'৬৫)। দুধ ছিল ২ পয়সা সের।
সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে ঘুঘুদহ বিল পর্যন্ত যে জোলাটি চলে গেছে এটির নাম চৌধুরীর জোলা। আজিম চৌধুরী জোলাটি খনন করেন। বর্ষাকালে এই জোলাপথে ঘুঘুদহ বিলের মধ্য দিয়ে দুলাই লোহার ব্রিজের নিচ দিয়ে বিল গাজনা হয়ে পদ্মা নদীতে যাতায়াত করা যেতো। নৌকায় করে সাতবাড়িয়া ঘাট থেকে ইলিশ মাছ কিনে আনতো কতো মানুষ। এ ছাড়া পদ্মার চর থেকে করচা বা শানিক (গোখাদ্য)কেটে নৌকা বোঝাই করে আনতো আমাদের এলাকার গৃহস্তরা। পরে এই জোলাটি সংস্কার হয় ১৯৫৭-৫৮ সালে। তারপর ১৯৬১ সালে এখানে স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষার পানি যখন নদীতে আসতো তখন এই স্লুইস গেট বন্ধ করে দেয়া হতো। বর্ষাকাল শেষে গেট খুলে দেয়া হতো। প্রবল বেগে পানি নিষ্কাশনের সময় এখানে স্রোত এবং ঘুর্ণিপাক তৈরি হতো। প্রতিবছরই নৌকা ডুবি হতো। স্রোতের উজানে মাছ লাফাতো। মাছ আছড়ে পরতো সড়কের উপর। আমরা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাছ ধরতাম। এখানে প্রচুর বেলে ও বড় বড় বাইম মাছ ধরা পরতো।
বর্তমানের বালিকা বিদ্যালয় সড়ক তখন ছিল জোলা। বর্ষায় এই জোলা পথে নৌকা চলচল করতো কাটিয়াদহ বিল পথে আফরা-পুণ্ডুরিয়া। আমরা স্রোতে সাঁতার কাটতাম। আরও একটি জোলা ছিল বর্তমানে মহিমগাছার দিকে যে বাইপাস সড়ক হয়েছে সেটি। জোলা পথের সংযোগ ছিল গাঙভাঙ্গা বিলের সঙ্গে। বর্ষাকালে এই জোলায় আমরা স্রোতের ভাটিতে চলে যেতাম আবার সাঁতারে আসতাম; মাছ ধরতাম। জেলেরা এই জোলার বিভিন্ন স্থানে খোঁড়া জাল পাততো। প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। বর্ষাকাল, শরৎকাল ও হেমন্তে মাছের গন্ধে পুরো বাজারটিকে মনে হতো জেলেপল্লী। যেহেতু আমাদের বাড়ি বাজারের মধ্যবর্তী অবস্থানে তাই আমি শিশুকাল থেকেই বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দোকানপাটের উণ্থান পতনের সাক্ষী।

(চলবে)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top