সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (র্পব পাঁচ) : হাবিবুর রহমান স্বপন


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:২৭

আপডেট:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৩৬

ছবিঃ  হাবিবুর রহমান স্বপন

 

ষাটের দশকে সাঁথিয়ার বাসিন্দাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অতিসাধারণ। জীবনযাপন ছিল আটপৌঢ়ে।
শতভাগ পুরুষের পরিধান ছিল লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। পাতলা হাতাওয়ালা গেঞ্জি। যা তৈরি হতো পাবনায়।
বেশিরভাগ লোকজন হাটে বাজারে আসতো লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিধান করে। নগ্ন পা'য়ে এবং নগ্ন শরীরে হাট বাজারে আসা যাওয়া লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল না। নগ্নগায়ে যারা চলাচল করতো তাদের কাঁধে একটি গামছা থাকতো।
মেয়েরা ছালোয়ার কামিজ ও ওড়না এবং বিবাহিতারা শাড়ি পরিধান করতো। অবিবাহিত মেয়েরা বোরকা পরিধান করতো না, তবে গৃহবধূরা বাড়ির বাইরে যাতায়াতের সময় পর্দা করতো। ব্লাউজ-পেটিকোট বিহীন মোটা সুতি শাড়ি কাপড়ই ছিল অন্যতম পরিধেয়। এসব শাড়ি কাপড় তৈরি হতো সাঁথিয়ায় তাঁতে। একটু ভালোমানের শাড়ি তৈরি হতো শাহজাদপুর, দোগাছিতে।
অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ বাজারে আসতো লুঙ্গি ও পাতলা ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে। শীতকালে আলোয়ান বা বড় আকারের চাঁদর গায়ে চাপিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকতো লোকজন। সন্ধ্যার পর পরই কুপি বাতিতে চলতো সংসারের কাজকর্ম। কৃষকেরা রাতে নানা গৃহস্থালি কাজ করতো। যেমন ধান মাড়াই, মাছ ধরার জাল, চারো, খাদুম ইত্যাদি তৈরি করতো। শীতে সারারাত জেগে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করার কষ্টকর কাজ করতো কৃষকেরা।
কৃষাণবধূরা সংসারের নানা কাজের পাশাপাশি সন্তান লালন পালন করতো যত্নের সাথে। তবে প্রায় প্রতিটি দম্পতির সন্তান সংখ্যা ছিল অনেক। শিশুমৃত্যুর হার ছিল বেশ। কলেরা, ডায়েরিয়া, ম্যালেরিয়া, যক্ষা, কালাজ্বর, জনডিস, হুপিং কাশি, নিউমোনিয়ার মতো মরণঘাতি ব্যধি ছিল চমকে দেয়ার মতো। কৃমিজনিত নানা রোগ ছিল। ছিল আমাশয়। শতকরা ৯৯ দশমিক ৯৮ ভাগ মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করতো। জঙ্গল, ঝোপঝাঁড়, ফসলের ক্ষেতে মল ত্যাগ করার কারণে পেটের পীড়া লেগেই থাকতো সাধারণ পরিবারের সদস্যদের।
চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। সাঁথিয়া, হলুদঘর এবং ক্ষেতুপাড়ায় ছিল তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী বা নার্স ছিল না। গ্রামীণ মহিলারাই ধাত্রীর কাজ করতো। শিশু মৃত্যু, প্রসূতি মৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটতো প্রতিনিয়ত।
চিত্তবিনোদন বলতে ছিল পুঁথি পাঠ এবং ফকিরী গান। সুর করে নির্দিষ্ট ঢংয়ে পুৃঁথি পাঠ করতো একজন এবং তাকে ঘিরে মনোযোগী শ্রোতৃবৃন্দ শুনতো। পল্লীগীতি, মারফতি, লালনগীতির আসর হতো ছোট ছোট বাজারে এবং বড় গেরস্তের উঠোনে। এসব আসর বসতো রাতের বেলা। কখনও কখনও এসব গানের আসর হতো সারারাতব্যাপী।
নারীদের চিত্তবিনোদন বলতে ছিল গল্পগুজব এবং গীত। পাড়ার বধূরা একত্রিত হয়ে খালি গলায় সুর তুলে গীত গাইতো। বিশেষ করে বিয়ে এবং সুন্নতি অনুষ্ঠানে বড় গৃহস্থ বাড়ির অন্দরমহলে এই গীতের আসর বসতো।
শিক্ষা বলতে ছিল প্রাথমিক শিক্ষা। সাঁথিয়া উপজলা সদরে একটি মাত্র উচ্চ বিদ্যালয় ছিল সাঁথিয়ায়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি আফতাবনগর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপজেলার প্রথম উচ্চ বিদ্যালয় আতাইকুলা। এখন অনেকগুলো হাইস্কুল ও কলেজ হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে।
শিক্ষায় অনগ্রসর এই এলাকায় ষাটের দশক পর্যন্ত হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু।
মুসলিমদের মধ্য যারা শিক্ষা লাভ করেন তারা কলকাতা এবং ঢাকায় পড়তেন। সাঁথিয়া স্কুলের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন গৌরীগ্রাম ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (তখন চেয়ারম্যান এর পদটির নাম ছিল প্রেসিডেন্ট) তালেব আলী খান সাহেবের সন্তানেরা। জয়নাল আবেদিন, আবু তাহের, আবু বকর, আবু সাঈদ, তাদের বোন রুনু। এছাড়া সাঁথিয়া হাই স্কুলের কৃতি ছাত্র কলাগাছি গ্রামের ডাক্তার আব্দুর রশিদ, সৈয়দপুরের ডাক্তার শাহজাহান আলী প্রমুখ।
সাধারণ কৃষক ও তাঁতীরা অর্থনৈতিকভাবে এতোটাই দুর্বল ছিল যে তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা দেওয়ার মতো সঙ্গতি তাদের ছিল না।
মাদ্রাসা শিক্ষা আগে শুরু হয় সাঁথিয়ায়। বোয়াইলমারী সিনিয়র মাদ্রাসা এবং ধূলাউড়ি মাদ্রাসা আগে প্রতিষ্ঠিত হয়।
নারীরা শিক্ষায় আরও পশ্চাতে ছিল। ষাটের দশকে হাতে গোনা চার/পাঁচজন উচ্চ শিক্ষা লাভে সক্ষম হন।
সাঁথিয়া শব্দটি কোথা থেকে কোন সূত্রে এলো তা জানা যায়নি। তবে জানা গেছে নিম্নাঞ্চল হেতু বছরের প্রায় ৬ মাস জলমগ্ন বা স্যাঁতসেঁতে থাকতো। বিস্তীর্ণ এলাকা চর এর মতো প্রতীয়মান হতো। যার প্রমাণ এখনও রয়েছে। গ্রামগুলোর নামকরণ থেকেই তা স্পষ্ট। পুরানচর, বন্দিরামচর, শুকচর, বিলমহিষারচর, চর মাছখালি, চর শঙ্করপাশা, বিলচাপড়ি, চরপাড়া, বিলভাদুরী, চরমাছগ্রাম ইত্যাদি।
মাছ শিকার এবং তা বিক্রি করা ছিল এ সমস্ত এলাকার মানুষের প্রধান জীবীকা।
বর্ষাকালে প্রচুর শুটকি মাছের খোলা বসতো বিলপাড়ের গ্রামগুলোতে। জেলে এবং নিকারী স¤প্রদায়ের লোকজনের বসতী এখনও আছে। তবে জেলেরা বেশিরভাগই দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছে।
বিলে শাপলা, শালুক, পদ্মপাতা ও পদ্মফুল হতো। এগুলো বিক্রি করে বিলপাড়ের মানুষজন অর্থ আয় করতো। ঢ্যাপ এর খই হতো। সোদা নামের এক ধরনের কাণ্ডহীন সবুজ গাছ জন্মাতো বিলের পানিতে। সোদা দিয়ে পাটি তৈরি হতো।
এখন আর সোদা গাছ দেখা যায় না।
করচা বা শানি জন্মাতো স্যাঁতসেঁতে মাটিতে। গো-খাদ্য হিসাবে বেশ সহজলোভ্য ছিল করচা।
ছন উৎপাদন হতো বিনা চাষের জমিতে। ছন দিয়ে ঘরের ছাউনি বা চালা তৈরি করা হতো। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির চালা তৈরি হতো ছন দিয়ে। খুঁটি, আঁড়া, পাইর তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে

চলবে

 

হাবিবুর রহমান স্বপন
লেখক ও সাংবাদিক

 

স্মৃতিপটে সাঁথিয়া: পর্ব ১
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ২)
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব ৩)
স্মৃতিপটে সাঁথিয়া (পর্ব চার)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top