সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

একজন কমলালেবু: শাহাদুজ্জামান (বুক রিভিউ) : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
২৮ অক্টোবর ২০২২ ০১:০৬

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৫৭

 

"আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুন মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে।"
('কমলালেবু' - জীবনানন্দ দাশ)

শ্যামল বাংলার অপরূপ প্রকৃতিকে অনুপম মোহনীয়তার মায়াবী অলংকারে সাজানো এক নিপুণ কারিগরের নাম জীবনানন্দ। কলকাতার বালিগঞ্জে রাসবিহারী এভিনিউয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি ট্রাম। চারিদিকে শেষ বিকেলের রোদ। জলখাবার দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসা চুনীলাল দেখলেন একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে এ ট্রামের দিকে। ট্রামও এগিয়ে আসছে। ট্রামের ড্রাইভার জোরে জোরে ঘন্টা বাজালেন, সে লোক তবু উঠে গেলেন ট্রাম লাইনের উপর এবং আটকে গেলেন ট্রামের ক্যাচারে। চুনীলাল ক্যাচারের ভেতর থেকে বের করলেন লোকটিকে ।ভীড় জমে গেল। সবাই জানতে চাইল এই লোক কে? সেই লোক বললেন, আমার নাম জীবনানন্দ দাশ, থাকি ঐ ল্যান্সডাউন রোডের ৮৩ নম্বর বাড়িতে। কেমন ছিলেন এই ব্যাক্তি ব্যক্তি জীবনানন্দ, কেমন ছিল তার সংসার জীবন খুব কম মানুষই জানেন। জানেন না তাঁর জীবনের চরম টানাপোড়েনের করুণ গল্প। জীবনানন্দের জীবনের এই টানাপোড়েনের গল্প জানতে হলে পড়তে হবে শাহাদুজ্জামান এর ‘একজন কমলালেবু’। বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনের খুঁটিনাটি নিবিড়ভাবে তুলে ধরেছেন এ সময়ের শক্তিমান কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তাঁর একজন কমলালেবু উপন্যাসে। কারো কারো ধারণা জীবনানন্দ জীবনের শেষ সময়ে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। সে থেকেই নাকি এই বইয়ের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য এই ধারণার স্বপক্ষে খুব একটা যৌক্তিকতা আছে কি না তা লেখক শাহাদুজ্জামানই ভালো বলতে পারবেন।
‘একজন কমলালেবু’ বইটি পড়ে নামের সাথে লেখনীর একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একটি কমলালেবুর ক্ষেত্রে, খোসা ছাড়ালে পাওয়া যায় কতগুলো কোয়া। আবার একেকটি কোয়ায় আছে ছোট ছোট অসংখ্য দানা। অর্থাৎ যতই কমলালেবুর আবরণ সরানো হয় ততই এর ভেতরের খুটিঁনাটি মানুষের সামনে উন্মোচন হয়। ঠিক তেমনি জীবনানন্দ দাশ এর জীবনের ক্ষেত্রেও যতই গভীরে প্রবেশ করা যায় ততই অদ্ভুত সব রহস্যময় তথ্য উন্মোচন হয় আমাদের সামনে। ‘একজন কমলালেবু’ পড়লে এমনই অনেক গোপন রহস্য পাঠকের সামনে প্রকাশিত হয়। পাঠক জানতে পারেন একজন কবির 'কবি' হিসেবে পরিচিত হওয়ার পেছনে দুর্গম পথচলার সেই অজানা গল্প। শাহাদুজ্জামান তাঁর নিপুণ কলমের ছোঁয়ায় এ কাজটি করেছেন চমৎকারভাবে। সংসারের শেষ মানুষটার খাওয়া শেষ হলে মিলুর ঘরে ফেরেন মা। মিলুর চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, তুই এখনো জেগে বাবা? ঘুমিয়ে পড় তাড়াতাড়ি। এর পর মিলু ঘুমাবার চেষ্টা করে।
বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মতো ছড়িয়ে থাকা কলকাতার ট্রামলাইনের উপর। পৃথিবীর দিকে জীবনানন্দ তাকিয়েছিলেন বিপন্ন বিস্ময়ে। সস্তা বোর্ডিংয়ে উপার্জনহীনভাবে দিনের পর দিন কুচো চিংড়ি খেয়েছেন। তবু পশ্চিমের মেঘে দেখেছেন সোনার সিংহ। কাব্য, প্রজ্ঞা, রূপকথা, ঘাস, ফুল, পাখি মিলিয়ে এক মায়াবী শৈশব ও কৈশোর কেটেছে জীবনানন্দের। কবি মাতা কুসুমকুমারীর ছায়া তলে এক ছোট্ট হাঁসের ছানার মতো লেপ্টে থাকতেন সর্বক্ষণ। শৈশবে শোনা মায়ের সেই কবিতার লাইন, 'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে' একে যেন জীবনানন্দ একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়ছিলেন। কথায় বড় হওয়া তো দূরের কথা, সহজে লোকের মতো স্বাভাবিক কথাই তিনি বলতে পারতেন না। সারা জীবন ছিলেন মুখচোরা মানুষ। আর কাজ! সারাজীবন মাকে একাগ্রচিত্তে, ধ্যানমগ্নতায় যে কাজটি করতে দেখেছেন সেটিকেই অলক্ষ্যে তিনি কাজ বলতে বুঝেছিলেন। আর তা লেখা ছাড়া আর কিছুই না। তাই হয়তো নীরবে নিভৃতে আমৃত্যু ওই একটি কাজই করে গেছেন মন দিয়ে। তাই তো, তাঁর মৃত্যুর পরে কলকাতার ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের তাঁর সেই ছোট্ট কামরা থেকে উদ্ধার হল গোটা কয়েক কালো টিনের ট্রাঙ্ক। ওইসব ট্রাঙ্ক থেকে তুতেনখামেনের পিরামিডের গুপ্তধনের মতো উদ্ধার হলো তাঁর লেখা অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাসের রাশি রাশি পান্ডুলিপি। নানা ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে অবশেষে সেসব পান্ডুলিপির জায়গা হয় কলকাতার আর্কাইভে। সেই অপ্রকাশিত লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে উঠে আসলো নতুন এক জীবনানন্দ। যদিও এখনও উদ্ধারপর্ব চলছে, তবু তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত লেখা যোগ করলে দেখা যাচ্ছে তিনি লিখেছেন প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, গোটা বিশেক উপন্যাস, শতাধিক গল্প, পঞ্চাশটির ওপর প্রবন্ধ আর প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরি যার নাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘লিটারারি নোটস’। জীবনানন্দ তাঁর মত করে সাংকেতিক ভাষায়, ইংরেজি, বাংলা মিলিয়ে লিখতেন তাঁর নোটগুলো। লিটারেরি নোটস মূলত তাঁর দিনলিপি লেখার ডায়রির মত ছিল। যা কখনো হয়েছে তাঁর বন্ধু, কখনো তাঁর ঢাল, কখনো বা তাঁর আত্ম স্বীকারোক্তির জায়গা। ডায়েরিতে তাঁর জীবনের উত্থান-পতন, ভালো-মন্দ, এমনকি বেশ্যাগমন, স্বমেহন, কিংবা কাব্যহিংসার মত অতি ব্যক্তিগত তথ্য, প্রেম-বিষাদসহ তার জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা কিছুই বাদ পড়েনি। মূলত জগৎ সংসারে জীবনানন্দ ছিলেন একা। একদম একা। তাঁর বন্ধু ছিল না বললেই চলে। স্ত্রী লাবন্যও সব সময়েই তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ব্যক্তি জীবনানন্দ এবং কবি জীবনানন্দ কোনোটাই তাঁর স্ত্রীকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেন নি। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর সে কথা লাবণ্য তার আত্মজীবনীতে স্বীকারও করেছেন। লাবণ্য এটাও লিখেছেন যে, সংসারে জীবনানন্দের একমাত্র কৃতিত্ব ছিল নিখুঁত সুন্দর করে বাচ্চাদের পেনসিল কেটে দেওয়া। এছাড়া তেমন কোনো কাজই তার দ্বারা হয়ে ওঠে নি। বারংবার চাকুরিচ্যুত হয়ে জীবনানন্দের বেকার, দিশেহারা অবস্থাও তাঁদের দাম্পত্যে বিশেষ ছাপ ফেলে। তাছাড়া বছরের পর বছর চাকুরীহীন অবস্থায় তিনি জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতম দুর্বিষহ সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, চাকরির জন্য মানুষের কাছে কুকুর-বেড়ালের মতো তাড়িত হতে হয়েছেন। অর্ধাহার-অনাহারে কাটিয়েছেন কতশত রজনী। কখনো কখনো প্রবল অনাহারের সময় চড়ুইয়ের খাবারে পর্যন্ত ভাগ বসাতে চেয়েছেন। হতাশা আর দুর্দশা তাকে বারংবার আত্মহত্যার দিকেও প্ররোচিত করছিল। লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখনিতে কয়েকবারই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে এসব দিক।
কবিতা লিখেও জীবনানন্দ জীবিতাবস্থায় খুব একটা প্রশংসিত হতে পারেননি। তাঁর কবিতা প্রশংসা পাওয়ার চেয়ে সমালোচিত হয়েছে বেশি। সমসাময়িক কবিরা প্রায় উঠে পড়ে লেগে থাকতেন তার সমালোচনার জন্য। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে বিরূপ ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। ভোরে বিছানায় শুয়ে জীবনানন্দ একদিকে শুনতেন মায়ের প্রার্থনা গান ,আর অন্য ঘর থেকে ভেসে আসত বাবা সত্যানন্দের উপনিষদের আবৃত্তি। এসব প্রতিকূলতা জীবনানন্দকে আশাহত করলেও লেখা থেকে দূরে সরাতে পারে নি। লেখা তার কাছে ছিল এক যক্ষের ধনের মতো। নিজের যাবতীয় মেধা, শ্রম ঢেলে প্রকাশ্যে গোপনে ধারাবাহিকভাবে ওই একটি কাজই করে গেছেন তিনি। প্রথম কবিতার বইয়ের ব্যর্থতার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক বড় বিপর্যয় নেমে আসে জীবনানন্দের জীবনে‌। সিটি কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে । এই চাকরি চলে যাবৈ একটা ব্যাখ্যা উঠে এসেছে শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু উপন্যাসে।
জগৎ সংসারে বাকি যে কাজই করবার চেষ্টা করেছেন তাতে নাকাল হয়েছেন বারবার। তাই বাস্তবিকভাবেই তিনি লাবণ্য আর তাঁর পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি, ওই কিছু ধূসর পান্ডুলিপি ছাড়া। যদিও অবশ্য তিনি অবিরাম চেষ্টা করে গেছেন জীবন আর জীবিকার একটা সমীকরণ ঘটাতে। জীবনানন্দের জীবনের প্রায় পুরোটা কেটেছে আনন্দহীন ও হতাশার মধ্যে।
সেই হতাশার জীবনকে তিনি প্রায়ই আত্মহত্যা করে মুক্তি দিতে চাইতেন। ১৯৫৪ সালে এসে যেন নিজের ভিতরে বাস করা সেই আত্মঘাতী চিন্তাকেই সত্যি করে তুললেন। খুব রহস্যময় মৃত্যু হয় জীবনানন্দের। ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর আহত হলে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। যদিও বলা হয় তিনি নাকি এক প্রকারে ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছিলেন ট্রামের ক্যাচারে। সেখানে কোনো সুরাহা না হওয়ায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু সেখানেও থেকে যায় প্রশ্ন! এটা কি আত্মহত্যা, নাকি হত্যা? জীবনানন্দের মনে গোপন আশা ছিল একদিন হয়ত গ্যেটে, ইয়টসের মত বড় সাহিত্যিক হবেন। যদিও জীবনের শেষে এসে হতাশার চরম পর্যায়ে তার কিছুটা মোহভঙ্গ হয়। তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন তা পারেননি বলে স্বীকার করে নেন কিন্তু তার কবিতা নিয়ে একটি নিজস্ব অহংকার সবসময়ই ছিল। তার মৃত্যুর এতদিন পরে এসে তিনি আরও বেশি বেশি আলোচিত। বস্তুুুত যতই দিন যায় মানুষের তার প্রতি আগ্রহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকে।
একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, শাহাদ্দুজ্জামান জীবনানন্দকে নতুন রূপে চিনিয়েছেন আমাদের। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তোলা তাঁর উপন্যাস একজন কমলালেবু যা পড়তে এবং আলোচনা করতে মোটেই একঘেয়েমি আসবে না, আসবে না সামান্যতম বিরক্তি।
হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর আগে জীবনানন্দ সঞ্জয় কে জড়ানো গলায় বলেছিলেন, একটা কমলালেবু খেতে পারব ? সময়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন বহুমুখী মাত্রা। বস্তুত বাংলা কাব্যের মোড় ঘোরানো এক অজানা নক্ষত্রকে জানার জন্যে ও বোঝার জন্যেও একজন কমলালেবু একটি অসাধারণ বই। তবে এটি আসলে কি একটি উপন্যাস, নাকি একটি জীবনকাহিনী, নাকি একটি ক্রিটিকাল বিশ্লেষনী সেটি পরিষ্কার না হলেও, নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘একজন কমলালেবু’ একটি গবেষণামূলক অনন্য বই যা যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হবে।
শূন্যে অবশ্য ভেসে রইল অমিমাংসিত সেই জিজ্ঞাসা, জীবনানন্দের এই মৃত্যু তাহলে কী -
দুর্ঘটনা ?
আত্মহত্যা ?
হত্যাকাণ্ড ?


এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top