সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

অকৃতজ্ঞ : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৩২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০০


চল যাব তোকে নিয়ে এই নরকের অনেক দূরে
এই মিথ্যে কথার মেকী শহরের সীমানা ছাড়িয়ে

নরম মনের মানুষদের মন খারাপ হতে বা মন ভালো হতে তেমন যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ লাগে না। পৃথিবীর যাবতীয় সবকিছুই অবিস্বাশ্য দ্রুততায় তাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। তারা যেমন খুবই সুখি আবার চাঁদের অপর পিঠের অন্ধকারের মত তারা আবার খুবই দুখি। পৃথিবীর তাবৎ মানুষের দুঃখকে তারা মনেকরে নিজের দুঃখ এবং তারা দুঃখিত হয় হয়তো প্রকৃত দুঃখী মানুষটার চেয়েও বেশি। আবার সারা পৃথিবীর সকল মানুষের সুখ তাকে সুখী করে এবং তখন নিজেকে তারা মনেকরে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সুখের কারণগুলো মাঝে মধ্যে এমন ঠুনকো হয় যে সেটা অন্য মানুষদের হাস্যরসের খোরাকে পরিণত হয়। তাই সুখের কারণের অন্ত নেই। কিন্তু দুঃখের কারণগুলোই বেশি ভোগায়, ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয় তুমি একজন পলাতক। তুমি এই দেশটার মাটির মানুষগুলোর জন্য কিছুই কর নাই।

শৈশবের যে ছেলেটার সাথে পুকুরে একসাথে লাফালাফি-ঝাপাঝাপি, মার্বেল খেলা, জাম্বুরা চুরি করতাম সেই ছেলেটা ভাগ্যের ফেরে আজ সামান্য মুদির দোকানদার। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে করতে পারছে না কারণ বিয়ে করতে গেলে যে বিরাট খরচা। তারপরও সে বেশ সুখেই আছে। একেবারেই ছোট একটা দোকান সেটাতে ভর করে তাঁর ভালোই চলে যায়। এখানে ভালো চলে যায় বলতে ভালো থাকাকে বুঝানো হয়েছে সুখে থাকাকে না। মুখ ফুটে কখনো বলবে না যে ওর কিছু টাকা লাগবে কিন্তু আমি জানি সমস্যাটা কোথায়? টাকার জোগাড় নাই বলেই ও বিয়েটা করছে না। সামান্য কিছু টাকা হলে দোকানে আরো কিছু মাল তুলতে পারবে সেই সাথে বিয়েটাও করে ফেলতে পারবে।

কত মানুষ কত ভালো কাজের সাথে যুক্ত। কেউ বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে, কেউ অর্থ সংগ্রহ করে গ্রামবাসীর জীবন মানের উন্নয়ন করছে, কেউ গরীব-মেধাবী ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এই কাজকর্মগুলো দেখলে কি যে ভালো লাগে। কিন্তু দুঃখ হয় তাদের সাথে অংশ নিতে না পেরে। খুব ইচ্ছে করে আমিও ওদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে মানুষের জন্য কিছু করি। অন্তত একজন মানুষের জীবনের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে কিছুটা অন্তত অবদান রাখি। কিন্তু বাস্তবতা খুবই কঠিন। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় খবর আসে কতশত গরিব মানুষের ছেলেমেয়ে অনেক ভালো করছে বিভিন্ন বিষয়ে। কিন্তু সামান্য অর্থের অভাবে আর সামনে এগুতে পারছে না। তখন খুবই অসহায় লাগে নিজেকেই নিজের কাছে।
যে গ্রামে জন্ম নিলাম সেই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। পরবর্তি একশ বছরে আসবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ সেটা চর এলাকা, নদী তার আপন খেয়ালে গড়েছে আবার কোন একদিন সেটা তাসের ঘরের মত ভেঙে গ্রাস করে নিবে। আলো না থাকলে মানুষ যেমন অন্ধকারে থাকে ঠিক তেমনি গ্রামের মানুষগুলোকে দেখেছি কত অন্ধ-কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। তিন বেলা পেটের খাবার যোগাতেই অভিবাবকদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবার মত দিন মজুর বা জোগালির কাজ শুরু করে। মেয়েদের একটু বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টা নদী গ্রাস করে নেবার পর আবারো সেটি পুনর্নিমাণ করা হয়েছে। সেখানেই চলে গ্রামের ছেলেমেয়দের নিভু নিভু শিক্ষা কার্যক্রম। ভালো শিক্ষকের অভাবে পড়াশুনাটা হয় একেবারেই দায়সারাভাবে।

যাইহোক খুব ইচ্ছে করে ওর দুঃখগুলো দূর করে দেই। কিন্তু সেটা করতে গেলেতো অর্থের দরকার। আমি যা সামান্য আয় করি তা দিয়ে আমার ছোট সংসারটা চলে যায় কিন্তু যেহেতু বাড়তি বা উপরি আয়ের কোন ব্যবস্থা নাই তাই সাহায্য করারও মুরোদ নাই। শুধুই মনেমনে ভাবা আর দুঃখবিলাসী জীবনযাপন। সরকারী চাকুরী করে আমি ভালোমতোই সাহায্য করতে পারতাম যদি চলার পথে সামান্য একটু ইনক্লাইন্ড হতাম। অথবা আমি যদি মেধাসম্পন্ন কোন কেউকেটা হতাম তাহলে একটু বাড়তি উপার্জন করে সেখান থেকে সাহায্য করতে পারতাম। অথবা একটা দানবাক্স খুলে বসতে পারতাম তারপর সবার কাছে সাহায্য চাইতাম তারপর সেখান থেকে জনে জনে বিলাতাম। কিন্তু আত্মসম্মানের ভয়ে সেটাও পারি না। তখন ইচ্ছে করে পালিয়ে যায় কাচের দেয়ালের এই শহর ছেড়ে। কোন গ্রামে গিয়ে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। আর পাশাপাশি করব কৃষিকাজ, যেখানে ফাঁকি দেবার কোন উপায় থাকবে না। আর অবসরে পড়াবো গ্রামের গরিব-মেধাবী ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে। কিন্তু করা হয় না কিছুই, আবার শুরু হয় আক্ষেপের আরো একটা নতুন দিন:
রোজ ঘুম থেকে ওঠা আর দাঁত মাজা,
খবর কাগজে দু:সংবাদ খোঁজা।
দারুণ ব্যস্ততায় স্নান-খাওয়া সারা হয়,
জীবনে আরেকদিন আবার বাড়তি হয়।

 

মো: ইয়াকুব আলী
মিন্টো, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top