সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শরৎ ঘরণীকথা : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৫৭

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৫৭


রেঙ্গুন শহরের উপকন্ঠে বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলের বাসাবাড়ির নিজের রুদ্ধ কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ কিছুদিন হল তিনি এই শহরে এসেছেন। বহু চেষ্টায় পরিচিত একজনের সুবাদে বার্মা রেলের এক অফিসে হিসাব রক্ষকের কাজে যোগ দিয়েছেন। বাসা ভাড়া নিয়েছেন বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে। এই অঞ্চলে মূলত: শ্রমিক, মজুর, খালাসীদের বসবাস। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর সন্ধ্যা হলেই নিয়মিত মদ, জুয়ার হুল্লোড় বসে। শরৎচন্দ্র তাই অফিসের কাজ শেষ হলেও এদিক ওদিক ঘুরে বাসায় ফেরেন অনেক রাত্রে। আজকেও সেইরকম একটি দিন ছিলো। অথচ তাঁর কক্ষের দরজাটি ভিতর থেকে বন্ধ। দরজায় করাঘাত করেও খুলছে না রুদ্ধ কক্ষ। ইতিমধ্যে আশেপাশে বেশ কয়েকজন খালাসী মজুরের ভিড় জমে গেছে। এখানকার অধিবাসীরা শরৎচন্দ্রকে বেশ পছন্দ করে। সময়ে অসময়ে তিনি যথাসাধ্য তাদের সহায়তা করেন। কারো অসুখবিসুখ হলে হোমিওপ্যাথির ওষুধ দেন। এরা তাঁকে দাঠাকুর বলে ডাকে। দাঠাকুরকে সাহায্য করতে প্রায় সবাই তাই চলে এসেছে। দরজা ভাঙ্গার কথা ভাবা হচ্ছে। এমন সময়ে সবাইকে অবাক করে খুলে গেল দরজা। শরৎচন্দ্র দেখলেন ঘরের ভিতর থেকে বেতসলতার মতো কাঁপতে কাঁপতে এক অপরূপা সুন্দরী কিশোরী বাইরে এলো। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল কিশোরীর নাম শান্তি। নীচের তলার ভাড়াটে চক্রবর্তীর মেয়ে। চক্রবর্তী খালাসীর কাজ করেন, মাতাল ও জুয়াড়ি হিসাবে তার প্রচন্ড বদনাম আছে। প্রতিরাত্রে নিজের ঘরে মদ ও জুয়ার আসর বসায় নিজের মেয়ের আব্রুর কথা না ভেবেই। আজ সন্ধ্যায় জুয়ায় হেরে অর্থের জন্য শান্তির সাথে এক বৃদ্ধ লম্পট মাতাল জুয়াড়ির বিবাহে সে সম্মত হয়েছে। সেই লম্পট ও সুযোগ বুঝে শান্তির হাত ধরে টানাটানি করতে শান্তি আত্মরক্ষার জন্য ছুটে এসে দাঠাকুরের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলো। উপস্থিত সবাই চক্রবর্তীর মুন্ডুপাত করতে লাগলো। শরৎচন্দ্র তাদের নিরস্ত করে শান্তিকে সেই রাতের মতো তাঁর ঘরে থাকতে দিয়ে চক্রবর্তীর কক্ষে এলেন তাকে বোঝানোর জন্য। সারারাত ধরে বোঝানোর পরেও চক্রবর্তীর সেই এক গোঁ, শান্তির বিবাহ সে ঐ পাত্রের সাথেই দেবে। তার কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়েছে, এই বিবাহ হলে তার ভাতকাপড়ের কোনো অভাব হবে না। পাত্র মাতাল, জুয়াড়ি লম্পট তো কি হয়েছে, পুরুষমানুষের অর্থ থাকলে এইসব দোষ থাকা দোষের নয়।
"আপনি কি আপনার কন্যাটিকে জলে বিসর্জন দিতে চান? পাত্রের বয়স তো আপনার থেকে ও অধিক।"
"বয়স বেশি তো কি হয়েছে, কুলীন ব্রাক্ষণের আবার বয়স| চক্রবর্তী সহসা শরৎচন্দ্রকে বললেন, তা দাঠাকুর আপনার যদি এতই দয়া তবে আপনি কেন শান্তিকে বিবাহ করছেন না, তাহলে আমি কন্যাদায় থেকে উদ্ধার পাই? "
শরৎচন্দ্র একমূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন| তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠলো ভয়ে ত্রাসে বিহ্বলা কিশোরী শান্তির নিস্পাপ মুখ। তিনি শান্তিকে বিবাহের সিদ্ধান্ত নিলেন।
বিবাহ হয়ে গেলো। এই বিবাহে শরৎচন্দ্র সুখী হয়েছিলেন। স্ত্রীর প্রতি তিনি এতোটাই অনুরক্ত ছিলেন যে বন্ধুরা তাঁকে স্ত্রৈণ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয়। কিন্তু ঈশ্বরের বিধান ছিল অন্যরকম। বিবাহের দুই বৎসর পর রেঙ্গুনে প্লেগের মহামারী দেখা দেয়। এক দরিদ্র প্রতিবেশিনীর প্লেগের সেবা করতে গিয়ে শান্তি নিজেও প্লেগে আক্রান্ত হন। শিশুপুত্রটিও রেহাই পায় নি। দুরারোগ্য ব্যাধি কেড়ে নিলো দুইজনের প্রাণ অকালে। সব হারিয়ে শরৎচন্দ্র আত্মহারা হয়ে গেলেন। গিরীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর 'ব্রহ্মদেশে শরৎচন্দ্র' গ্রন্থে লিখেছেন "শরৎচন্দ্র গৃহে প্রবেশ করিয়া শবদেহের উপর আছড়াইয়া পড়িলেন এবং 'ওগো কোথায় গেলে গো ! তুমি যে আমার সকল অবস্থার সাথী ছিলে' বলিয়া বালকের ন্যায় কাঁদিতে লাগিলেন। নিদারুন শোকে তাঁর অন্তর বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হইল।" স্ত্রীর শবদেহ সৎকারে তাঁকে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। প্লেগে মৃত্যু হয়েছে বলে পরিচিত বন্ধুরা (একমাত্র গিরীন্দ্রনাথ সরকার ব্যতীত), প্রতিবেশীরা কেহই সাহায্য করেনি। শরৎচন্দ্র, গিরীন্দ্রনাথ সরকার ও শ্মশানের এক ভাবপাগল সন্ন্যাসীর সহায়তায় অবশেষে সম্পন্ন হয় সৎকারকার্য। এক গল্পকথার মতো রোমান্টিক বিবাহ কাহিনীর অকালে পরিসমাপ্তি ঘটলো। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে আচমকা মিলিয়ে গেল স্ত্রীপুত্র নিয়ে গড়ে তোলা এক সুখের নীড়। যেন পুরোটাই ছিল এক স্বপ্ন। শোকাকুল শরৎচন্দ্র স্থানীয় দূর্গাবাড়ীতে স্ত্রীর শেষ কার্য সম্পন্ন করলেন। ফিরে গেলেন তাঁর পূর্বের একাকী ছন্নছাড়া জীবন প্রবাহে।
মেদিনীপুর জেলার শালবনীর কাছে শ্যামচাঁদপুর গ্রামে বসবাস করতেন কৃষ্ণদাস অধিকারী। তাঁর তিন কন্যা ছিলো। প্রথম দুটি কন্যা পাত্রস্থ হ বার পর স্ত্রীর মৃত্যু হলো। কৃষ্ণদাস পড়লেন বিপাকে। এক পরিচিত ব্যক্তির সুবাদে অষ্টমবর্ষীয়া কনিষ্ঠা কন্যা মোক্ষদাকে নিয়ে রেঙ্গুন চলে এলেন কৃষ্ণদাস। কিন্তু বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হবার পরেও রেঙ্গুনেও তিনি কাজের কোনো সুব্যবস্থা করতে পারলেন না। ইতিমধ্যে মোক্ষদা ও চোদ্দ বৎসরের হয়েছে। চিন্তায় আকুল কৃষ্ণদাস একদিন শরৎচন্দ্রের কাছে এলেন। শরৎচন্দ্রের সাথে এর আগেই তার পরিচিত হয়েছিলো এক পরিচিতের সুবাদে। কুন্ঠাভরে তিনি শরৎচন্দ্রকে জানালেন, " দাঠাকুর আপনি যদি আমায় কিছু অর্থদান করেন, তবে আমি আমার কন্যাটির বিবাহের ব্যবস্থা করতে পারি। অথবা আপনি যদি নিজেই আমার কন্যাটির দারপরিগ্রহ করেন তাহলে আমি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা খুবই উপকৃত হবো।"
শরৎচন্দ্র তাকে অর্থ দিয়েই সাহায্য করতে সম্মত হলেও কৃষ্ণদাস বারংবার তার কন্যাটির পাণিগ্রহণ করতে অনুরোধ জানাতে লাগলেন। শান্তির মৃত্যুর পর বহুদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ভবঘুরে, বোহেমিয়ান শরৎচন্দ্র এই অনুরোধ ফিরাতে না পেরে বিবাহে সম্মতি দিলেন। এই বিবাহ নিয়ে বাংলার বিদ্বৎজনের মধ্যে অনেক বিতর্কের সূচনা ছিলো। অনেকের মতে শরৎচন্দ্র মোক্ষদাকে বিবাহ করেননি। জীবন সঙ্গিনী হিসাবে বসবাস করতেন। শরৎচন্দ্র যখন রেঙ্গুন থেকে ফিরে দেবানন্দপুরে তাঁর পৈত্রিক বাসস্থানে বসবাস করবেন মনস্থির করেছিলেন, সেখানকার সমাজপতিরা তাঁকে অনুমতি দেয়নি বসবাসের এই অবৈধ বিবাহের জন্য। তিনি তাই হাওড়ার বাজেশিবপুরে থাকতে শুরু করেছিলেন| পরবর্তীকালে সামতাবেড়েতে নিজ গৃহ নির্মান করে বসবাস করেন। এই বিবাহের বিপক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি ছিলো যেহেতু বিবাহ হয় নাই, শরৎচন্দ্র চিন্তিত ছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনসঙ্গিনী কোনো সম্পত্তি লাভ থেকে বিচ্যুত হবেন। নিজের ঘনিষ্ট বন্ধু ও আইনজীবির সাথে পরামর্শ করে উইলে মাই ওয়াইফ কথাটি যোগ করেন। শরৎচন্দ্র দেশে ফিরে তাঁর ও মোক্ষদার বিবাহ সম্বন্ধে যে ধোঁয়াশা সমাজে জন্মেছিলো, সেই জল্পনা মোচনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। এই সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে শরৎ গবেষক শ্রী গোপালচন্দ্র রায় যুক্তি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে শরৎচন্দ্র ও মোক্ষদার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিলো। মনে রাখতে হবে যে সেই সময় রেঙ্গুনে তিনি আত্মীয় স্বজন পরিহিত একাকী ছিলেন। আবার কৃষ্ণদাস অধিকারী ও তার কন্যাটিকে নিয়ে একাই থাকতেন। তাই হিন্দু বিবাহের সব নিয়ম ও রীতি হয়তো পালন করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু বিবাহ হয়েছিলো। বিশেষত: তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীকে যেভাবে শরতের ভ্রাতা ভগিনীরা সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন, সেইযুগের সমাজে বিবাহ ছাড়া ইহা সম্ভব নয়। শরৎচন্দ্রের ভগ্নী অনিলা দেবীর সাথে খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর।
ভালোবেসে মোক্ষদা নামটির পরিবর্তন ঘটিয়ে শরৎচন্দ্র স্ত্রীর নাম রাখলেন হিরণ্ময়ী। তাঁর সংসারের সোনার লক্ষীপ্রতিমা। বিবাহের আগে হিরণ্ময়ী নিরক্ষর ছিলেন। শরৎ তাঁকে নিজে কিছুটা লেখাপড়া শেখান। যদিও হিরণ্ময়ী কখনো তাঁর স্বামীকে চিঠি লেখেন নি। শরৎচন্দ্র ও কখনো তাঁকে কোনো চিঠি লিখে বিব্রত করেননি। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর স্ত্রীর পড়তে বা লিখতে একটু অসুবিধা আছে। দেশের জনপ্রিয়তম বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হয়েও তিনি খুব সহজভাবে এটা মানিয়ে নিয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবী ছিলেন প্রকৃত অর্থে স্বামীগরবিনী, স্বামী সোহাগিনী। ব্যক্তিগত ভাবে শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, ধীরস্থির, সুশীলা, সংসারপরায়না রমণী। শরৎচন্দ্রের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হলে তিনি স্ত্রীর কষ্ট লাঘবের জন্য রান্নার লোক রাখলেও হিরণ্ময়ী দেবি প্রতিদিন নিজহাতে স্বামীর জন্য নানাবিধ রান্না করে স্বল্পাহারী শরৎচন্দ্রকে পীড়াপীড়ি করে খাওয়াতেন। অশিক্ষিত হলেও স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সুগভীর। শরৎ চন্দ্র ও তাঁর সুশীলা, সংসারী, ধর্মপরায়ণা স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁর পূজ্জা অর্চনার যাবতীয় ভার বহন করতেন। স্ত্রীকে নিয়ে কাশীতে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। স্ত্রীর কল্যাণী রূপটি তাঁকে অপার মানসিক শান্তি এনে দিয়েছিলো যার ফলস্বরূপ তিনি একের পর এক অমূল্য সাহিত্য রচনায় সক্ষম হয়েছিলেন| তাঁরা নি:সন্তান ছিলেন কিন্তু কোনো কিছুই তাঁদের দাম্পত্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। জীবনের সমস্ত ওঠাপড়ায় হিরন্ময়ী শরৎচন্দ্রের পাশে ছায়া হয়ে ছিলেন। জীবনে বহুবার বহু নারীর কাছ থেকে প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে, অকালে প্রিয়তমা প্রথমা স্ত্রীকে হারিয়ে, শরৎচন্দ্র যেভাবে উচ্ছৃখল, বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন, সেইখান থেকে তাঁকে ফিরিয়ে এনে এক 'ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়' উপহার দিয়ে হিরণ্ময়ী দেবী স্বামীকে অন্য এক শরৎচন্দ্রে পরিণত করেছিলেন।
মৃত্যুর কিছু আগে শরৎচন্দ্র উইল করে তাঁর যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তাঁর স্ত্রীর নামে দান করে যান। ১৯৩৮ খৃ:১৬ই জানুয়ারী যকৃতের ক্যান্সারে শরৎচন্দ্রের মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পরে প্রায় ২৩বছর বেঁচে ছিলেন হিরণ্ময়ী দেবী স্বামীর স্মৃতিকে সম্বল করে| প্রতি বছর স্বামীর মৃত্যুদিবসে তিনি বহু অর্থব্যয় করে গরীব দু:খীদের খাওয়াতেন। ১৯৬০ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যুর সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটলো ভালোবাসায় আর্দ্র এক অপরূপ দাম্পত্যকথার।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top