সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


শিশুশিক্ষা ও আমাদের মনস্তত্ত্ব : সাজিব চৌধুরী


প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০২০ ২৩:০৪

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৯:৪৭

 

শিশুশিক্ষা একটি জটিল বিষয়। এই ধরণের কোন জটিল বিষয় কোন মিথ্যার উপর দাঁড়াতে পারে না। শিশুদের শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা মাঝেমাঝে কিছু ডাহা মিথ্যা কথা বলি। যেমন, ধরুন; কোন শিশুকে পড়ালেখা বিষয়ক উপদেশ দিতে গিয়ে বলি, "পড়ালেখা কী আনন্দের! আমরা ছাত্রজীবনে পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। পড়ালেখার জন্য এতোই আগ্রহী ছিলাম যে টিভি দেখার প্রতি আমাদের কখনও কোন ইচ্ছা-ই জাগত না। শুধু পড়ালেখা আর পড়ালেখা। কখনও খেলতে পর্যন্ত যাইনি।" এই ধরণের আরও কতো কথা।

আসলে কি আমরা কথাগুলো ঠিক বলছি?

আমরা কখনওই এই প্রক্রিয়ায় একজন শিশুর মনোজগৎকে জাগাতে পারব না। শিশুর মনোজগৎকে নাড়াতে হলে বা জাগাতে হলে আমাদের উচিৎ খাঁটি সত্য কথাগুলো বলা।

যেমন, উল্লিখিত কথাগুলোর পরিবর্তে বলতে পারি- "পড়ালেখা বিষয়টি সত্যিই কষ্টের, ছাত্রজীবনে আমারও পড়ালেখা করতে ইচ্ছে হতো না। সবসময় খেলতে ভাল লাগত, ইচ্ছে হতো টিভি দেখতে। আমিও সুযোগ পেলে টিভি দেখতাম। কিন্তু, আমার মা-বাবা ও শিক্ষকগণ আমাকে বাধ্য করতেন পড়া-লেখা করতে। আমি তাঁদের চাপে পড়ে পড়ালেখা করি। একসময় আমার ভাল ফলাফল হয়, পরীক্ষার ফলাফল শুনে সবাই আমার প্রশংসা করেন। আমি তাঁদের প্রশংসায় উৎসাহবোধ করি, পড়ালেখার প্রতি অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। আমি বুঝতে পারি, পড়ালেখা কষ্টের হলেও এর ফল খুবই মধুর। ধাপেধাপে আমি নিজেকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হই। একসময় ভাল ফলাফলের জন্য আমার মধ্যে একধরণের আগ্রহ কাজ করে। পরবর্তীতে তা আমার কাছে অভ্যাস ও নেশায় পরিণত হয়। তখন আমি মনের অজান্তেই পড়ালেখায় নিবিষ্ট হই।"

নিয়মিত লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন সত্যিই কষ্টসাধ্য কাজ। এই কষ্টসাধ্য কাজটি শিশুদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে আমাদের উচিৎ- শিক্ষার গুরুত্বগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় শিশুদের কাছে উপস্থাপন করা। কোন আজগুবি কথা না বলা। আমরা যদি তাকে বোঝাতে পারি যে, যতোই কষ্ট হোক না কেন, শিক্ষাগ্রহণ ছাড়া একজন শিশু প্রকৃত মানুষ হতে পারে না, সে না পারে সমাজের কাছে একজন সম্মানিত মানুষ হতে, না পারে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে। এছাড়া, শিক্ষার অভাবে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে পারে। শিক্ষা যে মানুষের জন্য এক অনিবার্য বিষয়, সেই বিষয়টি একজন শিশুর কাছে স্বচ্ছ ও শুদ্ধভাবে তুলে ধরতে না পারলে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে লেখাপড়ায় মনোযোগী করতে পারব না।

মাঝেমাঝে অভিভাবকদের কাছে শুনি, " আমার ছেলের মেধা ভাল না, আমি ঘরে তিন/চার জন শিক্ষক রেখেছি, এরপরও ছেলের ফলাফল ভাল নয়।"

এক্ষেত্রে, আমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। আমি মনে করি, যে অভিভাবক বলেন, "আমার সন্তানের মেধা ভাল নয়", মূলত সেই অভিভাবক-ই মেধাহীন। সেই অভিভাবকের জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কোন শিশুই মেধার দিক থেকে কম নয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। প্রত্যেক শিশুর মধ্যে নিহিত থাকে অফুরন্ত মেধাশক্তি। প্রয়োজন শুধু যথাযথ পরিচর্যা।

আমাদের ভাবতে হবে, একজন শিশু কেন পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ছে। তার পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো কী কী? কারণগুলো সনাক্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলেই ওই শিশু নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাবে।

আরেকটি বিষয়, আমরা অনেক সময় অনেক চেষ্টা করেও একটা সহজ বিষয় একজন ছাত্রকে বোঝাতে পারি না। যখন বোঝাতে পারি না, তখন বলি, " তুই একটা গাধা বা তুই একটা গরু, এই ধরণের আরও অনেককিছু, এমনকি মাঝেমাঝে শাস্তিও প্রদান করি।"

আচ্ছা বলুন তো, আমি শিক্ষক হিসেবে যদি আমার কোন ছাত্রকে বোঝাতে সক্ষম না হই, তা কি ছাত্রের ব্যর্থতা নাকি আমার? আমি মনে করি, এই ব্যর্থতা নিশ্চিতভাবে আমার। আর এই ব্যর্থতার জন্যে কখনওই একজন ছাত্র উল্লিখিত বকুনি কিংবা গালি শুনতে পারে না। এই গালি মূলত আমারই প্রাপ্য।

আমাদের উচিৎ, একজন ছাত্র সে যেভাবে বুঝতে পারবে সেভাবেই তাকে বোঝানো। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমাদের বোঝানোর কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষাদান পদ্ধতির বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে ছাত্রের জন্য উপযুক্ত কৌশল খুঁজে বের করা একজন দক্ষ শিক্ষকের অন্যতম প্রধান কাজ। তার জন্যে একজন শিক্ষককে হতে হয় খুব বেশি চৌকশ ও কৌশলী। তাঁর থাকতে হয় শিক্ষাদানের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। যেক্ষেত্রে আমরা সনাতন পদ্ধতিতে বোঝাতে অক্ষম হবো, সেক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা দিলে হয়তো শিক্ষার্থী সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে। তবে, একজন দক্ষ শিক্ষক জানেন, কোন পদ্ধতি একজন ছাত্রের জন্য কার্যকরী।

আমাদের উচিৎ একজন শিক্ষার্থীর কাছে সবসময় খাঁটি সত্যকথাগুলো উপস্থাপনের পাশাপাশি ইতিবাচক কথা বলা। "না" শব্দটি যথাসম্ভব বাদ দেওয়া উচিৎ। তাই বলে, আমি বলছি না, খারাপ কিছুকে 'হ্যাঁ' বলতে হবে। তবে, শিশুকে ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় বোঝাতে হবে কোন বিষয়টি ভাল, কোন বিষয়টি খারাপ।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে, যখন শিশুরা নিয়মিত মোবাইল, কম্পিউটার ও নানাবিধ ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে খেলছে, সে সময়ে প্রথাগত পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কতোটা ব্যর্থ হতে পারে তা বলাটাই বাহুল্য। শিশুদের যে সকল উপকরণ এখন খেলার সামগ্রী, সে সকল উপকরণসমূহ শিক্ষাউপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারলেই শিক্ষাদান হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত ও শিশুদের কাছে গ্রহণযোগ্য। একজন শিশু যখন লেখাপড়ার মাঝে খেলার আনন্দ খুঁজে পাবে, তখনই সে পড়ালেখা করতে আগ্রহবোধ করবে। পাশাপাশি এইসব আধুনিক শিক্ষাউপকরণসমূহের নেতিবাচক দিক মাথায় রেখে উপকরণসমূহের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষাগ্রহণে একজন শিক্ষার্থী মনোযোগী হয়ে উঠবে।

আমরা চাই, একজন শিশু আনন্দঘন পরিবেশে বেড়ে উঠুক এবং সুশিক্ষা গ্রহণ করুক। এই আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদের। আর তা না করে যদি নিজেদের ব্যর্থতাকে শিশুদের ব্যর্থতা হিসেবে চালিয়ে দিই, আমরা কখনওই আগামীর জন্য সুনাগরিক গড়ে তুলতে পারব না।

শিশুদেরকে লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণের কৌশল পরিবর্তন করা খুব বেশি জরুরি। একজন শিশুকে  শুরুতেই মানসিক দিক থেকে মজবুত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিশুরা যদি মনের দিক থেকে এগিয়ে না থাকে, তাদেরকে যতোই শিক্ষা দিই না কেন, সেই শিক্ষা কখনও স্থায়ী হবে না। তাদের প্রত্যেককে গড়ে তুলতে হবে একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে।

একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ও প্রতিকারমূলক পলিসি উভয়ই একসাথে প্রয়োগ করতে হয়। আমি লক্ষ্য করেছি, একজন শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ার পেছনে- তার মধ্যে গড়ে ওঠা কিছু খারাপ অভ্যাস সবচেয়ে বেশি দায়ী। এই খারাপ অভ্যাসগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সৃষ্টি হয়। কিছু সৃষ্টি হয় পরিবেশ থেকে, কিছু বন্ধুবান্ধব থেকে। এই খারাপ অভ্যাসগুলো পাত্রের ছিদ্রের মতোই। এই ছিদ্রগুলো বন্ধ করা না গেলে যতোই শিক্ষা দিই না কেন, তা কখনও দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আমি যখন কোন শিক্ষার্থীকে পড়াতে যাই, প্রথমেই তার খারাপ অভ্যাসগুলো সনাক্ত করি। এরপর, খারাপ অভ্যাসগুলো প্রতিকারের ব্যবস্থাগ্রহণ করি। সে যখন শিক্ষাগ্রহণের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে, তখন তাকে শিক্ষা প্রদান করি। এতে, শিক্ষার্থী যেমনটি শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে পারে, তেমনটি তা ধরেও রাখতে পারে।

সর্বোপরি বলা যায়, শিশুশিক্ষার মতো এই কঠিন বিষয়কে সহজ করতে হলে শিশুর পিতামাতা থেকে শুরু করে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে এবং তার জন্য বাস্তবধর্মী পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ করা অতীব জরুরি।

 

সাজিব চৌধুরী
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top