নির্বাসন : মানস চক্রবর্ত্তী
প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২০ ২১:২৯
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১২:২০

আজ বাইশ বছর পর ফিরছি
আমার স্বদেশে,
আমার মায়ের কাছে
ভায়ের কাছে
বন্ধুদের কাছে |
আমার ফেরাতে কেউ সম্বর্ধনা দেবে না
বিরাট কোনো সভা হবে না কোনোখানে
কোনো নারী গলায় দেবে না যুথিকার মালা
তবুও স্বদেশ , মাতৃভূমি
ঐ একটি সুখানুভূতি আমাকে স্বস্তি দেবে |
আমি ফিরছি না
ইউরোপ থেকে কয়েকটা পাশ দিয়ে,
আমি ফিরছি না
জাপান থেকে কোনো বৈজ্ঞানিকের তকমা নিয়ে,
আমি ফিরছি না
কোনো নোবেল বিজেতার গর্বিত স্পর্ধা নিয়ে,
আমি ফিরছি
আন্দামানের একটি জেলখানা থেকে ।
আমাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল
আমার স্বদেশ থেকে
কাছের মানুষ থেকে
মিছিলের প্রতিবাদী মুখ থেকে ।
নির্বাসনের দিনগুলো
আমার বড়ো সুখের ছিল না,
জেলখানায় আমার সম্পত্তির মধ্যে ছিল
একটি থালা , একটি বাটি ,
আলকাতরা মাখানো একটি বালতি
আর দুখানা কম্বল মাত্র ।
ঐ বাটিতে আমি আচমন করতাম
আবার শৌচকার্যেও ব্যবহার করতাম
ভগবান আমার অপরাধ বোধহয় নেননি
কিন্তু কর্তৃপক্ষ মাসে পাঁচ সাতবার আসতেন
কখনো আমার পুরুষাঙ্গ থেঁতলে দেওয়া হতো
কখনো বৃষ্টি বর্ষণের মতো বর্ষিত হতো
কিল, চড়, লাথি ও ঘুষি;
রক্তাত্ব হয়েছে আমার শরীর
আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি ।
আট ফুট বাই ছয়ফুটের একটি ঘরে
এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম
আমি পাগল হতে পারতাম
আত্মহত্যা করতে পারতাম
অনশনে প্রাণ ত্যাগ করতে পারতাম,
কিন্তু সে সব কিছুই আমি করিনি
শুধু আমার মাকে একবার দেখব বলে ।
স্বদেশে ফিরবার লোভটুকু
আমাকে মরতে দেয়নি ।
কিন্তু এ কোন্ স্বদেশ !
আমার মাকে তো দেখতে পাচ্ছি না
যিনি কয়েদখানায় যাবার পূর্বে
আমার চিবুক স্পর্শ করে বলেছিলেন,
খোকা আমি তোর ফেরার অপেক্ষায় রইলাম
জেলেখানা থেকে তুই মুক্তিযুদ্ধের গান নিয়ে আসিস ।
মাগো তোমার কথা স্মরণ করে আমি
জেলখানার শত অত্যাচারেও মরিনি ।
আমি আজ সেই মাকে তো দেখতে পাচ্ছি না
আমি চাষিকে জিজ্ঞাসা করেছি
আমার মাকে দেখেছো ?
চাষি নিশ্চুপ থেকেছে
তার ফসলহীন জমির দিকে তাকিয়ে,
আমি শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করেছি
আমার মাকে দেখেছো ?
হরতালের মোহে সেও উত্তর না দিয়েই চলে গেছে,
আমি রাজ পেয়াদাকে জিজ্ঞাসা করেছি
আমার মাকে দেখেছো ?
রাজার নির্দেশ না পেয়ে সেও চুপ থেকেছে ।
আমি মুটে, মজুর, মালী, তাঁতি
শিক্ষক, পুলিশ, ফেরিওয়ালা
সকলকে জিজ্ঞাসা করেছি
আমার মা কোথায় ?
কেউ উত্তর দিতে পারেনি ।
যে দেশ তার মায়ের খোঁজ রাখে না
সে দেশ তার স্বদেশ নয়,
নদীর কিনারে দেখেছি রক্তাক্ত ওড়না
যে দেশ তার বোনের সম্মান রক্ষা করতে পারেনি
সে দেশ তার স্বদেশ নয়,
ধান ক্ষেতের পাশে দেখেছি
কুকুরে খুবলে খেয়ে যাওয়া
নগ্ন পুরুষ দেহ,
যে দেশ তার বন্ধুকে বাঁচাতে পারেনি
সে দেশ তার স্বদেশ নয়,
সে দেশ পৈশাচিকের উন্মাদনা ক্ষেত্র
একটি মৃত্যু উপত্যকা ।
হে রাজ কর্তৃপক্ষগণ
আমি মুক্তি চাই না
আমি চাই আমৃত্যু আর একটি দূরত্ব,
স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর কাছ থেকে
আমি চাই আমৃত্যু আর একটি নির্বাসন দণ্ড।|
মানস চক্রবর্ত্তী
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বিষয়: মানস চক্রবর্ত্তী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: