এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল : এডভোকেট দিদার আলম কল্লোল
প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২০ ০০:০৪
আপডেট:
১২ জুলাই ২০২০ ২২:৪৭
এতদিন আমরা জানতাম জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ 'মাসুদ রানা'র লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন, এখন মানুষ জানলো তিনি নন, এর প্রকৃত লেখক শেখ আব্দুল হাকিম। ১০ বছর আগে শেখ আব্দুল হাকিম বাংলাদেশ কপিরাইট রেজিষ্ট্রার অফিসে তাঁর লেখকস্বত্ত্ব দাবি করে যে অভিযোগ করেন তা নিস্পত্তি করে গত ১৪ ইং জুন ২০২০ ইং তারিখের রায়ে বলা হয় সেবা প্রকাশনীর 'মাসুদ রানা' সিরিজের ২৬০ টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০ টি বইয়ের লেখক শেখ আব্দুল হাকিম। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম ১৮ টি বইয়ের পরের ২৬০টি বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নন, শেখ আব্দুল হাকিম। অবশ্য এখনো কয়েকটি আইনী ধাপ বাকি আছে।
প্রথম বাংলাদেশি এভারেস্ট বিজয়ী হিসেবে আমরা জানি মুসা ইব্রাহীম। এখন কেউ কেউ বলেন এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদার। এরকম একটি জাতীয় গৌরবের বিষয় ও বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রনীত প্রথম পর্বতারোহীদের তালিকায় মুসা ইব্রাহিমের নাম না থাকায় বিতর্কটি বেশ ডালপালা মেলেছিল। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তবে বেশীর ভাগ মানুষই জানেন মুসা ইব্রাহিমই এভারেস্ট চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়ান।
এতদিন আমরা জানতাম ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন হচ্ছেন কোরানের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী কিন্তু এখন কেউ বলছেন কোরানের প্রথম বাংলায় অনুবাদকারী মৌলভী নাইমুদ্দিন, কেউ বলছেন আমিরুদ্দীন বসুনিয়া আর গিরিশ চন্দ্র সেন হচ্ছেন প্রকাশক। প্রকৃত সত্য হচ্ছে গিরিশ চন্দ্র সেন ১৮৮৬ সালে সম্পূর্ণ কোরানের প্রথম বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করেন। যদিও তার অনেক আগে পবিত্র কোরান শরীফের আংশিক অর্থাৎ আমপারার অনুবাদ করেছিলেন রংপুরের আমিরুদ্দিন বসুনিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের মৌলভী নাইমুদ্দিন গিরিশ চন্দ্রের পরে অর্থাৎ ১৮৮৭, ১৮৮৯ ও ১৮৯১ সাথে তিন খন্ডে কোরানের পূর্নাঙ্গ বঙ্গানুবাদ করেন।
এতদিন ধরে মানুষ জেনে আসছে দৈনিক ইত্তেফাক এর প্রতিষ্ঠাতা তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে মাওলানা ভাসানী ও ইয়ার মোহাম্মদ এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ও জনমত গঠনে এ পত্রিকাটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস পড়ে এতদিন মানুষ জেনে আসছিল উত্তর থেকে ঘোড়ায় চড়ে আসা উঁচু জাতের সাদা আর্যরা এসে ভারতবর্ষে প্রথম বসতি স্থাপন করে, তাঁরাই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা, আমাদের পূর্বপুরুষ এবং তাদের হাতেই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে এখন জানা গেল, আমরা এতদিন যে ইতিহাস জানতাম তা সত্য ছিল না, ভুল ছিল। এখন জানা গেল আর্যরা আসার হাজার হাজার বছর আগেই ভারতবর্ষে মিশর, গ্ৰীক ও মেসোপটিয়ান সভ্যতার সমসাময়িক সভ্যতা এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো। আদি আফ্রিকান শিকার সংগ্ৰাহকরা এবং ইরান থেকে একটি বড় জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলে, আর্যরা নয়।
হাজার বছর ধরে এদেশের বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ নামাজ রোজা আদায় করে আসছে, এখন বলে কি নামাজ রোজা বলে কোন শব্দ কোরানে নেই, আছে সালাত বা সালাহ্ এবং সিয়াম, ভাল কথা। এখন মাওলানা সাহেবরা যতবার ফার্সী শব্দ 'নামাজ' ও 'রোজা' উচ্চারন করেন তার চেয়ে অনেক গুন বেশি আরবি 'সালাহ্' ও 'সিয়াম' উচ্চারণ করেন। কেন, ফার্সীতে কি তাঁরা শিয়াদের গন্ধ খুঁজে পান! রমজান মাস এখন হয়ে গেছে রমাদান মাস। অজু হয়ে গেছে অদু। সুন্নত হয়ে গেছে সুন্নাহ। আর 'জাযাকাল্লা খাইরান' যে কি জিনিস এটা বোধহয় তাঁরা নিজেরাও জানে না। আরো কয়েকদিন পরে হয়ত শুনবো হাদিসকে ইংরেজি আরবি উচ্চারনের ভঙ্গিমায় বলছে হাদিত। বিচিত্র না, কাল হয়ত বলবে আজান বলে কোন শব্দ নেই, বলতে হবে আদান। আমরা সচরাচর বলে আসছি বরকত। এখন তাঁরা বরকত না বলে আরবি উচ্চারনে বলেন বারাকাহ্। শুধু কি তাই, মুসলিম নরনারীর জন্ম জন্মান্তরের লালিত সবচেয়ে প্রিয় শব্দ 'আল্লাহ' বা 'আল্লাহতায়ালা' ও এখন কিঞ্চিত বর্ধিত কলেবরে অলঙ্কৃত হয়ে 'আল্লাহ সুবহানাতাআলা' হয়ে গেছেন। আল্লাহকে কি তাঁর গুনবাচক বিশেষন লাগিয়ে বড় করে না ডাকলে তিনি গোস্যা করেন? আমার মনে হয় তাঁরা আরবি সালাত-সিয়াম চালু করার যত চেষ্টাই করুন না কেন, দিনশেষে মানুষ ফার্সী নামাজ-রোজাই বলবে। কারন এগুলো তাঁদের অন্তরাত্মা ও শিখড়ের গভীরে প্রোথিত।
জন্মের পর থেকে মানুষ জানলো এবং বিশ্বাস করল সাতটা বেহেস্ত আছে। এখন হুজুররা বলে বেড়াচ্ছেন সাতটি বেহেস্ত নয়, বেহেস্তের সাতটি দরজা, গেইট বা স্তর আছে। জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাতের সর্বোচ্চ লেবেল বা স্তর। আর তাইতো এখন কেউ মারা গেলে অনেকে শোকবার্তায় লেখেন 'হে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান কর', আগে লিখত হে আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন, জান্নাতবাসী করুন বা জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। এখনো জান্নাত বলে, আরো কয়েকদিন পরে হয়তো আরবি উচ্চারনে বলবে জান্নাহ্, যেমন কথায় কথায় বলে তাকওয়াহ্, তাফসির, ইস্তেহাদ। ক'জন এর অর্থ বুঝে সেদিকে খেয়াল নেই। সেহরির পরিবর্তে সাহরি।
দু'চারটে আরবি শব্দ আওড়াতে না পারলে বা আবিষ্কার করতে না পারলে কি তাদের মুসলমানিত্ত্ব ও ইসলামের মহিমা প্রকাশ পায়, ইলিমের জোর ও দৌরাত্ম বুঝা যায়! মানুষের মন ও মননের গভীরে প্রোথিত, প্রতিষ্টিত ও আবেগের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত সহজবোধ্য মৌলিক ধর্মীয় শব্দগুলোকে কেন পরিবর্তন করা হচ্ছে, তা আমার বোধগম্য নয়। তাঁরা হয়ত এ বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই এসব করছেন 'যতই আরবীকরন ততই ইসলামীকরন'। এতে করে ইসলাম ধর্ম কতটা আকর্ষণীয় পরিশীলিত ও পরিমার্জিত হচ্ছে জানিনা তবে তাঁদের এহেন অতিউৎসাহী অবিবেচক স্থূল কর্মকাণ্ড সাধারণ মুছল্লীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সমুহ আশঙ্কা ও অবকাশ থেকে যায়।
বিদেশী ভাষাজ্ঞান ও চর্চা যত বাড়বে ততই আমাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও আদান প্রদান বাড়বে, জাতি হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ হবো, ঠিক, কিন্তু তার যেন অপপ্রয়োগ না হয়। প্রায়োগিক দিকটায় আমরা যেন নিজের ভাষার কথা ভুলে না যাই, কোন ধরনের হীনমন্যতায় না ভুগী, রক্তস্নাত মাতৃভাষাকে খাটো, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হেয় প্রতিপন্ন না করি, ভাষার শুদ্ধতা, সৌন্দর্য, মাধুর্য ও মর্যাদা নষ্ট না করি, এককথায় ভাষার বলাৎকার না করি। এটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা।
ছোটবেলা থেকে যে ধর্মপ্রান মানুষগুলো মহা উৎসাহ উদ্দীপনায় সবেবরাত পালন করে আসছে, সেটারও নাকি কোন ভিত্তি নেই। সবেবরাত বলে নাকি কিছুই নেই, এটা পালন করা বেদাতি কাজ, যে দিনটিতে সরকারি ছুটি থাকে, সেই সবেবরাত বলে নাকি কোরান হাদিস বা ইসলামে কিছু নাই,কোন দলিল নাই। তাহলে এতকাল কি আমরা ভুল শিখলাম? আগে শুনতাম মিলাদুন্নবী এখন শুনি সীরাতুননবী, এটার ও নাকি দলিল আছে।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মুসলমান জানে তারাবির নামাজ বিশ রাকাত, এখন এটাও নাকি সঠিক নয়। একদল হুজুর বলে বেড়াচ্ছেন রসুলুল্লাহ (সাঃ) তারাবি কখনোই বিশ রাকাত পড়েন নাই। তাই আট রাকাত বা বারো রাকাত পড়লেই হবে, এটাও নাকি দলিল কিতাবে আছে। আগে বাঙ্গালদের হাইকোর্ট দেখানো হত, এখন সবাই কথায় কথায় দলিল দেখায়। বাংলাদেশে জমিদার-জোরদারদের ঘরেও এখন জায়গা জমির এত দলিল নেই যত দলিল এখন তাঁরা পকেটে নিয়ে ঘুরে। ঠিক কিনা, চিল্লায়া কন। শত শত বছর ধরে বাঙ্গালী মুসলমানদের বহুল ব্যবহৃত বিদায় সম্ভাষণ 'খোদা হাফেজ' তো বহু আগেই বিদায় নিয়েছে, এটা নাকি বলা এতদিন ভুল ছিল, তাই এখন শুদ্ধ করে শিখানো হচ্ছে 'আল্লাহ হাফেজ'।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে এবার ঈদে কেউ কেউ ফেইসবুকে ' তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম' বলে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমি তাদের পাল্টা শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি, আমি তো এই ঘোড়ার ডিম কিছুই বুঝিনি বরং ভীষণ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি। ঈদ মোবারক এর পরিবর্তে এখন নাকি এটি বলতে হবে। কি অদ্ভুত আবিস্কার। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য আত্মদানকারী রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, তোরা আমাদের ক্ষমা করে দিস ভাই। ক্ষমা করে দিও হে বঙ্গবন্ধু তুমি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বাংলায় বক্তৃতা করেও বেকুব বাঙ্গালীকে ভাষাদরদী করে যেতে পারোনি। ক্ষমা করে দিও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ তুমি ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি সর্বপ্রথম উত্তাপন করেছিলে এবং একাত্তরের ২৯ মার্চ নিখোঁজ ও শহীদ হয়েছিলে। ক্ষমা করে দিও রফিকুল ইসলাম, তুমি কানাডা প্রবাসী হয়েও ৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে বিশ্বের ভাষাসমুহকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব করেছিলে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করে ২০০২ সালে। ক্ষমা করে দিও মাওলানা ভাসানী তুমি চল্লিশের দশকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম প্রাদেশিক ল্যাজিসলেটিভ এ্যসেম্লীর প্রথম বাজেট অধিবেশনে ১৯৪৮ সালে দাবি করেছিলে, পরিষদে বাংলায় বক্তব্য দিতে হবে, যেহেতু আমরা সবাই বাংলাভাষী। ক্ষমা করে দিও ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, অলি আহাদ, গাজীউল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, আবুল কাশেম, শাহেদ আলী,আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশসহ অসংখ্য অগনিত ভাষা সংগ্রামী ভাই বোনেরা, আমরা তোমাদের চির আরাধ্য বাংলা ভাষাকে এখনো মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারিনি। ওরা এখনও আমাদের মুখ থেকে ঈদ মোবারক কেড়ে নিবার চায়।
ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে অনেকে বাংলা ভাষার বানান রীতি পাল্টে ফেলছেন। সহজ, সরল, সাবলীল শব্দগুলোকে অকারনে কঠিন যুক্তাক্ষরে পরিনত করছেন। যেমন, একটা কে লিখছেন এক্টা, একটু কে এক্টু, এমনি কে এম্মি, আপনি কে আপ্নি, নজরুল কে নজ্রূল, এভাবে লিখছেন। তাহলে কি এতকাল যা শিখেছি ভুল, সবই ভুল। এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লিখা সে ভুল, সবই ভুল। জানি না এগুলো প্রমিত বাংলা অভিধান সমর্থিত কিনা? যদি না হয় তাহলে এ প্রবনতা অবশ্যই আমাদের পরিহার করা উচিত।
এডভোকেট দিদার আলম কল্লোল
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বিষয়: এডভোকেট দিদার আলম কল্লোল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: