সিডনী শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২২শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১


বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী-সব ধর্মের লোকরাই তাঁর কাছে সমান : বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী


প্রকাশিত:
২৭ মে ২০২০ ২২:৩১

আপডেট:
২৭ মে ২০২০ ২২:৪১

 

লোকনাথ বাবা ১১৩৭ বঙ্গাব্দ বা ইংরেজি ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে তত্কালীন যশোহর জেলা আর বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চৌরশী চাকলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতার নাম রামনারায়ন ঘোষাল এবং তাঁর মাতা কমলাদেবী । তিনি ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের চতুর্থ পুত্র । তাঁর পরিবার ছিল ধার্মিক ব্রাহ্মন । রামনারায়ন ঘোষাল লোকনাথকে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করানোর জন্য ১১ বছরে উপনয়ন দিয়ে পাশের গ্রামের ভগবান গাঙ্গুলীর হাতে তুলে দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গী হন বাল্যবন্ধু বেনীমাধব।

মহাজ্ঞানী গুরু ভগবান গাঙ্গুলী লোকনাথ ও বেনীমাধব উভয়েরই আচার্যগুরু রূপে তাঁদের উপনয়নক্রিয়া সম্পন্ন করে তাঁদের নিয়ে গৃহ ত্যাগ করলেন। গুরু ভগবান গাঙ্গুলী তাঁদের প্রাথমিক শিক্ষাদান আরম্ভ করলেন কালীঘাটে। এই স্থান তখন দীর্ঘ জটাধারী সাধু সন্ন্যাসীতে পরিপূর্ণ। এই দুই বালক মিলে কোনসময় সাধুদের জটা ধরে টানে, কোন সময় তাঁদের নেংটি ধরে টানে এবং সন্ন্যাসীদের ধ্যান ভঙ্গ করে দেয়। বিভিন্ন স্থান ঘুরে তারা পদব্রজে হিমালয়ের দিকে রওনা দেন। হিমালয়ের বরফাকৃত নির্জন স্থানে বছরের পর বছর নিয়মিত ভাবে গুরুর নির্দেশ মতো লোকনাথের যোগসাধনা চলতে থাকে। দীর্ঘ সাধনার পর একদিন লোকনাথ ব্রহ্মদর্শন করলেন এবং তিনি সিদ্ধিলাভ করলেন। যোগী ব্রহ্মচারী লোকনাথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেন। সার্থক গুরু মহাজ্ঞানী ভগবান গাঙ্গুলী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে মহাতীর্থ কাশীধামে আসেন এবং এখানেই মণিকর্ণিকার ঘাটে মহাজপে উপবিষ্ট অবস্থায় গুরু ভগবান দেহত্যাগ করেন।

গুরুর দেহায়নের পর ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার  শুরু হয় দেশ ভ্রমণ। প্রথমে হিমালয় থেকে কাবুল দেশে আসেন। সেখানে মোল্লা সাদী নামে এক মুসলমানের সঙ্গে কোরান, বেদ-সহ বিভিন্ন শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করে ইসলামধর্মের তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন। লোকনাথ পশ্চিম দিকে দিয়ে আফগানিস্তানমক্কামদিনা ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন। মক্কাদেশীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। সেখানে আবদুল গফুর নামে এক মহাপুরুষের সাথে পরিচিত হন। লোকনাথ বাবা দিন কয়েক তাঁর সংসর্গে কাটান। লোকনাথ বাবা বলেছেন, "আমি মক্কায় আবদুল গফুর নামে এক ব্রাহ্মন দেখেছি”।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রীষ্টান সব ধর্মের লোকরাই ছিল সমান।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান যেমন হরিদ্বার, বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী প্রভৃতি ছাড়াও আফগানিস্থান, পারস্য, আরবদেশ, গ্রীস, তুরস্ক, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ঘুরে লোকনাথ বাবা আবার ভারতে ফেরেন এবং ভারতের কয়েকটি তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করে আবার হিমালয়ের পথ ধরে উত্তরে যাত্রা করেন। চিরবরফাবৃত সুমেরু যেখানে দিবালোক নেই, আকাশ কুয়াশাজালে আবদ্ধ, সুমেরু ভ্রমণ করে লোকনাথ এবং বেনীমাধব চীনে প্রবেশ করেন। কাশীধামের "শ্রী শ্রী তৈলঙ্গস্বামীই মহাপুরুষ হিতলাল মিশ্র যাঁর হাতে প্রিয় শিষ্যদের ভার সমর্পণ করে গুরু ভগবান দেহত্যাগ করেন। ওনার কথায় এবার লোকনাথ বাবা নিম্নভূমিতে যাত্রা করেন। লোকনাথ বাবা আসাম হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে শ্রীমৎ পাহাড়ে শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী হঠাৎ ভীষণ দাবানলের মধ্যে আটকে পড়েন এবং লোকনাথ বাবা তাকে উদ্ধার করেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান কালে এক বাঘিনী দয়ালু লোকনাথ বাবার কাছে তার শাবকদের নিরাপদে রেখে শিকারে যেত। এখান থেকে বেনীমাধব ও লোকনাথ পৃথক হয়ে নিজ নিজ কর্মপথে চললেন।

ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে এক বৃক্ষের ছায়ায় বাবা অবস্থান করেন। সামনে দিয়ে অনেক লোক যায়, কেউ বা তাঁকে দেখে পাগল ভাবে কেউ আবার ফলমূল দেয়। অপরাধী ডেঙ্গু কর্মকার যার বিচারে প্রাণদন্ড হওয়ার কথা। বাবার স্মরণে আসলে বাবা বললেন তুই মুক্তি পাবি এবং পরদিন বিচারে সে নিদোর্ষ বলে খালাস পায়। ডেঙ্গুর অনুরোধে লোকনাথ বাবা বারদী গ্রামে আসতে রাজি হন। বারদীতে সকলেই লোকনাথ বাবাকে নীচ জাতি, পাগল ও অপবিত্র বলে মনে করে। একদিন কয়েকজন ব্রাহ্মণ গ্রন্থি দিতে গিয়ে তাদের পৈতেতে জট ফেলেছেন আর খুলতে পারছেন না। লোকনাথ বাবা তাঁদের দিকে যেতেই তারা রেগে তাকে দূর হয়ে যেতে বললেন। বাবা কিন্তু হাসিমুখে তাদের বললেন তর্ক না করে তোমাদের গোত্র বল। গোত্র শুনে বাবার গায়ত্রী জপে সব জট খুলে গেল। সাধুরা বুঝলেন ইনি কোনো মহাপুরুষ হবেন এবং লোকমুখে বাবার প্রচার শুরু হয়ে গেল।

নারায়ণগঞ্জের বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় লোকনাথের কথা শুনে তাঁর জন্য জমি দান করেন এবং সেখানে মহা ধুম-ধামের সঙ্গে আশ্রম স্থাপন করা হয়। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের কথা শুনে দেশ-দেশান্তর হতে বহু ভক্ত এসে ভিড় জমাতে থাকেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাবার আশ্রম তীর্থভূমিতে পরিণত হয়। কোনো এক সময় ভাওয়ালের মহারাজ তাঁর ফটো তুলে রাখেন। যে ফটো বর্তমানে ঘরে ঘরে পূজিত হয়।

শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম
সেদিন ছিল ১৯শে জৈষ্ঠ, রবিবার। বাবা নিজেই বললেন তার প্রয়াণের কথা। বহু মানুষ আসেন তাঁকে শেষ দর্শন করার জন্য। কথিত আছে একসময় লোকনাথ মহাযোগে বসেন। সবাই নির্বাক হয়ে অশ্রুসজল চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন কখন বাবার মহাযোগ ভাঙ্গবে। কিন্তু ঐ মহাযোগ আর ভাঙেনি। শেষ পর্যন্ত ১১.৪৫ মিনিটে দেহ স্পর্শ করা হলে দেহ মাটিতে পড়ে যায়। বাংলা ১২৯৭ সালের ১৯ জ্যৈষ্ঠ (১ জুন, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ) ১৬০ বছর বয়সে লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করেন।

নারায়ণগঞ্জের বারদীর শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে প্রতি বছর উনিশ জৈষ্ঠ মহাপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর তিরোধান উৎসব ও সপ্তাহ ব্যাপী মেলা বসে । তার এই মহাকাল প্রয়াণের দিনটিকে ভক্তি শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে স্মরণ করার জন্যই এই উৎসব ও  মেলার আয়োজন হয় । এই তিরোধান উৎসবে অংশগ্রহণ করতে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাসহ দেশের লক্ষাধিক লোকনাথ ভক্ত বারদী আশ্রমে এসে সমবেত হন । জৈষ্ঠের উনিশ তারিখ আশ্রমের চৌচালা ছাদের উপর থেকে ভক্তদের ছুঁড়ে দেয়া বাতাসা মিষ্টান্ন ও তা কুড়ানোর উচ্ছ্বল আয়োজন হয় যা “হরি লুট” নামে পরিচিত। এছাড়া দিন ব্যাপী  চলে গীতা পাঠ, বাল্যভোগ, লোকনাথের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ, রাজভোগ, প্রসাদ বিতরণ ও আরতী কীর্তনসহ ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান।

শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের দক্ষিণের উঠানে তাঁর সমাধিস্থলের পশ্চিমে শত বৎসর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির একটি বকুল গাছ । আশ্রমের ভেতরে আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিশাল তৈলচিত্র । মূল আশ্রমের পেছনে খোলা উঠান পেরিয়ে বিশাল পাঁচতলা ভবনের যাত্রীনিবাস । পশ্চিমে আরও দুটি বিশালাকার যাত্রীনিবাস । ভক্ত ও দর্শণার্থীরা বিনা পয়সায় এখানে রাত্রিযাপন করেন। সাধক পুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবিত থাকা অবস্থায় আশ্রমের পাশে কামনা সাগর ও জিয়স নামে পুকুর খনন করা হয়। এই পুকুরটিতে আশ্রমে আগত ভক্তরা স্নান করেন।

বারদীর লোকনাথ আশ্রম এখন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থানই নয়, বরং ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল ধর্মের, সকল মানুষের কাছে এক মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত।

ত্রিকালদর্শী বাবা লোকনাথ বলেছেন, ‘প্রতিদিন রাতে শোবার সময় সারাদিনের কাজের হিসাব-নিকাশ করবি অর্থাত্ ভাল কাজ কী কী করেছিস আর খারাপ কাজ কী কী করেছিস? যে সকল কাজ খারাপ বলে বিবেচনা করলি সে সকল কাজ আর যাতে না করতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি।’ আবার তিনি বলেছেন, ‘সূর্য উঠলে যেমন আঁধার পালিয়ে যায়। গৃহস্থের ঘুম ভেঙে গেলে যেমন চোর পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি বার-বার বিচার করলে খারাপ কাজ করবার প্রবৃত্তি পালিয়ে যাবে।’

 

লেখকঃ বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top