সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


শরতের সৌন্দর্য মহান রবের অনন্য উপহার : মোঃ শামছুল আলম


প্রকাশিত:
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৭

আপডেট:
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৩

ছবিঃ মোঃ শামছুল আলম

 

সবুজ শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ আমাদের এ দেশ অপরুপ ঋতু বৈচিত্র্যের আধার। অপূর্ব রুপ এবং অফুরন্ত সম্ভার নিয়ে এখানে একের পর এক আবর্তিত হয় ছয়টি ঋতু। বর্ষার অবিশ্রান্ত রিমঝিম গানের অলস বিধুর মনথরন যখন ক্লান্তিতে মনকে বিষন্ন করে তোলে, ঠিক তখন শরৎ তার স্নিগ্ধরুপ মাধুর্য নিয়ে হঠাৎ আলোর মতো নীল আকাশে ঝলমল করে হেসে ওঠে। শিউলি ঝরা শরতের মেঘশুণ্য নীলাকাশ হেমন্তের কনক ধানের সোনালী সম্ভার প্রকৃতিকে করে প্রাণময়তা।
শরৎ মানেই যেন সুদূর নীলিমায় ধূমল-কোমল, গৈরিক আর শুভ্র মেঘেদের অবাধ বিচরণ। শুধু মেঘ আর মেঘ আকাশে যেন এখন মেঘেদের মিলনমেলা। পালতোলা নৌকার মতো নীল আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো এই সাদা মেঘমালা মনে এনে দেয় প্রশান্তির আবেশ। এই মেঘ আল্লাহতায়ালার এক বিশাল নেয়ামতের নাম। আল্লাহতায়ালা বলেন-

‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, তৎপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন, অতঃপর তুমি দেখো যে, তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বারিধারা।’ (সুরা আন-নুর, আয়াত : ৪৩)

শরতের এই নীলাকাশের দিকে তাকালে অন্তরে সৌন্দর্যবোধ রয়েছে এমন মানুষমাত্রই যেমন মোহিত না হয়ে, তেমনি মুমিন বান্দা হলে এই আকাশের স্রষ্টা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করেও থাকতে পারে না।
সত্যি! শরতের রূপবর্ণনা যেন শেষ করার মতো নয়। শরতের চাঁদনি রাতের যেই স্নিগ্ধতা তা না ভাষায় ব্যক্ত করা যায়, আর না অক্ষরের সীমাবদ্ধতায় তৃপ্তি পাওয়া যায়। শরতের চাঁদনি রাতের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে এক অন্যরকম মায়াবী পরিবেশ। চারদিকে সজীব গাছপালার ওপর বয়ে যায় ঝিরঝিরে বাতাস। বাতাসে উড়ে বেড়ায় নীল জোনাকির দল। শুভ্র চাঁদোয়ায় আকাশ থেকে যেন নেমে আসে রূপকথার কল্প পরীরা। আর চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর পরশে দুই চোখ বন্ধ করলেই শোনা যায়, মনের মিনারে ধ্বনিত হওয়া সেই শাশ্বত পয়গাম-

‘মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি আকাশে বুরুজ বানিয়েছেন এবং তাতে এক উজ্জ্বল প্রদীপ ও আলোকিত চাঁদ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৫-৬১)

কাশফুল, পরিষ্কার নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ? শব্দগুলো শুনলেই মনে আসে ঋতুর রানি শরতের নাম ? বাংলার প্রকৃতিতে শরতের আবির্ভাব মুগ্ধ করে সবাইকে। ‘‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গলি?” এভাবেই বাঙালির সামনে শরতের সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত আল্পনা এঁকেছেন। তার
‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’সহ অনেক গানই শরৎ-প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে। শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে উঠেছে এসব রচনায়।

‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।
দলি শাপলা শালুক শতদল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল
নীল লাল ঝরায়ে ঢল ঢল এসো অরণ্য পর্বতে।’

মুস্তফা মনোয়ারের মতে, শরৎ হচ্ছে চমৎকার মেঘের ঋতু, স্পষ্টতার ঋতু। কেননা শরতের আকাশ থাকে ঝকঝকে পরিষ্কার। নীল আকাশের মাঝে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ যেন ভেসে বেড়ায়। তিনি বলেন,

‘‘গ্রামের বধূ যেমন মাটি লেপন করে নিজ গৃহকে নিপুণ করে তোলে, তেমনি শরৎকাল প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। বর্ষার পরে গাছগুলো সজীব হয়ে ওঠে। আকাশে হালকা মেঘগুলো উড়ে উড়ে যায়।” শরৎ মানেই নদীর তীরে কাশফুল। শরৎ মানেই গাছে গাছে হাসনাহেনা আর বিলে শাপলার সমারোহ। শরৎ মানেই গাছে পাকা তাল। সেই তাল দিয়ে তৈরি পিঠা, পায়েস। আর ক্ষেতে ক্ষেতে আমন ধানের বেড়ে ওঠা চারা।"

শরতের এই রূপসৌন্দর্য একদিকে যেমন মানুষের মনকে প্রকৃতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি মনের বাগিচায় রোপণ করে প্রভুপ্রেমের সবুজ চারা। আর এটাই যে মুমিন বান্দার বহিঃপ্রকাশ। শরতে নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে টইটম্বুর হয়ে থাকে। যার ভেতরে ঝাঁক বেঁধে মনের আনন্দে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিলের হাঁটুপানিতে চুপচাপ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাদা সাদা বক।

সবমিলিয়ে শরৎ যেন শুভ্রতার ঋতু, পবিত্রতার প্রতীক। সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য চাই সুস্থ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনুকূল ও সুন্দর পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব দীর্ঘ হতে পারে না। বনভূমি ও বন্য পশুপাখি আল্লাহ তায়ালার দান ও প্রকৃতির শোভাবর্ধক। রাসুল (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা আরোপ করেছেন। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য অবশ্যই ইসলামের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য বন-জঙ্গল ও গাছপালা অতীব প্রয়োজনীয়, যা মানুষ নির্বিচারে ধ্বংসে মেতেছে। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামের আরেকটি মৌলিক নীতি হলো, প্রকৃতির অন্য সৃষ্টির কোনোরূপ ধ্বংস, বিনাশ, অপচয় বা অপব্যবহার করা যাবে না।

তাই আসুন! পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রকৃতির প্রতি উদারতা প্রকাশ করি এবং শরতের এই বিমুগ্ধ রূপমাধুর্যে মোহিত হয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ অবনত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি, প্রভু! সবার মনের পুঞ্জীবনে জমাট বাঁধা কষ্টগুলো ধুয়ে-মুছে দিন শরতের শুভ্রতায়।

নির্মল আকাশের বুকজুড়ে রাশি রাশি সাদা মেঘ মানব হৃদয়ে প্রভুপ্রেমের যে বারতা নিয়ে আসে, সেই শাশ্বত বারতার আলোকে জীবন সাজাই।


মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top