সিয়াম নৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের হাতিয়ার : আনোয়ার আল ফারুক
প্রকাশিত:
২২ এপ্রিল ২০২১ ২১:২৯
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০১:৩৩
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাদের কল্যাণে বিভিন্ন ইবাদত ফরজ করেছেন। প্রত্যেকটি ইবাদতের পিছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য ও অফুরন্ত ফজিলত ভান্ডার। সিয়ামের ব্যক্তিক পারিবারিক আত্মিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক গুরুত্ব। সুন্দর নৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মানের সিয়াম সাধনা এক বিশাল ভুমিকা রাখে।
১। সৎ ও নৈতিক জনগোষ্ঠি তৈরিঃ
সিয়াম ফরজ করার পিছনে যে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য সেটা হচ্ছে আল্লাহ ভীরু সৎ ও যোগ্য লোক সৃষ্টি করা। এই প্রসঙ্গে বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেন- "আমি তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করেছি যেমনি ফরজ করেছি তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, আশা করা যায় যে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।"(সুরা বাকারা)। আমাদের সামাজিক জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাকওয়াবান ব্যক্তিরা সমাজ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারাই পারে একটি বিশৃংখলিত সমাজের লাগাম পরিয়ে সমাজকে শান্তিময় করার পাশাপাশি সমাজ জাতিকে ইনসাফের মানদণ্ডে দাঁড় করাতে। আজকে আমাদের সমাজের যাবতীয় অবক্ষয়ের মূল কারণ হচ্ছে সমাজে বসবাসরত জনগোষ্ঠির তাকওয়া ও নৈতিক যথাযথ মানের অভাব। এই অভাববোধ না কাটলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দিনদিন ভঙ্গুর হতে থাকবে আর ভেঙে যাবে সামাজিক বন্ধনের চিরায়াত ভীত।ফলে সমাজ জাতির কপালে নেমে আসবে এক মহা অশনি সংকেত। সমাজে বসবাসরত জনগোষ্ঠী যত তাকওয়াবান ও নৈতিক গুণে গুণান্বিত হবে সমাজ জাতির ভীত ততই মজবুত হবে। কোন নৈতিক ও তাকওয়াবান ব্যক্তির পক্ষে আদৌ সম্ভব নয় অন্যের অধিকার হরণ করা, ঘুস সুদ গ্রহণ ও অন্যায়ভাবে অন্যের ধন সম্পদ তসরুফ করা। কিন্তু আমরা গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখব যে আজ আমাদের সমাজ জাতির অধপতনের পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেটি হচ্ছে লোভ লালসার ফলে অন্যের ধন সম্পদের প্রতি শকুনি দৃষ্টি ও জোর জবর দখলের মাধ্যমে অন্যের হক নষ্ট করা। অথচ এই কাজগুলো কোন নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন তাকওয়াবান ব্যক্তির পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।এই সিয়ামের প্রথম ও প্রধান টার্গেট হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনে মুমিনদের মাঝে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। এদিক থেকে সৎ নৈতিক ও তাওকয়াবান জনগোষ্ঠি তৈরিতে সিয়ামের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।
২। সামাজিক কলহ দূরিকরণঃ
সিয়াম ব্যক্তির আত্মিক পরিশুদ্ধির পিছনে বিশাল ভুমিকা রাখে। একজন মানুষের মাঝে মৌলিক মানবীয় সৎ গুণাবলী সৃষ্টিতে সিয়াম যেমন ভুমিকা রাখে ঠিক তেমনি ব্যক্তির মাঝে বিরাজমান মৌলিক অসৎ গুণাবলী দুরিকরণে এই সিয়াম বিশাল ভুমিকা রাখে। আল্লাহর রাসুল সাঃ ইরশাদ করেন- আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই।" মিথ্যা বলা আর অহরহ মিথ্যাচার করা আমাদের সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালত থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরে আজ মিথ্যার জয় জয়কার। এই মিথ্যা থেকে বাঁচতে আর সমাজ জাতিকে বাঁচাতে এই সিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম।পরস্পর ঝগড়া বিবাদ ও অশ্লীলতারোধে সিয়াম অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা রাখে। ব্যক্তির মাঝে অসৎ গুণাবলী দূর এবং সৎ গুণাবলীর বিকাশ সাধনে এই সিয়ামের ভুমিকা অপরিসীম। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন, সওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সায়িম।........(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৯০৪) অন্য আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে- আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি সওম পালন করছি।.....(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুন থেকে সাতশ’ গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়।” মহান আল্লাহ্ বলেন, “আদম সন্তানের যাবতীয় ‘আমাল তার নিজের জন্য কিন্ত সিয়াম বিশেষ করে আমার জন্যই রাখা হয়। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব।” সুতরাং যখন তোমাদের কারো সওমের দিন আসে সে যেন ঐ দিন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে বিবাদ করতে চায়, সে যেন বলে, “আমি একজন সিয়াম পালনকারী”।...... (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৯৬)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ অন্যায় কথাবার্তা (গীবাত, মিথ্যা, গালিগালাজ, অপবাদ, অভিসম্পাত ইত্যাদি) ও কাজ যে লোক (রোযা থাকা অবস্থায়) ছেড়ে না দেয়, সে লোকের পানাহার ত্যাগে আল্লাহ্ তা’আলার কোন প্রয়োজন নেই।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ (১৬৮৯),
উপরোক্ত হাদিসগুলোতে সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। কোন ব্যক্তি সিয়াম পালন করলে সে কোন অবস্থায় অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে পারে না। সে মিথ্যাচর্চা ও পরনিন্দা করতে পারে না। এই ব্যাপারে ইসলাম সবসময়ই সতর্কতা সংকেত দিয়েছে। আজকে আমাদের সামাজিক বিপর্যয় অবক্ষয়ের পিছনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল অশ্লীলতা, মিথ্যাচার ও পরনিন্দা। পরস্পরের সাথে সম্পর্ক বিনষ্ট ও সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে এই নিন্দনীয় কাজগুলো। এই কাজগুলোরোধে এবং সামাজিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় সিয়াম হতে পারে উত্তম একটি মহৌষধ।
৩। সামাজিক সহানুভুতি সৃষ্টিঃ
আল্লাহর রাসুল সাঃ ইরশাদ করেন (এই মাস) সহানুভুতির মাস...(মিশকাত)। সমাজে বসবাসরত অসহায় খেটে খাওয়া অভাবি মিসকিন শ্রেণির মানুষদের প্রতি সহানুভুতির হাত বাড়াতে এই সিয়াম শিক্ষা দেয় এবং ইসলাম এই ব্যাপারে যথেষ্ট তাকিদও দিয়েছে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে অসহায় গরিব মিসকিনদের কষ্ট অনুভব করতে পারে আর এই অনুভব থেকে তাদের প্রতি ইহসানের মানসিকতা সৃষ্টি হয়।এই সময়ে দান সাদকার মানসিকতা বেড়ে যায় এবং সিয়াম পালনকারীরা প্রচুর পরিমাণ দান খয়রাতও করে থাকেন।এতে করে সমাজে বসবাসরত জনগোষ্ঠির পারস্পরিক সহানুভুতি, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয় আর সামাজিক সম্পর্ক মজবুত হয়।
৪। অভাবি জনগোষ্ঠির অভাব মোছনে কার্যকর ভুমিকাঃ
সিয়ামের সময় দান সাদকার প্রতি ব্যাপক উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছে। স্বচ্ছল মুমিনদের উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগিতে গরিব মিসকিন অসহায় জনগোষ্ঠিকে অর্ন্তভুক্তিকরণের মহান উদ্দ্যেশে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সামর্থবান মুমিনদের উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করে ঈদ আনন্দকে সার্বজননীন করে দিয়েছেন। এই সময়ের দানের ফজিলত অন্য সময়ের চেয়ে সত্তরগুণ বেশি বলে সাধারণত সামর্থবানরা তাদের উপর ফরজ যাকাতও এই সময়ে আদায় করে থাকেন। এতে করে অভাবি জনগোষ্ঠির অভাব কিছুটা হলেও দূর হয় এবং তারাও ঈদানন্দে শামিল হয়।এই সিয়াম সব সময় অভাবীদের প্রতি সহানুভুতির হাত বাড়াতে উদ্ধুদ্ধ করে এবং ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে অপরিসীম ভুমিকা রাখে। সর্বোপরি বলা যায় এই সিয়াম মুমিন ব্যক্তির আত্মিক মানোন্নয়ন, সৎ গুণাবলীর বিকাশ সাধন,মৌলিক অসৎ গুণাবলী দূরিকরণসহ ব্যক্তির মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি নৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে বিশাল ভুমিকা রাখে। আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তায়ালা আমাদের সিয়ামের সার্বিক ফজিলতদান করুক। আমীন।
অধ্যক্ষ আনোয়ার আল ফারুক, কবি ও প্রাবন্ধিক
চৌধুরী বাড়ি, দাউদপুর, ফেনী
বিষয়: আনোয়ার আল ফারুক
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: