সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১


শব-ই বরাত এঁর চিরন্তন গৌরব হারাতে বসেছে : মাহবুবুল আলম 


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২৩ ২২:০৮

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৩ ২২:১০

 

পবিত্র লাইলাতুল বরাত হচ্ছে মুসলিম জাহানের এক পবিত্র রাত, বলা হতো সৌভাগ্যের রজনী। আমাদের ছোটো বেলায় শবে ই বরাত পালন হতে দেখেছি। সকাল থেকেই নামাজের আয়োজন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, রুটি মাংস, হালুয়া, সন্ধ্যা হলে সবাই গোসল করা, রোজা রাখা, গরীবদের খাবার বিলিয়ে দেয়া, দেশজুড়ে নামাজ ও কুরআনখানি, দরুদপাঠ জিকির আযগারে এবং নানাবিধ ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে কাটিয়ে দিত সারারাত। দিনে মক্তবের হুজুরের সাথে বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে পড়েছি মিলাদ। পুরো দেশজুড়ে যেনো ছিল একটা উৎসব আমেজ। সবাই সবার বাসায় রুটি হালুয়া বিনিময় করতো। ছোটোদের তো আনন্দের সীমা ছিলো না। ছেলেরা সবাই মসজিদে চলে যেতো, মেয়েরা বাসাতেই নামাজ পড়তো। ফজর পড়ে সবাই ঘুমাতো।
কিন্তু বর্তমানে একশ্রেণির মাওলানা পবিত্র বরাতকে বেদাত বলে প্রচার করায় তাদের অনুসারী এবং অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যেও শব-ই-বরাত পালনে অনিহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরা এই রাত জেগে নফল নামাজ আদায় ও ধর্মীয় আচার না মেনে রাত জেগে ফেইসবুকিং ও চ্যাটিং করে রাত পার করে দিচ্ছে।
শবে ই বরাত কবে থেকে বেদাত হলো জানতেও পারলাম না। আমাদের দেশে নানান মতবাদে বিভক্ত মাওলানারা শব-ই-বরাতকে এখন বিদাত হিসাবে প্রচার করায় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরাও এখন নানান মতে ভাগ হয়ে গেছে।
সাধারণ মানুষ কি করবে? কোন মত কোন পথে যাবে, বা কোন পথে যাবে না এই নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেউ বলে এটা হারাম কেউ বলে না এটা হারাম না। কেউ বলে বেদাত কেউ বলে বিদাত না। তাই সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সন্দিহান।
'বারায়াত' শব্দকে যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি 'বরাত' শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।
শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে 'লাইলাতুল বারায়াত'। সার কথা হল 'বারায়াত' শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।
হিজরী শা'বান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাতে পালিত মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাত। উপমহাদেশে এই রাতকে শবে বরাত বলা হয়। ইসলামী বিশ্বাস মতে, এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুসলমান নফল ইবাদাতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করেন। অনেক অঞ্চলে, এই রাতে তাঁদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। শিয়া মুসলিমরা, এই তারিখে মুহাম্মদ আল-মাহদির জন্মদিন উদ্‌যাপন করে! তবে সালাফিরা এর বিরোধিতা করে থাকেন। -(বিএন উইকিপিডিয়া।)

প্রিয় পাঠক এ পর্যায়ে হাদিস কী বলে তা একটু জেনে নেয়া যাক- হযরত ‘আইশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স.) রাতে নামাযে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো, তাঁর হয়তো ইনতেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ‘আইশা তুমি কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কিনা? নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদেও ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই”।
‘অতঃপর তিনি বললেন, এই রাত্রিটি হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত্রি। এই রাতে আল্লাহ কালব গোত্রের ছাগলের গায়ে যে পরিমাণ পশম আছে, সেই পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। তবে আল্লাহ এ রাতে মুশরিক, বিদ্বেষপোষণকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, হাটুর নীচে পোশাক পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান এবং মাদকাসক্তের প্রতি তাকান না। অতঃপর আবরণ সরিয়ে বললেন, হে ‘আইশা! তুমি কি আমাকে এই রাত্রে ইবাদাত করার অনুমিত দিবে? আমি বললাম, অবশ্যই, আমার বাবা-মা আপনার জন্য কুরবান হোক। অতঃপর তিনি দাঁড়ালেন এবং এত লম্বা সিজদা করলেন যে, আমার ভয় হলো, তিনি মনে হয় ইনতেকাল করেছেন। তাই আমি উঠে তার শরীর স্পর্শ করলাম। তাঁর পায়ের তলদেশে হাত রাখলাম। তাঁর পা নড়ে ওঠলো। আমি খুশী হলাম। তাকে শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, (হে আল্লাহ) তোমার ক্ষমার দ্বারা তোমার শাস্তি হতে আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টির দ্বারা তোমার ক্রোধ থেকে বাঁচতে চাই। তোমার থেকেই তোমার কাছে আশ্রয় চাই। তোমার প্রশংসা করে শেষ করতে পারব না। তুমি তেমন, যেমনটি তুমি নিজেই নিজের প্রশংসা করেছ। অতঃপর যখন সকাল হলো, আমি এ দু‘আটি বললাম। রাসূল (স.) বললেন, ‘আইশা, তুমি মুখস্ত করে ফেলেছ? বললাম, হ্যাঁ। এগুলো মানুষকে জানিয়ে দাও, শিখিয়ে দাও। জিব্রাইল (আ.) আমাকে এগুলো শিখিয়েছেন এবং সিজদাতে এ দু‘আ পুনরাবৃত্তি করতে বলেছেন’।
কিন্তু মুসলমানরা এখন বিভিন্ন মাজহাবে বিভক্ত কেউ আবার এক বা একাধিক মাজহাব মানে। যখন কোন মাহজাব মানে সেটা পুরোটাই মানতে হবে। আপনি সুবিধার জন্য এক মাহজাব থেকে অর্ধেক আরেক মাহজাব থেকে অর্ধেক নিচ্ছেন! এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে বলছে সে প্রকৃত মুসলিম না। অন্য অন্যকে অবলীলায় কাফের বলছেন। সম্প্রতি এক মাজহাবের এক হুজুরের জিহ্বা কেটে নেয়া হয়েছে। সুন্নী, শিয়া, কাদেয়ানী, আহমেদীয়া, কেউ কাউকে মুসলমান মানে না, একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে। মুসলিমরাই যদি এতো ভাগে বিভক্ত হয়ে সমাজে অশান্তি ছড়ায় তাহলে অন্য ধর্মের মানুষ আমাদের ধর্ম নিয়ে উপহাস করবে এটাই তো স্বাভাবিক? এসব দেখে মনে বড় কষ্ট হয়।
আমরা এবং আমাদের পূর্ব পুরুষেরা জানতাম শব-ই-বরা হলো সৌভাগ্যের রজনী। ফার্সিতে শব মানে রাত আর বরাত মানে ভাগ্য বণ্টন বা নির্ধারণ বা সৌভাগ্য। অনেকে বলে বেড়ায় সৌদী আরবের মানুষ নাকি শব-ই- বরাত পালন করে না। বর্তমান সালাফি মতাদর্শে নাকি বছর বছর ভাগ্য নির্ধারণে বিশ্বাসী নন। আবার ইরানে শব-ই-বরাত খুব জাকজমকের সাথে পালিত হয়।
আগেই বলেছি আমরা শৈশব থেকেই রাতটি পালন করে আসছি। সারারাত ইবাদত বন্দেগি করতাম৷ সকলে গোসল করে, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় নফল নামাজ ও জিকিরে মশগুল থাকতো। সবাই জানতো ও বিশ্বাস করতো মহান আল্লাহ এই রাতে ভাগ্য নির্ধারণ করে দিবেন পরবর্তী এক বছরের জন্য রিজিক বরাদ্দ করবেন। অতীত পাপ ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে একটি সমৃদ্ধ ও সফল বছরের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো।
একথা মানুষ বিশ্বাস করতো এ'রাতেে গোসল করলে অনেক ছোয়াব। কাপড় চুইয়ে যে পানি পড়বে তার ফোটায় ফোটায় ছোয়াব! কিন্তু দিনে দিনে মুসলমানদের এই বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়েছে।
গত পরশু ৭ মার্চ দিবাগত রাতে বাংলাদেশে পালিত হয়ে গেল শব-ই-বরাত, গভীর বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম
এই পবিত্র রজনীর দৈনদশা। রাত নয়টার পরই স্তব্ধ হয়ে গেল নগর, স্তব্ধ হয়ে মসজিদের মাইক। আগে জানতাম শব-ই-বরাত পবিত্র মাহে রমজানের আগমনি বার্তা নিয়ে আসে। শব-ই-বরাতের পনের দিন পরই পবিত্র রমজান মাস। এর পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সিয়াম সাধনার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে থাকে। কিন্ত বর্তমানে এক শ্রেণির মাওলানা মোল্লা কর্তৃক পবিত্র শব-ই-বরাতকে বিদাত বা হারাম বলে প্রচার করার
কারণেই শব-ই-বরাতের এই দৈনদশার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে শব-ই-বরাত এঁর তাৎপর্য ও মহিমা হারাতে বেশি দিন লাগবে না।

 

মাহবুবুল আলম 
কবি-কথাসাহিত্যিক কলামিস্ট ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top