সিডনী শনিবার, ৫ই অক্টোবর ২০২৪, ২০শে আশ্বিন ১৪৩১


মহেন্দ্র সিং ধোনিঃ এক ক্রিকেট লিজেন্ডের অবসর


প্রকাশিত:
১৮ আগস্ট ২০২০ ২২:১৪

আপডেট:
১৮ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৪

ছবিঃ মহেন্দ্র সিং ধোনি

 

রিপোর্টঃ মু: মাহবুবুর রহমান

নিজস্ব সেই 'ক্যাপ্টেন কুল' ভঙ্গিতেই নিঃশব্দে অবসর ঘোষণা করে দিলেন ক্রিকেট লিজেন্ড মহেন্দ্র সিং ধোনি। ক্রিকেট বিশ্বে এসেছিলেন ব্যাট হাতে ঝড় তুলে। বিদায় নিলেন মুকেশের গান শুনিয়ে। অবসর নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার ইতি  টানলেন নিজেই। যে ইনস্টাগ্রামে খুব একটা পোস্ট করেন না সেই ইনস্টাতেই দিলেন খবরটা। লিখলেন, “ক্যারিয়ার জুড়ে আমাকে ভালোবাসা ও সমর্থনের জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। ১৯:২৯ (সন্ধ্যা ৭টা ২৯ মিনিট), (আজ ১৫ই আগস্ট ) থেকে আমাকে অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে গ্রহণ করুন”।  

১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস আর সেই দিনটিকেই অবসরের ঘোষণা দেয়ার জন্য বেছে নেন মিস্টার ক্যাপ্টেন কুল। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর অবসর ঘোষণার দিন স্মরনীয় হয়ে থাকুক! কিন্তু অবসর ঘোষণার ক্ষণও কি স্মরনীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন ধোনি! ১৬ বছরের গৌরবময় ক্রিকেট পরিক্রমা ১৯:২৯ (৭টা ২৯ মিনিটে) এ শেষ করে দেয়ার পিছনে কি ছিল বিশেষ কোনো কারণ? চলছে জল্পনা কল্পনা! 

কেউ বলছেন, গত বছর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা বেজে ২৯ মিনিটে রান আউট হয়েছিলেন ধোনি, আর নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেছিল ভারত। ওই ম্যাচের পর আর জাতীয় দলের নীল জার্সি গায়ে খেলেননি ধোনি। তাই হয়তো ওই সময়টাকে স্মরনীয় করে রাখতেই ধোনির এমন সিদ্ধান্ত। কেউ আবার সংখ্যাতত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে ধোনির অবসর গ্রহণের সময় ১৯২৯-কে 'অ্যাঞ্জেল নাম্বার' বলছেন। কোনো কাজ শুরু অথবা বৃত্ত সম্পন্ন হওয়া বোঝায় এই নাম্বারের মাধ্যমে। তাই হয়তো ক্যাপ্টেন ১৯২৯ নাম্বার বেছে নিয়েছেন। তবে ঠিক কী কারণে যে ধোনি ১৯:২৯ (৭টা ২৯ মিনিট) কে বেছে নিলেন, তা একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন। 

সে যাই হোক মহেন্দ্র সিং ধোনি এখন সাবেক ক্রিকেটার। তবে যদি কেউ প্রশ্ন করেন ভারতীয় ক্রিকেটের ঠিক কোথায় তাঁর অবস্থান? আমার মতো অনেক ধোনি ভক্তের উত্তর হলো ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হলেন ধোনিই। যিনি উঠে এসেছিলেন সমাজের অবহেলিত স্তর থেকে কিন্তু ভারতের ক্রিকেটকে যিনি নিয়ে গেছেন অসম উচ্চতায় তিনিই তো মহেন্দ্র সিং ধোনি। 

ভারতের হয়ে ৯০ টেস্ট, ৩৫০ ওয়ানডে ও ৯৮টি টি-টোয়েন্টি খেলা ধোনির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ২০০৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। ১৬ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এমন পাঁচটি রেকর্ড গড়েছেন ধোনি, যা ক্রিকেট ইতিহাসে আর কারও নেই।  

১। অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির তিনটি টুর্নামেন্ট (২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও ২০১৩ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) শিরোপা জয় 

২। অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৩৩২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ   

৩। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি বহু-জাতিক টুর্নামেন্ট (৬টির মধ্যে ৪টির) ফাইনালজয়ী অধিনায়ক 

৪। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি (৩৫০টি ওয়ানডের মধ্যে ৮৪টি) নট আউট থাকা ব্যাটসম্যান 

৫। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি স্টাম্পিং (১২৩টি) করা উইকেটরক্ষক 

তবে ভুলে গেলে চলবে না যে এই ক্রিকেট লিজেন্ড এর শৈশবটা ছিল অনেকটাই সাদামাটা। ১৯৮১ সালের ৭ই জুলাই ভারতের ঝাড়খন্ড অঞ্চলের রাঁচি শহরে জন্মগ্রহণ করেন এ ক্রিকেট কিংবদন্তি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালে ঝারখন্ড ক্রিকেট দলের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ঘটে ধোনির। এরপর পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ট্রেনের টিকিট চেকার ছিলেন ধোনি। তবে সে সময়ও তাঁর ছিল ক্রিকেটের প্রতি বিশেষ ঝোক। 

 

রেল বিভাগের হয়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই তরুণ ধোনি নজর কাড়েন সবার। অবশ্য ম্যাচ খেলতে গিয়ে রেলের  চাকরি হারিয়েছিলেন তিনি। আর সেটাই যেন সাপেবড় হয়ে জীবন বদলে দিল ধোনির। ২০০৪ সালের ২৩শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিপক্ষে বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে অভিষেক হয় ধোনির। আর সেখান থেকে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন মিস্টার ‘ক্যাপ্টেন কুল’। 

ধোনির নেতৃত্বে স্বপ্নের মতো সফলতা পেয়েছে ভারত। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জেতার এমন কীর্তি নেই আর কোনো ভারতীয় অধিনায়কের দখলে। ২০১০ এবং ২০১৬ এশিয়া কাপের শিরোপাও ভারতকে পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শুধু ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিই নয়, ধোনির নেতৃত্বে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠেছিল ভারত। সেই টেস্ট ক্রিকেটকে ২০১৪ সালে বিদায় বলেছিলেন ধোনি। আর ২০২০ এর ১৫ই আগস্টকে তো স্মরণীয় করে রাখলেন সব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই অবসর নেয়ার কথা জানিয়ে। 

ক্রিকেট তো ছিল ধোনির ধ্যান, জ্ঞান, আবেগ, ভালোবাসা। সেই ক্রিকেটকে বিদায় বলার সময় কেমন ছিল এ কিংবদন্তির অনুভূতি। তা নিয়ে ইনস্টাগ্রামে আবেগঘন পোস্ট করেন সাবেক ভারত অধিনায়কের স্ত্রী সাক্ষী সিং ধোনি। মহেন্দ্র সিং ধোনির অবসরের ঘোষণার পর পরই তাঁর স্ত্রী লেখেন 'তুমি যা অর্জন করেছ, তার জন্য তোমার গর্বিত হওয়া উচিত। খেলার প্রতি নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য অভিনন্দন। তুমি যা কিছু অর্জন করেছ এবং তুমি যেরকম মানুষ, সেজন্য আমি গর্ববোধ করি। আমি নিশ্চিত যে নিজের আবেগকে বিদায় জানানোর সময় নিজের চোখের জল চেপে রেখেছিলে তুমি। আগামি দিনে তোমার সুস্বাস্থ্য, সুখ এবং দুর্দান্ত জিনিসের জন্য প্রার্থনা করছি।' 

ধোনির বিদায়ের ঘোষণার পর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন ভক্ত-সমর্থক, সতীর্থ, সাবেক ক্রিকেটরসহ অনেকেই। বাংলাদেশ অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘বিদায় মহেন্দ্র সিং ধোনি। খেলার মাঠে আপনি ছিলেন নিঃসন্দেহে একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড় এবং শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে আপনি অনুপ্রাণিত করেছেন লাখো মানুষকে। আপনার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য রইলো শুভ কামনা।’ 

তবে শেষ করতে চাই বাংলাদেশের উইকেট-রক্ষক ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমের মন্তব্য দিয়ে। এক টুইট বার্তায় তিনি লেখেন ‘আপনি এই খেলার একজন লিজেন্ড। একজন দুর্দান্ত নেতা, দুর্দান্ত উইকেট-রক্ষক, এক দুর্দান্ত ফিনিশার, একজন দুর্দান্ত মানুষ ... আপনাকে স্যালুট।’ 

 

মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top