সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

দু-দণ্ড শান্তির শহর লুজার্ন: আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২০ ২২:৪৬

আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২০:৫৩

সুইজারল্যান্ডের লেক লুজার্নের তীরে দু-দণ্ড শান্তিপ্রাপ্ত ন্যানো কবি!

 

জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।’ অন্যদিকে, পৃথিবীর পথে আপনাদের ন্যানো কবিকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের লুজার্ন! সুইজারল্যান্ডের বুকের মধ্যেখানে জার্মান ভাষাভাষীদের আবাসস্থল লুজার্ন। পৃথিবীর সুন্দরতম লেক লুজার্ন, ব্যাকগ্রাউন্ডে আল্পস পর্বতমালার পিলাটাস ও রিজি পর্বত, লেকের পাড়ে ছবির মতো ঘরবাড়ি- এমন বিকেল জীবনে আর আসবে কিনা কে জানে! ট্রাভেল এজেন্সির বাস থেকে নামার আগেই ট্যুর গাইড জেজে বেশ ঝরঝরে কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, কীভাবে উপভোগ করব মনোমুগ্ধকর শহরটি। বাসভর্তি পর্যটক এলেও এখানে পাওয়া গেল নিজেদের মতো ঘোরাঘুরির জন্য কিছু সময়। মৌবীণাকে নিয়ে চটজলদি নেমে পড়লাম বাস থেকে।

প্রথমেই লুজার্ন লেক আর আল্পসের দৃশ্যপট চোখে আটকে যাওয়ায় আমরা আটকে পড়লাম! প্রকৃতির এমন মোহনীয় রূপ দুরন্ত মানুষকেও করে তোলে শান্ত। লেকের দেশ সুইজারল্যান্ডের একেক লেকের পানির রং একেক রকম। এছাড়াও সেগুলোর রূপ-রস-সৌন্দর্য‌্যও ভিন্ন। লেক লুজার্নের স্বচ্ছ পানির নিচে মনিহারি পাথরখণ্ডের ইতিউতি। লেকের পানিতে সাঁতড়ে বেড়ায় সাদা রাজহাঁস। দু-দণ্ড শান্তির জন্য এমন সৌন্দর্য যথেষ্ট; তবে সেই প্রশান্তি অস্থির হৃদয়ে অনুভবযোগ্য না। নীরবতা ও স্থিরতা নিয়ে লেকের পাড়ে কাটালাম কিছুক্ষণ। ভালোবেসে ফেললাম কল্পপুরী লুজার্ন! শহরটির সৌন্দর্য আরও গভীরভাবে উপভোগের জন্য আছে নানা ব্যবস্থা; যেমন- বোট ট্রিপ বা রোমান্টিক ডিনার। এখানেই ন্যানো কবি নীরব! পৃথিবীর পূর্ণ সৌন্দর্য শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা সম্ভব না; প্রয়োজন কাগুজে নোটের! 

লেকের উল্টোপাশে কাঠের তৈরি ঐতিহাসিক চ্যাপেল ব্রিজ। মূলত স্প্রুস গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি ব্রিজটি সুইজারল্যান্ডের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো ছাউনিওয়ালা এই কাঠের ব্রিজ চৌদ্দ শতকে নির্মিত। ব্রিজের ভেতর হাঁটার সময় ওপরে তাকালে খানিক পরপর চোখে পড়ে অসাধারণ সব পেইন্টিং! তিনকোনা কাঠের ফ্রেমে সাঁটা এসব ছবি সতের শতকে আঁকা। ছবি ছাড়াও আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করল যেটি- সম্পূর্ণ ব্রিজ রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো! ফুলশোভিত ব্রিজ থেকে শহরের ভিউ বেশ নান্দনিক। ব্রিজের ওপর ভিড়ভাট্টা থাকায় বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। একটি বিষয় আমার মনকে কাঁদাল। ব্রিজসংলগ্ন টাওয়ারটি একসময় টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের সব মানুষই পুরোপুরি মানুষ ছিল না কখনো! এমনকি রূপকথার মতো ঐন্দ্রজালিক এ শহরেও না। টর্চার সেলের সঙ্গে না জানি কত মানুষের আর্তনাদ জড়িয়ে আছে!

 

ফুলশোভিত ঐতিহাসিক চ্যাপেল ব্রিজের সামনে লেখক ও লেখকপত্নী

ব্রিজ থেকে নেমে গেলাম পাশের ওল্ড টাউনে। পুরোনো শহর হেঁটে দেখাই নিয়ম। বঙ্কিমের ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’ টাইপ হাঁটা শুরু করলাম। পনের শতকের অট্টালিকাগুলো দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। বাড়িগুলো যেমন নির্মাণশৈলীতে অনন্য, তেমনি অট্টালিকার শরীরজুড়ে পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মধ্যযুগের জীবনপ্রণালী। পথগুলো বাঁধানো পাথর দিয়ে! এ ধরনের নির্মাণশৈলীর পথকে বলা হয় ‘কবল্ড স্ট্রিট’। অন্যরকম এক আবহের মধ্যে হাঁটতে থাকলাম ঠিকই; কিন্তু সতর্ক থাকলাম যেন দিকভ্রান্ত না হই। অচিনপুরীতে পথ হারালে কপালে দুঃখ আছে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে এলাম দোকানগুলোর কাছে। পৃথিবীবিখ্যাত নানা ব্র্যান্ডের দোকান। ঘড়ি, ছুরি ও চকলেটের জন্য সুইজারল্যান্ড বিখ্যাত। হাজার-হাজার চোখধাঁধানো ঘড়ি দেখে লোভ লাগল কিন্তু দামের কারণে সেগুলো চেয়েচেয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। স্যুভেনির শপগুলোতে যদি ফ্রিজে লটকানোর ম্যাগনেট না থাকত, তাহলে বেশ সমস্যাই পোহাতে হতো। দামে সস্তা, স্মারক হিসেবে চমৎকার। তাই যেখানে যাই, ম্যাগনেটই ভরসা। কিন্তু এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে মৌবীণা পছন্দ করে বসল এক জোড়া পুতুল। সুইসকন্যা হেইডি ও তার খেলার সঙ্গী পিটার- সুইজারল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী পুতুলজোড়। মৌবীণাকে পুতুল নিতে দেখে আমিও আমার স্যুভেনির হিসেবে বিঘৎ সাইজের দুটো চকলেট কিনে ফেললাম!   

উচ্চমূল্যের কারণে ঘড়ি কিনতে পারেননি। তাই ঘড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখে হাসছেন লেখক

হাঁটা দূরত্বেই খুঁজে পেলাম ‘লায়ন মনুমেন্ট’ বা ‘লায়ন অব লুজার্ন’। এটি দেখার জন্য প্রায় চৌদ্দ লক্ষ পর্যটক প্রতিবছর লুজার্নে আসেন। সবুজ প্রকৃতি আবদ্ধ করে গড়ে তোলা পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়ল জলাশয়। জলাশয়ের অপর পাশে শুয়ে আছে পাহাড় কেটে খোদাই করা শ্বেতপাথরের মৃতপ্রায় সিংহ! সিংহটিকে দেখমাত্র হৃদয় ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। প্রখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েইন সিংহের ভাস্কর্যটি দেখে যথার্থ বলেছেন, ‘the most mournful and moving piece of stone in the world.’ ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৯২ সালের ১০ আগস্ট প্যারিসের বিপ্লবীরা ষোড়শ লুইয়ের টুইলারিস প্রাসাদ আক্রমণ করে । সেসময় প্রাসাদরক্ষার দায়িত্বে থাকা সুইস গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা সিংহবিক্রমে যুদ্ধ করেন। আট শতাধিক সুইস গার্ডদলের কেউ যুদ্ধে প্রাণ হারান; কেউ আহত হওয়ায় বন্দিদশায় মারা যান; বাকিদের পরবর্তীতে বিপ্লবীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই সুইস গার্ডবর্গের বিশ্বস্ততা, বীরত্ব ও আত্মত্যাগ স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে ‘লায়ন অব লুসার্ন’।

 

 

ভাস্কর্যের সামনের জলাশয়ের ভেতর দেখা গেল অজস্র কয়েন! দর্শণার্থীরা কয়েন ফেলে মানত করেন। ফ্রি-স্টাইলে ঘোরার সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে দেখে আমরা হাঁটা ধরলাম বাসের দিকে। রাতযাপনের জন্য বাস নিয়ে যাবে অন্য শহরের একটি হোটেল। বাস যখন ছাড়ল, তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। ফুল দিয়ে সাজানো শহর লুজার্ন বাতির আলোয় হয়ে উঠল অনিন্দ্য রহস্যময়; মনে হলো অন্যভুবনের কোনো শহর! লুজার্ন ত্যাগের সময় হৃদয় যেন বলে উঠল-

‘ভালো থেকো লুজার্ন, ভালো থেকো খুব।
অনেক বছর জীবন থেকে যখন দেবে ডুব-
দেখা হবে আবার কোনো সাঁঝে চুপেচুপে,
হয়তো সেদিন পাব অন্য মনধাঁধানো রূপে!’

 

আসিফ মেহ্‌দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top