ভারতের আগরতলার উজ্জয়ন্ত প্যালেসে হাসন রাজা : জায়েদ হাসনাইন
প্রকাশিত:
১০ অক্টোবর ২০২২ ০৪:৫০
আপডেট:
১০ অক্টোবর ২০২২ ০৪:৫৪
“ছবি উঠানো নিষেধ” দেয়ালে সাঁটানো সাদা কাগজে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে । তাই ওভাবে ছবি তোলা বা ভিডিও করা সম্ভব হয়নি। তারপরও হাসন রাজা’র ছবি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত তিন চারটি ছবি তুলে ফেললাম। ভিডিও করা হলো খানিক। এই নিষেধাজ্ঞা শুধু যে আগরতলা’র ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়ামে আছে তা কিন্তু না, পৃথিবীর অন্য সব জায়গাতেও বোধ হয় একই নিয়ম। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়াম। যা উজ্জয়ন্ত প্যালেস নামে পরিচিত। উজ্জয়ন্ত প্যালেসটি ছিলো মূলত মাণিক্য রাজবংশের প্রাসাদ। ধবধবে সাদা রাজপ্রাসাদটি এখন কালের বিবর্তনে ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়াম হিসেব ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও কয়েক বছর আগে এটি ছিলো ত্রিপুরা বিধান সভা ভবন।
ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়াম তথা উজ্জয়ন্ত প্যালেস আগরতলায় সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানের একটি। প্রাসাদটি ১৮৯৯ এবং ১৯০১ সালের মধ্যে মহারাজা রাধা কিশোর মাণিক্য দেববর্মা নির্মাণ করেন। ইউরোপীয় নির্মাণ শৈলীর আদলে নির্মিত এই প্রাসাদটি বাগান দ্বারা পরিবেষ্টিত। মূল প্রবেশদ্বার থেকে প্যালেসের দুরত্ব প্রায় হাফ কিলোমিটারের মতো। এই হাটা পথের দুপাশে রয়েছে বড় দুটি দিঘি। ৪৭ -এ দেশ ভাগের আরো দুবছর পর ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ত্রিপুরা ভারতের সাথে একীভূত হয়। এর আগ পর্যন্ত এটি মাণিক্য রাজবংশের বাড়ি ছিল। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের দিকে রাজপরিবারের কাছ থেকে ওইসময়ের পচিশ লাখ রুপীতে ত্রিপুরা সরকার কিনে নেয় এই রাজপ্রাসাদটি। তখন থেকে ২০১১ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রাসাদটি রাজ্য বিধানসভার জন্য ব্যবহৃত হয়। বিধানসভা সরিয়ে নেবার পর থেকে উজ্জয়ন্ত প্যালেস এখন ত্রিপুরার স্টেট মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের জীবনধারা, শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং উপযোগী কারুশিল্প, ভাস্কর্য, মানিক্য রাজবংশের মুদ্রা, প্রভৃতি বিভিন্ন নিদর্শন এই মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও এখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সবচেয়ে গৌরব ও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মরমী সাধক হাসন রাজা’র ছবিও রয়েছে এই জাদুঘরে। বাংলা সাহিত্যের দর্শন চেতনার কিংবদন্তীদের একজন হাসন রাজা, যার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর অবিভক্ত সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার লক্ষণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামের এক জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরীর পরিবারে হাসন রাজা জন্মগ্রহণ করেন।
উজ্জয়ন্ত প্যালেস -এর উপরতলার একটি বড় হলের দেয়ালে হাসন রাজার বাঁধাই করা ছবি শোভা পাচ্ছে স্পট লাইটে। হাসন রাজা কেন ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়ামে জায়গা করে নিয়েছে, এর যোগসূত্র জানানোর জন্য একটু ইতিহাস বলে নেয়া প্রয়োজন।
হাসন রাজার পূর্বপুরুষরা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁরা মুঘল আমলে তৎকালীন অযোধ্যা প্রদেশ থেকে বাংলায় এসে প্রথমে কিছুদিন যশোরে বসবাস করেন, পরে সিলেটে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। হাসন রাজা’র পূর্বপুরুষ রাজা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহদেব সিলেট সুনামগঞ্জ এলাকায় বড় জমিদারীর পত্তন করেন। জাতে ক্ষত্রিয় বীরেন্দ্র চন্দ্র- রাজা বাবু রায় চৌধুরী নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। বীরেন্দ্র চন্দ্র ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণ করে রাজা বাবু খান চৌধুরী নাম নেন। তাঁরই বংশধর হলেন মরমী সাধক হাসন রাজা।
রাজা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহদেব জমিদার থাকাকালীন সময় ভারতের মেঘালয় ও সিলেটের সব অঞ্চলই জয়ন্তীয়া রাজবংশের অধীনে ছিলো। এই জয়ন্তীয়া পরবর্তীতে জৈন্তা নামে বিবর্তিত হয়। ভ্রমন পিপাসুরা সিলেটে গেলে কিন্তু জৈন্তা পাহাড়কে পিছনে রেখে ছবি তুলতে ভুলেননা। জৈন্তা পাহাড়ের নীচে ছিলো জয়ন্তীয়া রাজবংশের রাজধানী। হাসন রাজার পূর্বপুরুষ রাজা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহদেব জয়ন্তীয়া রাজবংশের অধীনে জমিদারী করতেন। অভিবক্ত ভারতবর্ষের মেঘালয় ও সিলেট অঞ্চলের জয়ন্তীয়া রাজবংশ ও ত্রিপুরা অঞ্চলের মানিক্য রাজবংশের সাথে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ছিলো। এই সুবাদে মূলত উজ্জয়ন্ত প্যালেস তথা ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়ামের দেয়ালে জয়ন্তীয়া রাজবংশের ইতিহাসনামায় হাসন রাজা জায়গা করে নিয়েছে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, হাসনের বয়স যখন কেবল ১৫ বছর তখন মাত্র ৪০ দিনের ব্যবধানে তাঁর বৈমাত্রেয় বড় ভাই উবায়দুর রাজা ও পিতা আলী রাজার আকস্মিক মৃত্যু হলে জমিদারীর সমস্ত দায়ভার বালক হাসনের ওপর এসে পড়ে। অল্প বয়সে প্রভাব প্রতিপত্তি পেয়ে স্বভাবতই হাসন রাজা অপরিণত আচরণ করেন। অত্যাচারী জমিদার হিসেবেও পরবর্তীতে তাঁর কুখ্যাতি হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হাসন রাজার মনের কোণে একটু একটু করে জাগতিক ভোগ বিলাস সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ জমতে শুরু করে। তাঁর কুকার্যের জন্য সৃষ্টিকর্তা তাঁকে শাস্তি দিতে পারেন এই ভয়ে হাসন ভীত হয়ে ওঠেন। হাসন ধীরে ধীরে পার্থিব জগতের সুখ স্বাচ্ছন্দ থেকে দূরে সরে নিজের জমিদারী প্রাসাদ ত্যাগ করে সাধারণ মাটির বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। এভাবেই এক প্রভাবশালী শাষক হয়ে যান মরমী সাধক।
জমিদারী দেখাশোনার কাজে পিতা বেশিরভাগ সময় বাড়ি থেকে ৩০ মাইল দূরে বিশ্বনাথ পরগনার রামপাশা গ্রামে থাকতেন বলে হাসনের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতে মায়ের কাছেই হয়েছিল। এই মায়ের কাছেই হাসনের ধৰ্ম শিক্ষাও হয়। পরিণত বয়সে হাসনের মানসিক পরিবর্তনেও তাঁর মায়ের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। খুব বেশি প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও হাসন বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। কিন্তু তিনি বাংলা লিখতে পারতেন না। যেসব গান-সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন সবই তিনি মুখে মুখে বলতেন, আর তাঁর ভক্ত-অনুরক্তগণ সেগুলো সংরক্ষণ করতেন।
ওই সময় সিলেট, কুমিল্লা, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা এসব অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাহিত্য চর্চা, সামাজিক ও পারিবারিক সংস্কৃতি প্রায় একই ধাঁচের ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই অবিভক্ত বাংলায় হাসন রাজা’র সাহিত্য কর্ম ও সাধনা খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। শুধু বাংলাদেশ বা ত্রিপুরা নয়, হাসনের সার্বজনীন মরমী সাধনা ও সৃষ্টির কারণে, পুরো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে হাসন রাজা একটি কিংবদন্তী নাম। যদি কখনও ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলাতে যান দোকানপাট, রাস্তা-ঘাট, পার্ক সহ বিভিন্ন স্থানে শুনতে পাবেন হাসন রাজা’র রেখে যাওয়া সাধনাগুলো। দুর থেকে মাইকে বা স্পিকারে ভেসে আসবে-
“সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো,
সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল।”
জায়েদ হাসনাইন
লেখক, ট্যুরিস্ট ও ইউটিউবার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: