সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর লালাখাল; সিলেট ভ্রমণ: আনিসুল কবীর


প্রকাশিত:
২৩ এপ্রিল ২০২০ ০০:৫৯

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২০ ২১:০৭

 লালাখালে লেখক আনিসুল কবীর

 

বাংলাদেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের কাছে কক্সবাজার আর পার্বত্য চট্টগ্রামের (বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি) পরে সিলেট বিভাগ সবচেয়ে আকর্ষনীয়। চট্টগ্রামের মিরসরাই আর সীতাকুন্ড, খাগড়াছড়ির সাজেক, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক আর কাপ্তাই, বান্দরবানের রুমা আর থানচি উপজেলার বহু জায়গা, কক্সবাজার সৈকত, টেকনাফ আর সেইন্টমার্টিনে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভ্রমণ করতে যায় প্রতি বছর। তবে গত ৮-১০ বছর ধরে বৃহত্তর সিলেট বিভাগও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে অবস্থান করেছে। শ্রীমংগল, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত বা জাফলংকে ছাপিয়ে ভ্রমণপ্রিয়দের বাকেট লিষ্টে এখন বিছানাকান্দি, পান্তুমাই ঝর্ণা, রাতারগুল আর লালাখালের নাম। সুনামগঞ্জ বা মৌলভিবাজারের হাওরেও বেড়াতে যাচ্ছি অসংখ্য মানুষ। উল্লেখিত প্রতিটি জায়গাই তাদের আপন সৌন্দর্যের জন্য পর্যটক বা ভ্রমণপ্রিয়দের কাছে প্রিয়। বিগত ৫-৬ বছরে সিলেট ও শ্রীমংগলে বেশ কয়েকবার বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে। যদিও বৃহত্তর সিলেটের অনেক জায়গাই অদ্ভূত সুন্দর লেগেছে, কিন্তু পুরো সিলেট ভ্রমণের বিস্তারিত না বলে শুধুমাত্র ছোট একটা জায়গার কথাই বলতে চাই আজকে।

 

 

সিলেট জাফলং রাস্তার মাঝামাঝিতে নেমে সারী ঘাট থেকে নৌকা দিয়ে লালাখালে যাওয়ার সময় আমার মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি। একটু পরে চিন্তা করলাম এ জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর, অর্থাৎ এখানে আসার আগে আমি যা কল্পনা করেছিলাম জায়গাটা তারচেয়ে অনেক অনেক বেশী সুন্দর। বাংলাদেশে এমনিতে সুন্দর যায়গার অভাব নেই। আর ঘুরাঘুরির আগ্রহ থাকার দরুণ বাংলাদেশের বিখ্যাত যায়গাগুলোর সম্পর্কে একটি পরিস্কার ধারনা আছে আমার। দেশীয় পর্যটকদের মধ্যে সবসময় বিছানাকান্দি, রাতারগুল, লালাখাল, লাউয়াছড়া বন, মাধবপুর লেক, বাইক্কা বিল, সাত রঙা চা ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান ও বিষয় জনপ্রিয়। সেসব জায়গা নিয়ে ভ্রমণ প্রতিবেদন পত্রিকাতে পড়েছি ও ফেসবুকে দেখেছি অহরহ। জায়গাগুলো অবস্থান সিলেট ও মৌলবীবাজার জেলায়। ২৩শে জানুয়ারী ২০১৩ থেকে ২৬শে জানুয়ারী ২০১৩ চারদিন আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি এসব যায়গাগুলোতে। মজার ব্যপার হলো আমাদের তালিকাভূক্ত যায়গাগুলোর মধ্যে লালাখালকে আমি রেখেছিলাম সবচেয়ে পেছনে। কারন এ জায়গাটির অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে পরিস্কার কোন ধারনা ছিলোনা আমার। কিন্তু ফল হলো উল্টো। লালাখালে অবস্থানকালীন পুরো সময়টা জুড়েই আমার মন ছিলো মুগ্ধতায় ভরপুর। সিলেট শহর থেকে জাফলং যেতে সারী নদীর ব্রিজ। লালাখালে সারী নদী বেয়ে দেড় ঘন্টার নৌকা ভ্রমণে নদীর পানির রঙের যে বৈচিত্র দেখেছিলাম সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বন্ধুবান্ধব মিলে ১২-১৩ জনের বিরাট দল নিয়ে সারীঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করেছিলাম সেবার। ছই ওয়ালা বেশ বড় নৌকা। নৌকার ছইয়ে উপরে বসে নদীর পানির রঙের বৈচিত্র খুব ভালোভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেবার। আমাদের দলের ছোটবড় সবাই লালাখাল ভ্রমণে সারী নদীর পানির রঙ আর তলদেশ দেশে বারবার মুগ্ধ আর রোমাঞ্চিত হয়েছে। নদীর দুপাশে নিচু পাহাড় আর গাছপালা আর আদিবাসিদের নৌকা নিয়ে ছুটে চলা আমাদের চোখে যেন মুদ্ধতার কাজল জড়িয়েছে। নৌকার ছইয়ের ভিতরে আরাম করার বদলে দলের ছোটবড় সবাই নৌকার ছই ধরে বা নৌকার সামনে বা পিছনে বসে লালাখালের সৌন্দর্য উপভোগ করেছে মন ভরে। নদীর পানির রঙ দেখে আমাদের মধ্যে সে কি উত্তেজনা। নদীর পানির রঙ কেউ বললো নীল, কেউ সবুজ এবং সবশেষে সবাই নিশ্চিত হলো যে এটা নীল সবুজের মাঝামাঝি অর্থাৎ ফিরোজা রঙ। আবার কখনও কখনও পান্না সবুজ ও দেখা যাচ্ছিলো। তবে পুরোটা সময় নদীর পানি ছিলো স্বচ্ছ ও অগভীর। মেঘালয়ের সীমান্তের পাহাড়গুলোও ঝুলে থাকা মেঘের দৃশ্য এই অপূর্ব সুন্দর নদীটির রূপ আরও মোহনীয় করে রেখেছিলো সেদিন।

 

লালাখালে সারী নদীর তীরে রিভার কুইন নামে একটি আধুনিক ও মনোরম রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা লালাখাল ধরে নৌকা ভ্রমণের মাঝখানে রিভার কুইন রেস্টুরেন্টে নেমে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। এখানে নাজিমগড়ের এডভেঞ্চার টেন্ট ক্যাম্প নামে পর্যটকদের রাত্রিযাপনের কয়েকটি আধুনিক তাবু আছে। সবকিছু ঘুরে দেখে ভালো লেগেছিলো সবার, কিছুটা আফসোস ও লেগেছিলো যে এখানে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা না নিতে পেরে।

রিভার কুইন রেস্টুরেন্ট ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে আরেকটু সামনে যাওয়ার পরই দেখা যায় সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। নদী একপাশে লালাখাল চা বাগান আরেক পাশে পাহাড়ের উপরে বিজিবি ক্যাম্প। সোজা সীমান্তের দিকে অপূর্ব সুন্দর সারী নদী বয়ে চলেছে। আমরা সেবার বিজিবি (বর্ডার গার্ড অফ বাংলাদেশ) ক্যাম্পেও কিছুক্ষণ চা নাস্তা করতে নেমেছিলাম। বিজিবি ক্যাম্পের উপর থেকে নিচে তাকানোর পর মনে হয়েছে স্বপ্নের মতো সুন্দর কোন জায়গায় চলে এসেছি আমরা। সবার চোখেমুখে ছিলো মুগ্ধতা আর মুখে আহাউহু শব্দ। লালাখাল সম্পর্কে আগে কোন ধারণা না থাকাতে আমাদের মুগ্ধতার মাত্রা মনে হয় একটু বেশিই ছিলো। বেশ কিছু ছবি এখানে দিয়েছি, যেগুলো দেখলে সবার হয়তো কিছুটা ধারনা হবে।

 

সংক্ষিপ্তভাবে লালাখালের পরিচয় দিতে গেলে বলা যায় মেঘালয় পর্বত শ্রেণীর সবচেয়ে পুর্বের অংশ জৈন্তিয়া হিলসের ঠিক নীচে পাহাড়, প্রাকৃতিক বন, চা বাগান ও নদীঘেরা একটি গ্রাম লালাখাল, যা সিলেট জেলার জৈন্তিয়াপুর উপজেলায় পরেছে। জৈন্তিয়া হিলসের ভারতীয় অংশ থেকে মাইন্ডু (গুহঃফু) নদী লালাখালের সীমান্তের কাছেই সারী নদী নামে প্রবেশ করেছে এবং ভাটির দিকে সারীঘাট পেরিয়ে গোয়াইন নদীর সাথে মিশেছে। লালাখাল থেকে সারীঘাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পানির রঙ পান্না সবুজ। পানির এই অদ্ভুত রঙ সাধারনণ শীতকাল এবং অন্যান্য সময় বৃষ্টি হলেই দেখতে পাওয়া যায়। জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রবাহমান এই নদীর পানির সাথে বিভিন্ন খনিজ এবং কাদার পরিবর্তে নদীর বালুময় তলদেশের কারনেই নদীর পানির রঙ বিচিত্র ধরণের হয়ে থাকে।



কিভাবে যাওয়া যায়ঃ
সিলেট জাফলং মহাসড়কে শহর থেকে প্রায় ৪২ কিমি দূরে সারীঘাট। সারীঘাট থেকে সাধারনতঃ নৌকা নিয়ে পর্যটকরা লালাখাল যান। স্থানীয় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একঘন্টা পনেরো মিনিটের মতো সময় লাগে সারী নদীর উৎসমুখ পর্যন্ত যেতে। নদীর পানির পান্না সবুজ রঙ আর দুইপাশের পাহাড় সারির ছায়া- পর্যটকদের মুগ্ধ করে। উৎসমুখের কাছাকাছিই রয়েছে লালাখাল চা বাগান।সিলেট শহর থেকে লালাখাল পর্যন্ত ৬-৮ জন বহনকারী মাইক্রো ভাড়া হতে পারে ৩৫০০ - ৪০০০ টাকার মধ্যে। ৯-১২ জন বহনকারী মাইক্রো ভাড়া হতে পারে ৪৫০০ - ৫,৫০০ টাকার মধ্যে। শুক্রবার হলে আরেকটু বেশী ও হতে পারে। সারীঘাট থেকে স্থানীয় নৌকা নিয়ে লালাখাল যেতে খরচ পড়বে ১০০০-১৫০০ টাকার মতো খরচ পড়ে। আর নাজিমগড় বোট স্টেশনের বিশেষায়িত নৌকাগুলোর ভাড়া ২০০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত। গাড়ী নিয়ে লালাখাল চলে গেলে রিভারকুইন রেস্টুরেন্ট থেকে আধাঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া পড়বে ৫০০ টাকা। দুপুরের খাবার প্রতিজন ৪০০-৫০০ টাকা।

 

লেখক: আনিসুল কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top