সংক্ষুব্ধ নগরী: উম কাইস : জাফিরুল হোসাইন
প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২১ ২০:২৪
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০২
বড় বেশী বিপজ্জনক সৌন্দর্য। পাহাড় থেকে ঢাল বেয়ে পশ্চিমে নেমে গেলেই ইসরায়েল, আর উত্তরের মাত্র একশ মিটার ঢালেই পৃথিবীর সবচেয়ে সংঘাতময় ভূখন্ড, গোলান হাইটস, বাংলায় গোলান মালভূমি। একটু পেছনে গেলেই প্যালেস্টাইন ভূখন্ড, ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর। উম কাইস (Umm Qais)। জর্ডানের উত্তর পশ্চিমের শেষ সীমান্ত। গ্রীকদের তৈরী পরিত্যক্ত শহর গাদারা (Gadara), বর্তমান নাম উম কাইস।
পড়ন্ত বিকেল, গোধূলি লগ্ন, দূরের উপত্যকা, অনুচ্চ গিরিশৃঙ্গ, বিস্তীর্ণ গোলান মালভূমিতে ধূসর সবুজের অবগাহন, পাহাড়ের আড়ালে অন্ধকারের নিমজ্জন, আর অস্পষ্ট দৃশ্যমান টাইবেরিয়াস হ্রদ। শুধু এই বিকেলটা দেখতেই এখানে আসা। খৃষ্টের জন্মের প্রায় তিন শত বছর পূর্বে গ্রীকরা এমন একটা নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়েছিল নগর পত্তনের জন্য। তিন দিকে খাড়া পাহাড়ের কিনারা। শুধু পূর্ব দিক থেকে সরু পাহাড়ী পথ যার দুদিকে গভীর খাঁজ, সেটা পেরিয়ে এখানে আসতে হয়। গ্রীকদের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ কিংবা পরবর্তীতে রোমানদের তৈরী ভগ্নপ্রায় নগর দেখতে এখানে আসা নয়। এই বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করতেই আসা।
গোলান হাইটস ইসরাইল অধিকৃত সিরিয়ান ভূখন্ড। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল এটা দখল করে নেয়। এটা খুব বড় কোন মালভূমি নয়, আয়তনে প্রায় বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার সমান, আঠার’শ স্কয়ার কিলোমিটারের ভূখন্ড, খুব চওড়া যেখানে সেখানে ৪৩ কিলোমিটার, আর লম্বা সর্বোচ্চ লম্বা ৭১ কিলোমিটার। তবে এর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তর প্রান্তে হেরমন পর্বত, যেটা সিরিয়া, ইসরায়েল, লেবানন আর জর্ডানের অন্যতম পানির উৎস। জর্ডান নদী এখান থেকে পানি নিয়ে কিয়দংশ টাইবেরিয়াস হ্রদে ঢেলে দেয়, বাকীটা বয়ে নিয়ে যায় সুদূর ডেড সী পর্যন্ত। এখানকার সর্বোচ্চ চূড়ায় বসে অনায়াসে সিরিয়ার দামেস্ক আর ইসরায়েলের হাইফা শহরের উপর নজর রাখা যায়। এখানকার উর্বর মাটিতে প্রচুর আঙুর আপেল আর সবজির ফলন হয়, মাটির নীচে প্রচুর গ্যাস আর তেল মজুত আছে। আর আছে হাজার বিশেক সাহসী দ্রুজ সিরিয়ান।
এই রোদমাখা বিকেলে, সোনাঝরা রোদে, গোলান মালভূমির পর্বতমালা, পিছনের নীল আকাশ, নিঃশব্দ নীরবতা, ইসরাইলি সৈন্যদের স্নাইপার আক্রমনের ভয়, অবারিত ডানামেলা চিল, আর সব কিছু দেখতে চাওয়ার উদ্দীপিত কৌতুহল, এসব নিয়েই বসে আছি। পেছনের যা কিছু, যা কিছু যজ্ঞ, তা ঐ পাহাড়ের আড়ালে, আমার দৃষ্টির সীমার বাইরে, প্রকৃতির শোভা আর পাহাড়রাজীর ব্যাপকতা, বিশালতায় ঢেকে দেওয়া সব নির্মমতা আর নৃশংসতা।
পেছনে বামে, কিছুটা পশ্চিমে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দূরে, নীল টাইবেরীয়াস হ্রদ, সি এব গ্যালিলি নামে পরিচিত। মনে হয় একটু ঘাড় উঁচিয়ে দেখি, নয়তোবা ঐ চিলের পাখায় ভর করে, হ্রদের পাড়ে, যেখানে গোলান পাহাড়ের শুরু, খাড়া গিরিশৃঙ্গ, অগভীর বনাঞ্চল, জেলেদের ডাঙায় তোলা নৌকার বহর, উন্মিলিত সৌন্দর্যের আহ্বান, সেখানটায় ঘুরে আসি। এ এক অন্যরকম অনুভূতি, সব কিছু দেখবার উদগ্র বাসনা, আকাঙ্খা, মনে হয় হাজার বছরের না দেখা সব সৌন্দর্য, আড়াল করা সভ্যতা।
টাইবেরীয়াস হ্রদ নিয়ে অনেক গল্প আছে। এটা সম্ভবত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে নীচু হ্রদ, ছোটখাট একটা মিঠা পানির সাগর, প্রায় সর্বোচ্চ ২১ কিলোমিটার লম্বা আর ১৩ কিলোমিটার চওড়া। যীশুখৃষ্ট এই হ্রদের পাড় থেকেই প্রথম চার জন জেলেকে শিষ্য হিসেবে গ্রহন করেছিলেন, দজ্জালের আবির্ভাব নাকি এখান থেকেই হবে। এই হ্রদ থেকেই ইসরায়েল তার মিঠা পানির চাহিদা বহুলাংশে পূরণ করে।
আগের দিন আকাবা গিয়েছিলাম, আম্মান থেকে দক্ষিণে, একেবারে দক্ষিণ পশ্চিমের শেষ প্রান্তে। উত্তাল আকাবা উপসাগরের তীরে, বৃক্ষ পল্লবহীন ধূসর পাথুরে পাহাড় ঘেরা আকাবা বন্দর। এক দিকে সৌদি আরব, সামনে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, তার ডানে ইসরায়েল। বিবাদমান প্রান্তরে শান্তির বেলাভূমি, অত্যাধুনিক আবাসিক রিসোর্ট কমপ্লেক্স, অবকাশ কেন্দ্র, হাজার ট্যুরিস্টের সমাবেশ।
সাহাবী ট্রি যা ইংরেজীতে Blessing Tree, তা দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কিছুটা সাহসী পদক্ষেপ ছিলো। বিস্তীর্ণ ছড়ানো ছিটানো কালো কালো পাথরের মরু প্রান্তর। দুবাই সৌদি আরবের মত বালিয়াড়ি মনে হয়নি। বড়বেশী রুক্ষ, পাহাড়ী। শত মাইলের মধ্যে কোন বসতি, গাছপালা নেই মনে হয়। জর্ডানের উত্তর পূর্ব প্রান্তে, এক পাশে সিরিয়া, অপর পাশে ইরাক আর পিছনে সৌদি আরব। কিছুটা ভয় করছিলো। তবে বেশী ভয় করছিলো মিশরী পাগলা ড্রাইভার হাসানের গাড়ীতে চড়ে, ১৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ী চালায়, কমাতে অনুরোধ করলে ১৬০ কিলোমিটার গতি। মুখে হাসি নেই, কথা বলেনা, অবশ্য ইংরেজী বলতে পারেনা, শুধু রাস্তার দিকেই চেয়ে থাকে।
আম্মান থেকে কমপক্ষে ১৭০ কিলোমিটার দূরে। টুকু ভাইয়ের জর্ডানী ড্রাইভার আমজাদ অসুস্থ থাকায় ড্রাইভার হাসানের সাথেই যেতে হলো। পথটা ওর ভালোই চেনা, মনে হলো অনেকবার এসেছে। এখানে খুব একটা ট্যুরিস্ট আসেনা জানলাম। একেবারে বিরাণ মরুপ্রান্তর। সাহাবী গাছের আশে পাশে কোন বড় গাছ নেই এটা সত্যি, তবে জায়গাটা অত বেশী শুষ্ক মনে হয়নি, ছোট ছোট অনেক আগাছার বন দেখেছি।
প্রাক ইসলামিক যুগে দামেস্ক অনেক উন্নত শহর ছিলো। সেই সময় আরবের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে, উটের কাফেলার সাথে, ব্যবসা বানিজ্যের প্রয়োজনে সবাই দামেস্ক যেতো। সৌদি আরব থেকে উটের কাফেলা যে পথে দামেস্ক যেতো, সেটা এই সাহাবী গাছের কাছের কোন পথ, পথ যাত্রীরা এখানেই বিশ্রাম নিতেন। কথিত আছে যে, মহানবী তার নয় বছর বয়সে, চাচা আবু তালিবের সাথে এই পথে একবার দামেস্ক গিয়েছিলেন এবং এই গাছের নীচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
বিষয়: জাফিরুল হোসাইন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: