সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চ নারীর সুন্দরবন দর্শন : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২৪ ১৮:২৪

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:৪৯

 

যে কোন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। সঙ্গী হিসেবে যদি সমমনা বন্ধু পাওয়া যায়, তাহলে তো সেই ভ্রমণ ষোলআনা পূর্ণতা পায়। বলছিলাম এবারের সুন্দরবন ভ্রমণের কথা। আমাদের ট্যুরটা ছিল দুই রাত তিন দিনের। বিশ তারিখ খুব ভোরে আমরা পাঁচ লেডি রীতিমত শাড়ি পরে বেরিয়ে পড়ি সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। সূর্য তখনও জাগেনি। আমাদের দৃষ্টি ছুঁয়ে জাগতে থাকা সকালের হাত ধরেই চলে আমাদের পথচলা।

খুব দ্রুতই আমরা পদ্মা সেতু পার হয়ে যাত্রা বিরতিতে থামি। 'শাম্পান 'রেস্টুরেন্টের মজাদার নাস্তা শেষ করে আবারও যাত্রা শুরু। মসৃণ রাস্তার দুপাশের মনোরম প্রকৃতি দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে যাই মংলা বন্দর সংলগ্ন ' লাউডোব ফেরীঘাটে '। অবশ্য রাস্তার থেমেছি একবার চা খেতে। টং দোকানের' রং চা ' আমাদের পথের ক্লান্তিটুকু নিমিষেই দূর করে দেয়। বহুদিন পর এমন রং চা খেলাম। গাঢ় লিকার। টুংটাং চায়ের কাপের শব্দের সাথে আমাদের কথা চলে দোকানীর সাথে। বলে কাঁচাপাতার লিকার দিয়ে তৈরি এই চা বেশ পছন্দের সকলের কাছে।

ফেরী ঘাট পেরিয়ে আমরা পা রাখি সুন্দরবন এলাকায়। মাঠ ঘাট লোকালয় পেরিয়ে গাড়ি চলছে। আমার কাছে পরিচিত হলেও বাকিদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। ওদের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখি আমি। ওদের দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসু। এরকম অজপাড়াগা, হতদরিদ্র একটা এলাকা। অভাবের ছাপ প্রকট। এমন এলাকায় কি হতে পারে! ওদের সব জিজ্ঞাসার অবসান ঘটে। আমরা পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্যে।
'ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন রিসোর্ট '।
সুন্দরবনের একদম কাছ ঘেঁষে তৈরি এমন রিসোর্ট আর নেই অদ্য অঞ্চলে। তবে ২/৩ টা ইকো রিসোর্ট আছে। তৈরি ও হচ্ছে বেশ কটা।আমার মতে সেগুলো ইয়াং দের জন্য। তবে সববয়সী পর্যটকদের জন্য 'ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন রিসোর্টের' বিকল্প আর একটিও নেই। গাড়ি রিসোর্টের নান্দনিক ( বাঁশ বেত দিয়ে তৈরি) গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে একেবারে ভেতরে। গাড়ি থেকে নেমেই শুরু হয় আমাদের হৈচৈ। সকলের একই কথা,এতো সুন্দর! এতো সুন্দর! যেদিকেই চোখ ফেলি সর্বত্রই সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। বড্ড মনকাড়া সবকিছু। ঢাকা থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় আমরা পৌঁছে গেছি রিসোর্টে।

ব্যাগপত্র হোটেলের স্টাফের হাতে দিয়ে আমরা মেতে উঠি ফটোসেশান এ। সবুজে সবুজে সাজানো আঙিনায় যেন মন দুলে ওঠে। আমরা হোটেলের আঙিনা ছেড়ে চলে আসি রাস্তার ওপর পাশের 'ইকো জোনে '।
আঁকানো বাঁকানো কাঠের সাঁকো দিয়ে হাঁটতে থাকি। ভাটার সময়। তাই সাথের ভদ্রা নদীতে পানি কম। ওপারে সুন্দরবন। আমরা প্রকৃতির এতো আয়োজন মন ভরে দেখি। আর স্মৃতি বন্দী করে রাখি ফোনের গ্যালারীতে।

বনের দিকে বসানো দুটো কাঠের দোলনায় দুলতে থাকা দুবান্ধবীর সেকি উচ্ছ্বাস! কেউ আধা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে ছবির পোজ দিচ্ছে। কেউ বা সিড়ি ভেঙে নেমে যাচ্ছে একদম নদীর কাছে। কেউবা কেওড়া গাছের ডাল ধরে ছবির পোজে ব্যাস্ত। মনে মনে ভাবি, এইতো জীবন! চলতি জীবনে কুড়িয়ে পাওয়া আনন্দটুকু আঁজলা ভরে তুলে রাখি! ভুলে যাই আমরা ইট-পাথরের শহরে জীবনের কথা।

সবাই ফিরে আসি রিসোর্টের রুমে। সুসজ্জিত হোটেল রুম। চেঞ্জ হয়ে নীচের রেস্টুরেন্টে চলে আসি। টেবিলে সাজানো খাবারের আয়োজন দেখে মনে পড়লো, আমরা অনেক ক্ষুধার্ত। রিসোর্টের ক্ষেত থেকে তুলে আনা টাটকা লাউয়ের সব্জি,ডাল, পুকুর থেকে ধরা টাটকা তেলাপিয়া মাছ ভাজি, বড় বড় গলদা চিংড়ি ভুনা আর বাজার থেকে কিনে আনা দেশি মুরগীর ঝোল। কি পরিমাণ খাবার খেলাম, তা আর নাই বা বলি। ঘরোয়া আয়োজনে রান্নার স্বাদই আলাদা। পাঁচ টা কফির কাপ হাতে নিয়ে সামনের পুকুরের ওপর তৈরি টি হাউজে গিয়ে বসি সকলে। কড়া দুপুরের আলস্য কেটে যায় আমাদের। আমরা সন্মুখের বিস্তৃত প্রান্তরে চোখ রাখি।

কফির পেয়ালা শেষ হয়। মৌনতা ভাঙে আমাদের। রুমে ফিরে ঝটপট তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসি।এখানেও চলে ছবি তোলার হিড়িক। আসলেই, রিসোর্টের বিশাল আঙিনাজুড়ে ছবি তোলার এতো এতো আয়োজন!
তাড়া লাগাই আমি। বিকেলের সোনালী রোদ ম্লান হতে দেয়া যাবে না। সবাই গাড়িতে উঠে পড়ি। উদ্দেশ্য, গোলপাতার বনের ধারে যাওয়া।

গাজী ফিশের সীমানা আর আমাদের রিসোর্টের সীমানার মাঝের রাস্তাটা দেখার মতো।দীর্ঘ পথ।দুপাশে গাছের সারি। এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত যেতে যেতে মনে হবে, জীবনানন্দের সেই কবিতা " হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পরে "। এপথের শেষ মাথায় একপাশে ঘন জঙ্গল।অপর পাশে বিস্তৃত খোলা প্রান্তর। আমরা নেমে পড়ি এই প্রান্তে।
এ যেন জলের কাব্য। 'বায়ান্ন বিঘা'। পর পর সাজানো জলাধার। ফসলের মাঠ। দূরের বনের মাঝে সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে। ক্যামেরা বন্দী করে আবারও রওনা হই আমরা। রাস্তার একপাশে বসতি অপর পাশে সারি বেঁধে গোলপাতার ঘন জঙ্গল। লাগোয়া নদী। ওপারে গভীর বন। আমরা গোলপাতার জঙ্গলে ঢু মারি। সাঝ নামতে তখনো একটু বাকি। জঙ্গলঘেঁসা গোলবন টা খুব বেশি নিরাপদ নাও হতে পারে।
আমরা নিরাপদ দুরত্ব থেকে দেখতি থাকি,অস্ত যাওয়া লাল সূর্যটাকে সবুজ বনের মাঝে হারিয়ে যেতে।
'বনবাস রিসোর্ট '। নাম শুনেছি। দেখার ইচ্ছে ছিল। সাথে থাকা রিসোর্টের ছেলেটা ভেতরে যেয়ে আমাদের পরিচয় দিয়ে, ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছেটা জানিয়ে আসে।
ওরা সাদরে আমন্ত্রণ জানালো আমাদের। ইকো রিসোর্ট এটা। একেবারে নদীর সাথে লাগোয়া। বলা চলে নদীর ওপরেই তৈরি। বেশ নান্দনিক ভাবে তৈরি। বাস, কাঠের সেতু, গোলপাতার ফাঁকে ফাঁকে কটেজ। বেশ মনকাড়া। আমরা ছবি তুলি এখানে ওখানে। ডাইনিং পেরিয়ে সামনে যেতেই মন ভালো হয়ে যায় সবার।
সন্ধ্যা নামি নামি করছে। ওপারে বনের মাঝে নিস্তব্ধতাও ছুঁই ছুঁই করছে। ইকো কটেজের অন্য আমেজ আছে।
আমার মনে হলো, এ ধরনের ইকো কটেজ গুলো ইয়াং জেনারেশনদের জন্যই যেন তৈরি। বনঘেঁষা কটেজের দড়ির দোলনায় দুলতে দুলতে রাত পেরোনোর সাহস আমাদের নেই। কেউ দোলনায় দুলছে নদীর বুকে, কেউ কাঠের তৈরি মনোরম নানা জায়গায় ছবি তুলছে। আমি বনের সান্ধ্য সৌন্দর্য উপভোগ করি এখান থেকে।
চমৎকার স্বাদের কফি খেয়ে চলে আসি 'বনবাস ' থেকে। ততক্ষণে রাত নেমে আসে। এবার আমরা লোকালয়, হাট বাজার দেখতে বের হয়। আমার কাছে মনে হয়, কোন একটা জায়গায় গেলে সেখানকার মানুষ, তাদের জীবনযাপনের চিত্র, তথা সবকিছুই জানতে হয়, দেখতে হয়।
সুন্দরবনের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রা খুব একটা সহজ নয়। বিরূপ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। যদিও আধুনিক জীবনের অনেক অনুষঙ্গ এখন চলে আসছে এখানে। ভাঙতে বসা বাজার থেকে পেঁয়াজু কিনি। পাঁকা কলা কেজিতে বিক্রি হয় শুনে আমরা মজা পাই খুব। হালি নয়, ডজন নয় একেবারে কেজিতে। আমরা এক কেজি কলা কিনি। একেবারে খাঁটি কলা। অনেক সুস্বাদু।
বেশ রাত করেই আমরা ফিরি। গাড়ি ছিল বলেই রাতের এই ঘোরাঘুরি সম্ভব ছিল। তা নাহলে সম্ভব হতো না। একেবারে জঙ্গল ঘেঁষে এইসব লোকালয়। সাবধানতা বজায় রেখেই তো চলতে হবে!
রাতের খাওয়ার পর গল্প আড্ডা শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিই। কোলাহলহীন নিঝুম চারপাশ।বিষাদ নয়, অন্য রকম এক আবেশে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি সবাই।

২১ শে ফেব্রুয়ারি। ইচ্ছে ছিল সাদা কালো শাড়ি পরে আমরা প্রভাতফেরীতে অংশ নিব,গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে। ওদের কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইবো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি "। কিন্তু আমাদের সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। আমাদের গন্তব্য ছিল 'করমজলে ' যাওয়া। জোয়ার ভাটার কারণে যে কোন সময় যাওয়া সম্ভব হয় না সেখানে। তাই প্রভাত ফেরীতে যাওয়া হয় না আমাদের।
আমরা রওনা হয়ে পড়ি করমজল দর্শনে। পথে দেখি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারি বেঁধে নানা শ্লোগান দিতে দিতে ফিরছে প্রভাতফেরী থেকে। স্কুলের শিক্ষকবৃন্দের সাথে সুশৃঙ্খলভাবে। বুকের ভেতর একটা ভালোলাগা তৈরি হয় এই সমস্ত হতদরিদ্র শিশুদের জন্য। ওরাও জানুক আমাদের বাংলা ভাষার আদি অন্ত কথা। ওদের বুকেও জেগে থাকুক ভাষার প্রতি তথা দেশের প্রতি ভালোবাসা।

আমাদের জন্য অপেক্ষা করা লাল হলুদ রঙা ঝালরে সাজানো বোটে চেপে বসি। বোট আমাদের নিয়ে চলতে থাকে। আমরা দেখি নদীর দুপারের সৌন্দর্য। যেতে যেতে বেশ কটা ইকো রিসোর্ট দেখি। দু/তিনটা চালু হওয়া। আর বেশ কটা বাঁশ কাঠ দিয়ে তৈরি চলছে।

নোনাপানির এই এলাকায় সুপেয় পানির বডড অভাব। একটা ছোট খেয়া নৌকায় দুজন কর্মঠ মহিলাকে দেখি। বৈঠা হাতে স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে নৌকা বাইছে। নৌকা ভরা কলসি।মাঝি জানালো দূরের কোন জায়গা থেকে ওরা খাবার পানি নিয়ে আসছে। কখনো গোলপাতার বন। কখনো নদী পারের বসতি। আর ওপারের বন দেখতে দেখতে চলি আমরা। সে এক মনোরম দৃশ্য। কোথায় যেন হারিয়ে যাই আমরা। দুঘন্টার এই নৌ যাত্রায় ওয়াইল্ড তেমন কোন কিছুর দেখা পাইনি, শুধু বনের ধারে একটা কুমির দেখলাম আয়েশি ভঙ্গিতে রোদ মাখছে নদীর পাড়ে।
ছোট নদী আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। একসময় তা বিশাল নদীতে পরিনত হয়। আমরা পশুর নদী পার হয়ে পৌঁছে যাই 'করমজলে '। লোকে লোকারণ্য। ছুটির দিন বলে তিল ধারণের জায়গা নাই।নানা সাজে, নানা শ্রেনীর লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্বের এই পৃথিবী বিখ্যাত' ম্যনগ্রোভ বনের নানা কিছু। বাঘের নখ, পায়ের ছাপ। ক্ষুধার্ত হরিণের ঘাস লতাপাতা খাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি।দর্শনার্থীদের হাত থেকে লতাপাতা খাওয়ার দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগলো।
নানা বয়সী কুমির দেখা শেষে, বনের মধ্যে কাঠের তৈরি রাস্তা ধরে গেলাম অনেকটা পথ।
মাঝ পথ থেকে ফিরে আসি আমরা আমাদের বোটের কাছে। আগের মতোই বনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে রিসোর্টে ফিরে আসি। বিকেলে রিসোর্টের ইকো পার্কে বসেই দেখি, লাল সূর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। চারপাশে লাল আভাটুকু ছড়িয়ে আছে ওপারের বনের মাঝে।

রিসোর্ট থেকে একটু দূরেই ত্রিমোহনী ( তিন নদীর মিলনস্থল)। ওখানে থেকে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্যটা নাকি অনেক বেশি সুন্দর। সেদিনের সূর্য তো ডুবেই গেছে। আমরা তবুও রওনা দিই শুধু সেই নয়নাভিরাম জায়গাটা দেখবো বলে।কিন্তু পথ ভুলে অন্য পথে চলে যাই আমরা। তাছাড়া রাত নামার কাছাকাছি হওয়াতে আর সেই পথে যাওয়াটা সমীচীন মনে হয় না আমাদের। একটু ঘুরেফিরে আমরা ফিরে আসি। ইচ্ছে আছে পরের বারে ত্রিমোহনীর পাড়ে সূর্য অস্ত যাওয়া দেখার। রাতে বারবিকিউ এর ব্যবস্থা ছিল ।
রিসোর্টে ঘুরতে আসা নানা বয়সী মানুষ এখানে ওখানে বসে গল্প আড্ডায় মত্ত। শিশুদের দৌড়াদৌড়ি। ভালোই লাগলো দেখে। আসলে এই রিসোর্টের পরিবেশটাইতো এমন। দু'চার দিন নিশ্চিতে কাটিয়ে দেয়া যায় নির্ভাবনায়।

২২ শে ফেব্রুয়ারী আমাদের ফিরে আসবার দিন। খুব ভোরে আমি একাই বেড়িয়ে পড়ি বাইরে। ভোরের শান্ত পরিবেশের মধ্যে রয়েছে শান্তির সুবাতাস। রিসোর্ট থেকে বের হয়ে এদিক ওদিকে হাঁটা শেষ করে বন সংলগ্ন ইকো পার্কে চলে আসি।সবে বন জাগতে শুরু করেছে। দেখলাম বেশ ক'জন বসে আছে নিঃশব্দে।উপভোগ করছে হাত ছুঁয়ে থাকা সুন্দরবনের সৌন্দর্য।
আগের রাতে পরিচয় হওয়া মা মেয়েকে দেখলাম দু'টো দোলনায় দোল খাচ্ছে। ভোরের মায়ায় দৃশ্যটা অসাধারণ ছিল! আমি খুঁজে পাই আমার শৈশব। খুঁজে পাই আমার পড়ন্ত বেলার আনন্দ। আহা! জীবন আসলেই সুন্দর। এই মুহূর্তে বেঁচে থাকার সুখ হয়তো এটাই!

রিসোর্টে ফিরে আসি এই সুখটুকু বুকে নিয়ে। প্রকৃতির এতো মায়া ফেলে আবারও ফিরে যেতে হবে শহুরে জীবনে। সাদা কালো শাড়ি পরে সবাই একেবারে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসি।নাস্তা খেয়ে আবারও চলে ছবি তোলার হিড়িক। শেষই হয়না যেনো। আসলে চমৎকার এই অনুভূতিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছি সবাই।
ভাইয়ের রিসোর্ট। সবই খাঁটি জিনিস। যা ঢাকা শহরে মেলা ভার। খাঁটি মধু নিলাম। সঙ্গের দুজন রিসোর্টের পুকুর থেকে ধরা টাটকা গলদা চিংড়ি, সুস্বাদু তেলাপিয়া মাছ কিনে নেয়। তেঁতুলগাছ থেকে পাকা তেতুল, নারকেল,টক মিষ্টি বড়ই।সবচেয়ে মজার ছিল পুকুর পাড়ের লাউ খেতে যেয়ে লাউ তুলে আনা। আসলে ছোট ছোট এই আনন্দটুকু আমরা নিয়ে আসি নিজেদের জন্য।
আমাদের এই আনন্দযজ্ঞ দেখে এক ইয়াং দম্পতি ভীষণ আনন্দ নিয়ে দেখে। ওরা অবাক হয়! বলে এই বয়সেও আপনাদের এই চঞ্চলতা! আমরা কি পারবো এমন থাকতে! আমরা বলি, জীবন সব বয়সেই সুন্দর এবং আনন্দের। যদি আমরা সেটা ধরে রাখতে জানি।

বিষাদ মাখা মন নিয়ে প্রিয় এই জায়গাটা ছেড়ে আমরা ফেরার পথ ধরি।

গাড়ি চলছে গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে। পথের দুপাশে খোলা প্রান্তর। নতুন ফসলের জন্য ক্ষেত প্রস্তুত চলছে।
রাস্তার দু'ধারে সজনে গাছের সাদা সাদা ফুলগুলো হঠাৎ করে বিদেশি চেরিফুল ভেবে নেবে যে কেউ। আমরা সেই সৌন্দর্য শুধু চোখ দিয়ে দেখেই শান্তি পাবো এমনটা কি হয়? আমরা নেমে পড়ি। কাছ থেকে দেখি আমাদের দেশিয় সাজনা চেরির সৌন্দর্য। চলতি পথে বাঁশ ঝাড়, স্বর্ণলতার ঝোপ, শিমূল গাছের নীচে পড়ে থাকা লাল লাল ফুল আমরা তুলে নিই হাতে। মাটির কাছাকাছি জীবনের সুর খুঁজে পাই আমরা। আমাদের জন্য অপেক্ষারত ফেরীতে পার হয়ে আসি এপারে। ওপারে পড়ে থাকে আমাদের গত তিনদিনের আনন্দে মাখামাখি সুখ। মংলার রাস্তা দিয়ে আসার সময় চোখ যায় রাস্তার পাশের স্কুল সংলগ্ন সূর্যমুখি ফুলের বাগানে। সে এক অন্য রকম আনন্দ।
হলুদ ফুলের মাঝে নীল নীল ভোমরার দল উড়ে উড়ে মধু খাচ্ছে। স্কুলের ভেতরে শহীদ মিনারের বেদি ফুলে ফুলে ভরে আছে দেখলাম। আমরা শ্রদ্ধা ভরে স্বরণ করি ভাষাসৈনিকদের। আমরা চলেছি আনন্দের মাখামাখি সময়গুলোকে মনে করে। চলেছি আমাদের গন্ডিবদ্ধ শহুরে জীবনের পানে। হয়তো একটু ক্লান্তি, একটু বিষন্নতা ছিল সবার মাঝে। সবকিছু ছাপিয়ে ছিল আমাদের পাঁচ বান্ধবীর একসাথে কাটানো শ্রেষ্ঠ সময়গুলো।

 

শাহানারা পারভীন শিখা 
কবি এবং লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top