সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

মেজর (অবঃ) রাশেদ সিনহার হত্যাকান্ডে স্তম্ভিত বাংলাদেশ : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২০ ২১:৩১

আপডেট:
১২ আগস্ট ২০২০ ২২:১৩

মেজর অবঃ রাশেদ সিনহা খান

 

মেজর অবঃ রাশেদ সিনহা খান, বাংলাদেশের এক স্বপ্নবাজ তরুণ। যার চোখে ছিল বিশ্বভ্রমনের হাতছানি। মনে ছিল একজন ইউটিউবার হয়ে নিজের দেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার এক অদম্য বাসনা। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের শুরুতেই পুলিশ এর নির্মম আক্রোশের শিকার হয়ে তাকে চলে যেতে হলো। এমন সম্ভবনাময় এক তরুণের লোমহর্ষক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের সকল শ্রেণির পেশার মানুষ আজ স্তম্ভিত! রাষ্টীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অসৎ, দুর্নীতিবাজ সদস্যের এমন নেক্কারজনক ঘৃণিত কাজে সমগ্র বাহিনী আজ আস্থার সংকটে; আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই পুলিশকে ভাল চোখে দেখে না, সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তাদের আরও একবার সংকটে ফেললো।

৩১ আগস্ট ২০২০ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে কক্সবাজার আসার পথে টেকনাফ থানার বাহেরছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর মেজর (অবঃ) রাশেদ সিনহা।
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী রাত নয়টার দিকে পুলিশের নির্দেশ মেনে দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে পর পর তিনটি গুলি করা হয় তাকে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় প্রায় ৪৫ মিনিট রাস্তায় পড়ে কাতরাতে থাকে এবং দশটার দিকে একটি মিনি পিকআপে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর আগেই মেজর সিনহা মারা যান।

মেজর (অবঃ) রাশেদ সিনহাকে হত্যার জন্য পুলিশের ত্রিমুখী হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে ১০ আগস্ট ২০২০ ‘জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এ সাইদুল রহমান রিমনের এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন ” ইয়াবা তদন্তে প্রদীপের সঙ্গে কথা বলাই কাল হলো সিনহার” ‘কয়েক মিনিটের নির্দেশনায় সাজানো হয় ত্রিমুখী মিশন’ এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে সিনহা কিলিং মিশনের লোমহর্ষক কাহিনি, যা সিনেমার কাহিনিকেও হার মানাবে।
‘জাস্ট গো’ ইউটিউব চ্যানেলে কক্সবাজার এলাকার ইয়াবা ব্যবসার যাবতীয় তথ্য তুলে ধরার জন্য রাশেদ সিনহা ইয়াবা বাণিজ্যের নেপথ্য কাহিনি নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করতে সর্বশেষ টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সাক্ষাতকার গ্রহণ করাই মেজর সিনহার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রতিবেদনে সাক্ষাতকারের ভিডিও ধারণ করেই সিনহা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই ওসি প্রদীপ কুমার কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের সাথে ফোনে আলাপ করে কয়েক মিনিটের মধ্যই কীভাবে মেজর (অবঃ) সিনহাকে হত্যার ত্রিমুখী পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা ওঠে এসেছে।

অসম্ভব মেধাবী ও চৌকস রাশেদ সিনহা খান ১৯৯৯ সালে কুর্মিটোলা শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে রাজউক কলেজে ভর্তি হয়। ওখান থেকে সাফল্যের সাথে পাশ করার পর বিএমএ লং কোর্সে ভর্তি হন এবং তার মেধার সাক্ষর রেখে সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সেকেন্ড লেপ্টেনেন্ট হিসেবে সেনাবাহিনীর চাকুরীর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।

এসএসএফ-এর সাবেক সাবেক মেধাবী সদস্য হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষার মতো চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও দুর্ধর্ষ এক কমান্ডো ছিলেন মেজর (অবঃ) রাশেদ সিনহা খান। সেনাবাহিনীর এমন মর্যাদাসমম্পন্ন চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে মুক্ত জীবনের প্রত্যাশায় মেজর সিনহা মো. রাশেদ ২০১৮ সালে সৈয়দপুর সেনানিবাসে থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসরে যান। তিনি ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। উদ্দেশ্য বিশ্বভ্রমণ করা এবং চলতে চলতে ইউটিউবের জন্য ট্রাভেলিং-এর উপর ভিডিও তৈরি করা।

সিনহার মা নাসিমা আক্তার তার ছেলের সম্পর্কে বলেন,'মায়ের প্রতি নিখুঁতভাবে দায়িত্বপালন করা, দেশভ্রমণ করা, বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা, সাগর সৈকতে বসে বই পড়তে পছন্দ করা, ঘরের সবকিছু গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি ছিল সিনহার শখ ও ইতিবাচক কাজ। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল সে। সিনহার বাবা মোঃ রাশেদ খান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় সিনহাদের আদিনিবাস। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব হিসেবে কর্মরত সিনহার বাবা ২০০৭ সালে মারা যান। বাবা মারা যাবার পর মাত্র ২৩ বছর বয়স থেকেই মা মিসেস নাসিমা আক্তার আর দুই বোনকে নিয়ে পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

সিনহার মা মিসেস নাসিমা আক্তার তার প্রিয় সন্তানকে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে সন্তানের হত্যার বিচার দাবী করেছেন। তার এই দাবীর সাথে একমত দেশের মানুষ জোর দাবী জানাচ্ছে যেন তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসে। অপরাধী যেই হোক তাকে যেন আইনানুগভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত সিনহার মাকে ফোন করে সান্তনা দিয়েছেন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন।

রাশেদ হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। দশ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির একজন প্রতিনিধি কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত সম্পন্ন করে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে। শামলাপুর ফাঁড়ির বিশ জন পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমারকে বরখাস্ত করে গ্রেফতার করে মামলা দায়েরের মাধ্যমে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

কক্সবাজারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর রাশেদ সিনহাকে কক্সবাজার পুলিশ কতৃক গুলি করে হত্যার ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরানো চেষ্টা চলছে বিষয়টি আচ করতে পেরেই সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর মধ্য অনুষ্ঠিত এক যৌথ সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- “সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নিয়ে কোনো মহলের উসকানিমূলক বক্তব্য কাম্য নয়। এতে সুষ্ঠু তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে দাবি করে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে একটি মহল পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের চিড় ধরানোর চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশ বাহিনী প্রধানের এক সঙ্গে বিবৃতি দেয়ার পর কোনো মহলের উসকানিমূলক বক্তব্য ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার শামিল।”

পরিশেষে এই বলেই লেখায় ইতি টানতে চাই অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী স্বপ্নবাজ এক দুরন্ত যুবক সিনহা তার লক্ষ্য সফল করতে পারলে হয়তো বাংলাদেশ একজন বেয়র গ্রিলস পেয়ে গর্বিত হতো। এই ধরণের একটি ডকুমেন্টারির কাজ করতে গিয়েই টেকনাফে পুলিশের হাতে নিহত হলো। সিনহার লোমহর্ষক হত্যাকান্ডে সারা বাংলাদেশ আজ স্তম্ভিত। ততে এ কথাও মানতে হবে গুটিকতক অসৎ লোকের অপকর্মের জন্য একটি বাহিনী কলঙ্কিত হোক বা আস্থার সংকটে পড়ুক এটা কারো কাম্য নয়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে আগামীতে পুলিশের হাতে যাতে আর একটিও এমন জঘন্য হত্যাকান্ড না ঘটে তা পুলিশবাহিনীকেই নিশ্চিত করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি দেশের নাগরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে একই সাথে রাশেদ সিনহার আত্মা যেন শান্তিতে থাকে এ প্রার্থনা করছি!



মাহবুবুল আলম
কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top