সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের ইহকাল পরকাল কোন কাল নেই : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
২৬ নভেম্বর ২০২০ ২২:২০

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৪


আমি এখন দাস। তাই আমি করজোড়ে ক্ষমা আর দয়া ভিক্ষা চাইছি। তিল তিল করে মরে যাচ্ছি আমি। মরে যাচ্ছে স্বপ্ন।রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে টিকে থাকার সব রাস্তা।
দয়া করুনা ভিক্ষা চেয়ে কোটি কোটি জনতার চিৎকার পৌঁছায় না ঐ রুদ্ধ দ্বারে।
একটি জানা গল্পঃ
এক বিত্তবান পরিবারের শিশুকে দরিদ্র শিশু সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ লিখতে বলা হলো।
শিশুটি লিখল--
দরিদ্র শিশুটি এতোই দরিদ্র যে,তাদের একটি মাত্র গাড়ি। এমন কি তাদের বাগানে মাত্র একজন মালী। তাদের শুধু একটাই বাড়ি।
আমাদের বর্তমান সমস্যার সমাধানের জন্য যাদের দিকে তাকিয়ে বসে আছি তারাও কি আমাদের দরিদ্রতা এবং সমস্যা নিয়ে ঐ শিশুর মতোই ভাবছেন?
১৯৭১ সারে ঢাকা শহর ছেড়ে মানুষ দলে দলে গ্রামে চলে গেছে জীবন বাঁচাতে। ২০২০ সালেও এ শহর ছেড়ে মানুষ চলে গেছে চাকুরী হারিয়ে, কাজ হারিয়ে। ৭১'এ যুদ্ধ ছিল। এখনও যুদ্ধ। তবে এ অন্য এক যুদ্ধ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেকে বেকার। অনেকের বেতন কমে গেছে। আমরা জানতাম করোনা শুধু সংক্রামিত হবার আশংকা নিয়েই আসছে না। করোনা নানা সমস্যার কারণ হয়েও আসছে।
করোনা এসেছে যুগ যুগ ধরে বলে যাওয়া মিথ্যেকে উন্মোচন করতে, করোনা এসেছে মুখোশ খুলে দিতে, করোনা এসেছে আমাদের অমানুষ রূপটি তুলে ধরতে।
১৬ই মার্চ থেকে বন্ধ হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এপ্রিল, মে, জুন তিন মাস যাবার পর শুরু হলো নানামুখী অন লাইন ক্লাস।
সরকার ঘোষনা দিল ব্যাংক সরকারি চাকুরিজীবীদের ব্যাংক লোনের কিস্তি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাটবে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেতনের জন্য চাপ দেবে না। কোন আদেশই মানা হলো না।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই অটো চালানো, রিক্সা চালানো, ফল বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। ব্যাংক দু মাস পরই শুরু করেছে কিস্তির টাকা কাটা।
ভুতুরে কারেন্ট বিল, অতিরিক্ত পানির বিলের ধাক্কা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বকেয়া বেতন, কলেজের সেশন ফিসহ নানা ধরণের অর্থনৈতিক চাপে দিশাাহারা মানুষ।
এ দেশের মানুষ হঠাৎ করে কি আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেয়ে গেছে?
শিক্ষা আর চিকিৎসা মানুষের দরিদ্র হবার, ঋণগ্রস্ত হবার কারণ। যে সব সরকারি কর্মচারী ব্যাংক থেকে লোন নেয় তারা সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা অথবা ঘর মেরামত করার জন্য এ লোন নেয়। কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, বিদেশে পাচার হচ্ছে, শোষণ করছে দুর্বৃত্ত অথচ চার পাঁচ লাখ টাকা যারা লোন নিয়ে নিয়মিত শোধ করছিল ব্যাংকের পাওনা তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এই করোনাকালে ছয় সাত মাস কিস্তি কর্তন স্থগিত রাখা গেল না।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেবা নয়, ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচালিত। সারা বছরই চলে নানা কারণ দেখিয়ে অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বকেয়া বেতন চাোয়ার ধরণ---

"বেতন দিতে হবে। নইলে পড়াশোনা বন্ধ।স্টুডেন্টশীপ ক্যান্সেল।এটাই তিক্ত সত্য। সম্মানিত মানুষদেরও বাড়িওয়ালা ধাক্কা মেরে বের করে দিচ্ছে, সেখানে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে মানবতা আশা করা বোকামি।"
এক মেয়ে গ্রুপে বলেছে, "আমার বাবার চাকুরী চলে গেছে। আমরা গ্রামে চলে এসেছি। তিন বেলা খাবার যোগাড় করতেই কষ্ট। বেতন দেবো কী করে?"
ম্যাডামের উত্তর, "তোমার পারিবারিক সমস্যা দেখা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়। ভর্তি হবার সময় ভাবা উচিৎ ছিল। জানতে না এখানে বেতন দিতে হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হলেও এটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।"
গ্রামে একটা প্রবাদ আছে মরাকে মার কেন?
উত্তর, নড়েচড়ে না তাই।
একটার পর একটা বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা নিশ্চুপ। আমরা প্রতিবাদের ভাষা বা ইচ্ছা দুটোই হারিয়েছি। সুতরাং আমাদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তা করা যায় বুঝে গেছে কর্তৃপক্ষ।

করোনা রিপোর্ট ভূয়া দেয়া যায় তা আমাদের কেন সারা বিশ্ববাসীর মাথায়ই আসেনি। আমাদের মতো ধার্মিক জাতি আর কোথায় আছে? নবিজি ব্যবসা করতেন তাই আমরাও সফল ব্যবসায়ী।
রপ্তানী যোগ্য বুদ্ধি নিযে আমরা বসে আছি। ব্যবসায়ী বুদ্ধিতে রপ্তানিই নয, মডেল আমরা বিশ্ববাসীর কাছে।
অন লাইন ক্লাস শুরু হবার সাথে সাথে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেছে অন লাইন কোচিং, টিউশনির।

একজন ড্রাইভারকে দিয়ে ৮০০০ টাকার বিনিময়ে এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে আবার নিজ হাসপাতালে চিকিৎসা করে লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেবার কৌশল সত্যি বিস্ময়াবিভূত করার মতো।

খালি বাক্স দেখিয়ে ৯০০ কোটি টাকা লুটে নেয়া মিঠুর প্রতিভায় আমরা আরো মুগ্ধ। বালিশ, পর্দা, কলাগাছ যতই দামী হোক তবুও ছিল। কিন্তু উনি তো পিছনের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে শীর্ষে অবস্থান করছেন। কারণ উনি কিছুই দেননি। বাক্স ছিল, তবে খালি।
চলছে প্রদীপের আলোর ঝলকানি। একটা ঘটনা উন্মোচিত হবার সাথে সাথে তার হাজারটা অপকর্ম উঠে আসে। একজন মানুষকে দানব তৈরি করতে যারা নীরব ছিলেন, সুবিধার ভাগ নিয়েছিলেন, দেখেও না দেখার ভান করে মৌনব্রত পালন করেছেন তাদের সকলকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না?
অবৈধ সম্পদের পাহাড় যারা গড়ে তোলে তারা স্ত্রী, সন্তান, শালা, ভাই এদের নামে সম্পদ কেনে। যাকে ধরা হয় শুধু তার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। তার সম্পদের খোঁজ নিয়ে পরিবারসহ নিঃস্ব করা কেন হয় না?
এই দানবদের সন্তান টাকা দিয়ে লেখাপড়া করে দেশের বড় বড় পদে বসবে ভবিষ্যতে।
মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের পর কৃষ্ণ বলেছিলেন, "একজন মহারাণীর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ নারীদের সাথে এ রাজ্যে কী হবে ভেবে দেখুন।"
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার দেশে একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে হত্যা করা হয়, ভাই, স্বামীকে ছাড়াতে গিয়ে থানায স্ত্রী, বোন গণধর্ষণের শিকার হয়,  একজন নৈবাহিনীর কর্মকর্তা দাাঁত হারাবার পর জানা  যায় হাজী সাহেবের কেরামতী। তাহলে  সাধারণ মানুষের কী হাল ভাবুন?
আমাদের ইহকাল, পরকাল কোনটাই নেই। এ কালে কথা বললে ৫৭ ধারা। পরকালে একালে প্রতিবাদ না করার পাপে জাহান্নাম।
অমানুষেরা যখন সংঘবদ্ধ, আমরা মানুষেরা তখন একা।
মৌন থাকার, উদাসীন থাকার, কেউ একজন এসে সব পাল্টে দেবে এই আনন্দে বিভোর থাকার পাপে আমরা সবাই পাপী।
আমাদের মুক্তি কোথায়, কতোদূর? 

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক, কলামিস্ট ও কবি  

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top