সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

রক্তস্নানে ফাগুন আসে ভালোবাসা নিয়ে : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:০৩

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:৪৫

 

ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন। এ সময়ে প্রকৃতি সাজে অপরুপ সাজে।  শীতের জড়তা কাটিয়ে রঙে রঙে সাজে গোটা প্রকৃতি। এ বাংলায় ফাগুন এসেছে ৫২ সালে রাজপথ রঞ্জিত করে। ১৯৮৩ তে আবার এই ফাগুনেই  রক্ত রঞ্জিত হয়েছে কালো রাজপথ।

জহির রায়হানের উপন্যাসের বিখ্যাত  সংলাপ, "আরেক ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো।"

৫২-এর প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাস আমাদের চেতনার জগতে আজো নাড়া দেয়। প্রতি ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হতে পেরেছিলাম বলেই এসেছিল রক্তস্নাত পথে ৭১।
স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা বিস্মৃত হইনি অতীত। তাই তো আবার এসেছিল ১৯৮৩।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৮৩ সালের ১৪ ই  ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের দাবী আদায়ের পথে জীবন বিলিয়ে দেবার  মতো বড় ঘটনা ঘটে।
কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষানীতির প্রতিবাদে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি গর্জে ওঠে ছাত্র সমাজ। তৎকালীন ১১টি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত  হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

মজিদখান শিক্ষানীতিতে ছিলঃ
১/এস এস সি কোর্স ১২ বছর।
২/বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব।
৩/ যারা শিক্ষার ব্যয় ৫০ শতাংশ বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চ শিক্ষায় সুযোগ প্রদান।

ছাত্র সমাজের দাবী ছিল একটি অবৈতনিক,  বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। ফলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই গণ বিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্র বন্দীদের মুক্তি, দমন নীতি বন্ধ, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনের ডাক দেয়।

১৯৮৩ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারী এই ডাকে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে নেমে আসে রাজপথে। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বাধা দেয়। ফলে ছাত্রনেতারা ব্যারিকেডের কাঁটাতারের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়া শুরু করে। পুলিশ গরম পানি ছিটিয়ে, লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয় তখন চালায় গুলি। প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল। আহত জয়নালকে রাজপথে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ।

শিশু একাডেমিতে এসেছিল শিশু দীপালি সাহা। দীপালি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পুলিশ তার লাশ গুম করে। সরকারি হিসা্বে সেদিন দশজন শহিদ হলেও ধারণা করা হয় কমপক্ষে পঞ্চাশজন শহিদ হয়েছিল এই আন্দোলনে। পুলিশ এই লাশগুলো গুম করেছিলো।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল এ দেশের দামাল ছেলেদের  রক্তে। তারা তাদের জীবন, স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলো কথা বলার অধিকার।
১৯৮৩ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি স্বাধীন দেশের স্বাধীন মাটিতে স্বৈরশাসকের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে আবার প্রাণ উৎসর্গ করেছে এদেশের দামাল সন্তানেরা অবলীলায়।
১৯৮৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি। ফাগুনের প্রথম দিন।  আনন্দে, নব সৃষ্টির আলোকে জেগে ওঠে প্রকৃতি। এমনি এক আগুন ঝরা দিনে, পলাশের রঙে রঙিন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তখন এরশাদের সন্ত্রাসী বাহিনী কাছ থেকে গুলি করে হত্যা  করে  জাতীয় ছাত্র লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়াকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরেই তিনি হত্যা কান্ডের শিকার হন।

জহির রায়হানের উপন্যাসের যে বাক্য তরুণদের নির্ভিক করেছিলো, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিলো  সে বাক্য ভুলে গেলো তরুন সমাজ।  মিছিলে শ্লোগানে মুখরিত  তারুণ্য প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়  কামনার কাছে আত্মসমর্পন করলো।

দ্বিগুণ হবার কথা ছিল ন্যায়ের পক্ষে, অধিকারের পক্ষে, সত্যের পথে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণদের কিন্তু পূর্বপুরুষের  সত্য, ন্যায়, অধিকারের ইতিহাস ভুলে ফাগুনের আগুন ঝরা দিনে এ প্রজন্ম ভালোবাসার নামে কামনার কাছে আত্মসমর্পণ করল।

১৪ ই ফেব্রুয়ারি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদদের স্মরণ করার কথা ছিল। ভালোবাসা দিবস হিসাবে পালন করলেও দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার এই আত্মত্যাগ জাতির বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবার কথা নয়। দেশ প্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন ১৯৮৩ সালের ১৪ ই ফেব্রয়ারি রেখেছিল এ দেশের শিক্ষার্থীরা।

প্রতি বছর বাড়ছে এ প্লাস। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি, নানা স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এ দেশের প্রতিটি মানুষের শিক্ষার প্রতি আগ্রহের চিত্র তুলে ধরে।

প্রতিটি অলি গলি মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টারে সয়লাব। পাঠ্যপুস্তকে  প্রাথমিকের শুরু থেকেই নানা জাতীয় দিবস সম্পর্কে ধারণা দেয়া আছে। তারপরও স্মৃতিসৌধ আর শহিদ মিনার কেন তৈরি হয়েছে, সেদিন কী হয়েছিল, কারা কারা শহিদ হলেন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না।

মিডিয়ার প্রচার আর ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনের লোভের  কারণে ভালোবাসা দিবস দিন দিন ফুলে ফেঁপে বিস্তার লাভ করছে।
এই দিবসটি ঘিরে নানা আয়োজন, প্রতিযোগিতা এবং উপহারের ছড়াছড়ি আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে আরেক ফাগুনে দ্বিগুণ হয়ে একসাথে ঝলসে ওঠার বাসনাকে হত্যা করেছে।
ভালোবাসা দিবসে আমরা নিজ দেশ সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসায় উজ্জীবিত হতে পারতাম। এ দিবসে আমরা মানুষকে ভালোবেসে যে কোন একটি অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতাম।
অথচ ভালোবাসা দিবসে পার্টি হয়। নেশা আর নারীতে ডুবে থাকে জহির রায়হানের তরুনেরা। দ্বিগুন থেকে শতগুন হয় ধর্ষক, কামনার্ত তরুণ।

হৃদয়ে এদের আগুন নেই। আগুন আছে দেহে। সে আগুনে ঝলসে যায় স্বইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শুরু হবার আগেই জীবন। ড্রেনে, ডোবায়, ডাস্টবিনে পড়ে থাকে মানব শিশু ভালোবাসা দিবসের নির্লজ্জতার নিদর্শন হয়ে।

জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চনসহ ১৪ ই ফেব্রুয়ারীর শহিদদের জীবনের বিনিময়ে কী পেলাম আমরা?
আমাদের নানা ডে -এর সৃষ্টি হয় মিডিয়াগুলোর বস্তা পচা কিছু অনুষ্ঠান তৈরি আর নানা গিফট বিক্রির জন্য।
সুকান্ত আর জহির রায়হান এই ব্রেন ওয়াশ সময়ে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ।

এখন আর দেয়াশেলাইয়ের কাঠির মতো আমরা একসাথে জ্বলে উঠি না। আসছে ফাগুনে দ্বিগুন হবার বাসনায়  ঝলসে উঠি না। এখন ভালোবেসে জীবন দেই না। প্রেয়সীকে বলি না,  "নব ইতিহাস রচিবো আমরা মুছি কলংক লেখা।"
এখন ভাইহীন দেশে বোনেরা গণধর্ষনের শিকার, প্রেমহীন নেশাখোর দেশে প্রেমিক প্রেমিকারা সকাল সন্ধ্যা সম্পর্ক পাল্টায়।
রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, সখী ভালোবাসা কারে কয়?
আগে ভালোবাসা আর কামনার তফাৎটা বুঝতে শিখতে হবে। তারপর ভালোবাসা যাবে। যে মাথাগুলো বিক্রি হয়ে গেছে নেশা আর নারীতে।  যে জীবন নিমজ্জিত মুখোরোচক খাওয়া আর সেলিব্রিটি হবার বাসনায়। যারা অভ্যস্ত ছবি আর পোশাকে চেতনা, প্রেম প্রকাশের, তারা কি জানবে কেমন করে জয়নালকে খুচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল প্রকাশ্য রাজপথে?
দিপালী নামক মেয়েটির মৃতদেহটি পর্যন্ত তার মা বাবা পায়নি। মৃত্যুর সংখ্যাটি পর্যন্ত নিশ্চিত হওযা যায়নি।
বারবার ফাগুন এসেছে রক্তস্নাত পথ দিয়ে। জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য এ দেশের সন্তানেরা দিয়ে গেছে ভালোবাসা। শিখিয়েছে দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভালোবেসে অকাতরে কী করে প্রাণ উৎসর্গ করা যায়।
মানুষ বলেই আমরা ধ্বংসস্তুপে গড়তে পারি নতুন সকাল। মানুষ বলেই দেখতে পারি সৃষ্টির স্বপ্ন।
তাইতো এখনো অপেক্ষায় আছি কোন এক ফাগুনে আমরা দ্বিগুন হবো। দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো আমরা একযোগে জ্বলবো হৃদয়ের প্রেমে নিয়ে।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক কলামিস্ট

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top