বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব
গর্বিত ৫০ বছরের বর্ণময় সাফল্য প্রাপ্তির কিছু খতিয়ান : ডঃ সুবীর মণ্ডল
প্রকাশিত:
২৪ মার্চ ২০২১ ১৯:২৫
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৮:৫৬

'যাঁর জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা
মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা
আজি রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি
বিজয়লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরি গলে'
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভাবতে বসলে প্রথমে সেই মানুষগুলির কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ে যাঁদের স্বপ্ন ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশেকে দাসত্বের চরম গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছিল। যাঁদের রক্ত আর চোখের জলে দীর্ঘ দু'দশকের পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করেছিল। বুকের এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী মুক্তিকামি কোটি কোটি লড়াকু মানুষ। তাঁরা এক ও অজস্র, তাঁরা কিশোর থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা, পদ্মা-মেঘনা-রূপসা-মধুমতী-কর্ণফুলী কীর্তিনাশা-তিতাস কিংবা করতোয়া-ইছামতীর কূলে মর্মরিত করেছিল মুক্তির মৃত্যুঞ্জয়ী আকাঙ্খা। তারপর অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে সূচিত হয়েছিল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সময়ের হাত ধরে আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে কোটি কোটি মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় দবস হিসাবে পরিচিত এবং সরকারি ভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সারা মার্চ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাস হিসাবে পরিচিত ও বিবেচিত।
একটা দেশ তৈরী হয়েছিল ১৯৭১ সালে, শুধুমাত্র মাতৃভাষার স্বাধীনতার জন্যে মরণপণ লড়াই করে। আমি তখন দশ। ভাষার বোধ তখন সেভাবে না হলেও যুদ্ধটা মনে আছে। মনে আছে অংশুমান রায়ের গান। "শোন একটি মুজিবুর থেকে…..বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।" দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল এই গান উভয় বঙ্গে। রবি ঠাকুরকে মাথায় নিয়েই একটা কথা বলি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি গান আমায় আজও আবিষ্ট করে রাখে। 'আমি বাংলায় গান গাই '। আজও চোখ বুজলেই দেখতে পাই আমাদের প্রতিবেশী রূপসী বাংলাদেশকে। অনেক শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। এ বছর (২০২১ এর ২৬শে মার্চ) কিছু দিন পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপিত হবে মহাধূমধাম করে। বাংলাদেশের সরকারি সিদ্ধান্ত, বেশ কিছু অনুষ্ঠান ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে করবে। দুদেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের সম্পর্ককে আরও মজবুত করার জন্য নানা কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। গোটা দেশ জুড়ে প্রস্তুতি চলছে। সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। আগামী ২৬ ও ২৭ শে মার্চ দু'দিনের কর্মসূচিতে যোগ দেবেন তিনি। এটা অত্যন্ত গর্বের দিন দুইবাংলার মুক্তমনা বাঙালির কাছে, সেই সঙ্গে ভারতবাসীর কাছে। বিভিন্ন বর্ণময় অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এই বর্ণিল মহান সুবর্ণজয়ন্তী। সেজে উঠেছে বাংলাদেশের ৬৪ টি
জেলা। নানান ধরনের কর্মসূচি চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। এক গর্বিত জাতীয় উৎসবের দিকে তাকিয়ে আছে সমগ্র বাঙালি জাতি ও বিশ্ব ।নানান ধরনের বাধার পাহাড় পেরিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে-এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই বলে মনে হয়। ইতিমধ্যেই একটার পর একটা সাফল্যের মুকুট নিয়ে এগিয়ে চলছে মাথা উঁচু করে। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের সম্মানে ভূষিত বাংলাদেশ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে অসাধারণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছে। এটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিভিন্ন দেশের রাষ্টপ্রধানদের অংশগ্রহণ সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবকে নতুন মাত্রা দান করবে বলে সবার বিশ্বাস।
গত বছরের ডিসেম্বরে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের প্রস্তুতি বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ আব্দুল মোমেনের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, 'ভারত আমাদের কাছে প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে তারাও রক্ত দিয়েছে। আগামী বছর আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব করব। এ- উৎসবের অনেক অনুষ্ঠান দু'দেশ মিলে করবে। এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনাও চলছে '। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেমন
(১) স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে "স্বাধীনতা সড়ক" উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের ও ভারতের জাতীয় সরকার। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে কুষ্টিয়ার মুজিব নগরে বাংলাদেশের যে অস্হায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এই সড়ক উদ্বোধন হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন।
(২) বাংলাদেশের মেহেরপুর এবং ভারতের নদীয়া জেলার সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত সড়কটি। সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের আর একটি জনপ্রিয় কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে। ২৬শে মার্চ থেকেই ঢাকা--জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনের শুভ সূচনা হবে। দুই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটবে দুই দেশের।
আজ বাংলাদেশ স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে ৫০ বছরের পূর্তির দ্বার প্রান্তে, তাই পেছন ফিরে তাকালেই প্রাপ্তির খতিয়ান অনেক খানি দেখতে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে বাংলাদেশের প্রাপ্তির ভাণ্ডার খুব একটা কম নয়। হয়ত অর্জন-প্রাপ্তি আরও বেশি হতে পারত। তবে যা পাওয়া গেছে তা খুব সামান্য নয়। তারই খতিয়ান আলোচনা এই নিবন্ধটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে সম্মানিত দেশ ও রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭০-২০২০, বাংলাদেশের ৫০ বছরকে নানা সূচকে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে যে ছবি দেখতে পাই আমরা, তা অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গর্বের বিষয়। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, জাতীয় বাজেট, গড়পড়তা আয়ুর একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে প্রাপ্তির খতিয়ান যা পাওয়া গেছে তা হতাশা জনক নয়, বরং অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গর্বের বিষয়। এ-কথা সত্য একটা দেশের সর্ব ক্ষেত্রে সাফল্যের বর্ণময় ইতিহাস ১০০ ভাগ খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শুধুমাত্র ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনার আবহাওয়া ২০১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৫০ বছরে বৃদ্ধি ৩০ গুন। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪,৭৫ গুণ। এটা অত্যন্ত আশাপ্রদ। বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণসড়ক, শিল্পায়ন, গৃহায়ন, নগরায়ণ, সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার, দারিদ্র্য- বিমোচন, স্বাস্থ্য, উচ্চ শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ অনেক খানি এগিয়ে গেছে। নারীর ক্ষমতায়ন, আইন শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, জন্ম-মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতির সূচক সন্তোষজনক। ৫০ বছরে পরিবর্তন ঘটেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং শিক্ষা-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন পাশাপাশি হাত ধরে এগোচ্ছে। এটা, একটা দেশের পক্ষে অত্যন্ত গর্বের বিষয়। পদ্মা সেতু, পারমাণবিক প্লান্ট, বঙ্গবন্ধু চ্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়ালপুল, অত্যাধুনিক টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ট্রেন, সড়ক, জলপথের যোগাযোগ বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাফল্য অনন্য। আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র, পরিষেবা ও সেবা প্রদানকারী সংস্থা গুলি আন্তর্জাতিক মানের। বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তি খুব সন্তোষজনক। মৎস্য ও পোশাক শিল্পের অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন বাংলাদেশের একটি বড় সাফল্য। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমশ সম্মান বৃদ্ধি একটা দেশের পক্ষে অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব তাকে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা দান করেছে। শিল্পোৎপাদনে, বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। রফতানি বাণিজ্যে আজ বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশের স্হান উজ্জ্বলতর।জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকা বর্তমানে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রেও, বিশেষত ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক নজির সৃষ্টি করেছে। জনমুখী স্বাস্থ্য পরিষেবা চিকিৎসাব্যবস্হায় অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। পর্যটন শিল্পে আন্তর্জাতিক সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। সর্ব ধর্মের সহ অবস্থান বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। শিশু অধিকার ও গর্ভবতী মায়েদের পরিষেবা, অপুষ্টি দূরীকরণে সাহসী ভূমিকা প্রশংসনীয়। বাংলাভাষা চর্চা ও বিকাশে বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। সরকারি কাজে ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা অনন্য। সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মানের। গবেষণায় এগিয়ে চলেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বেকারত্ব দূরীকরণে সাহসী ভূমিকা পালন করে চলেছে। সামাজিক অস্থিরতা ও অসাম্য দূর করতে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ছোট-বড়ো কলকারখানা গড়ে তোলার কাজ প্রশংসনীয়।ভূমি সংস্কার ও গ্রামোন্নয়ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ বাংলা ভাষার তাৎপর্য যেমন বহন করে, তেমনি পৃথিবীর পেক্ষাপটে এই দেশটি খুব দ্রুত এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যেমন নিজস্ব গৌরব আদায় করেছে, তেমনি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশ স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে অল্প সময়ের মধ্যেই। এই দেশটি 'পাঠাভ্যাস উন্নয়ন' নিয়ে ভাবছে। সেটা হল 'বই পড়া কর্মসূচি'। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র প্রায় ২৬ বছরের প্রচেষ্টা ও প্রয়াসে বইপড়া কর্মসূচি নিয়ে ২৫০০ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে হাজির হতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের মুদ্রণ পারিপাট্য ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। ছাপা, বাঁধাই, রুচিশীল লে-আউট---সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মুদ্রণসমাজ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির কাছেও ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় বইমেলা দুই দেশের অত্যন্ত গর্বের বিষয়। বিশ্বজুড়ে বইয়ের বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা এক আকাশ অহংকার। বাংলাদেশ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সাহসী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের ভাব ও ভাবনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার ধারাটি তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী এযাবৎ আনুমানিক ৮৩৬টি বই প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী নামক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সূচনা ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের নেপথ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা। বাংলা একাডেমী বাঙালির জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের মহানপ্রতীক হয়ে থাকবে সবসময়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান মানুষের হৃদয়ের মানচিত্রে চিরজীবী করে রাখার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের কাছে এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে এই স্মৃতিভবন।
বিশ্বজুড়ে ব্র্যান্ড বাংলাদেশ। সময়ের নিরিখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজের সুবাদে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসা আদায় করে নিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্হান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ব্র্যান্ড বাংলাদেশ প্রশংনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মুছে ফেলতেই এই সাহসী পদক্ষেপ। বিশ্বজুড়ে এই প্রচারের জন্য একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ চলছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ব্র্যান্ড বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের সরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রগতির রূপরেখা তৈরি করতে ব্র্যান্ড বাংলাদেশ অসাধারণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের সুরক্ষায় বর্তমান সরকার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। সংখ্যালঘুদের দুর্গাপুজোর সংখ্যা বেড়েছে। সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে জাতীয় সরকার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি নিজের দেশ বলে মনে করে। সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সমস্ত ধরনের প্রতিশ্রুত পালন করে শেখ হাসিনা সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
১৯৭২-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় কোন এক দেশের প্রতিনিধি উপহাস করে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে অভিহিত করেছিল দেশটিকে। তারই যোগ্য জবাব দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। বাঙালির গৌরব ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বজুড়ে। ধীরে ধীরে মহাকাশে জায়গা করে নিল বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দেশটি উৎক্ষেপণ করে দেখিয়ে দিল কৃত্রিম উপগ্রহ, বঙ্গবন্ধু-১। বিশ্বের নজর এসে পড়ল দেশটির দিকে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে এখন দ্বিতীয় স্হানে। প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় একেক পর এক স্বপ্ন সফল হয়েছে। ৫০ বছর পূর্তির দ্বারে দাঁড়িয়ে এই সব প্রাপ্তি কম নয়। দ্বিতল পদ্মা সেতু তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও মেট্রো রেল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ৩০০০ কোটি ব্যয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে মহাকাশে জায়গা করে নেওয়া কম কৃতিত্ব নয়। আজ সারা পৃথিবীতে খুব সহজেই বাংলা শেখার ক্ষেত্রে অভ্র--কিবোর্ড বিশেষ ভাবে সমাদৃত। এমন অভাবনীয় আবিষ্কারের জন্য বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আজ সারা পৃথিবীতে অভ্র কী-বোর্ড সমস্ত বাঙালির কাছে গৃহীত হয়েছে তার সহজ প্রয়োগ পদ্ধতির জন্য।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেভাবে নিজস্ব ভাষায় তাদের পরিচিত বহন করে গর্বিত হয়। বাংলাদেশ আমার কাছে ঠিক সেই পর্যায়ে উন্নীত একটি রাষ্ট্র, যে-তার ভাষাকে আঁকড়ে নিজস্বতায় উজ্জ্বল পৃথিবীতে। হয়তো বাংলা ভাষাটা বেঁচে থাকবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মধ্যেই। বাংলাদেশকে প্রথম প্রত্যক্ষ করি প্রায় এক দশক আগে। বাঙালি হিসাবে বিস্মিত হয়েছি, সেখানে সব কিছুতেই বাংলা। বিজ্ঞাপনে বাংলা, হোডিং-সাইনবোর্ড বাংলায়, মুদ্রায় বাংলা, আলাপচারিতাতে বাংলা। ভীষণভাবে আবেগতাড়িত হয়েছিলাম বাংলাদেশের বাংলা ভাষার এমন রাজকীয় মর্যাদা দেখে, এখনো সেই আবেগ ও মর্যাদায় মজে আছে এপার বাংলার বাংলা ভাষা- ভাষী মানুষজন। বাংলাদেশ বলতেই মনে পড়ে যায় লালন ফকির, কাঙাল হরিনাথ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দিন, জীবনানন্দ দাশ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হুমায়ুন আহমেদ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মহম্মদ ইউনুস, রুনা লায়লা, আব্বাস উদ্দিন আরও কত প্রবাদপ্রতিম বর্ণময় মানুষের কথা। বিস্মিত হই যে, এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কত শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বাঙালি বিজ্ঞানী। এই ভূখণ্ডে নিজস্ব কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সম্ভার ছিল, আজও আছে।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ। ধর্ম অভিন্ন হওয়া সেত্ত্বও পাকিস্তানের থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা ভাষার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করে মুক্তকন্ঠের অধিকার ও আত্মমর্যাদা রক্ষার সাহসী প্রচেষ্টা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের ভিত হিসেবেই প্রস্তুত করে দিয়েছিল বাঙালি জাতিসত্তাকে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ঘটে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ এপার বাংলার বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের কাছে ভিন্ন এক বর্ণময় তাৎপর্য বহন করে। বাংলাদেশ নামটির সাথে এ-দেশের অসংখ্য মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর বাঙালির কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভিন্ন আলো বহন করে বাংলা ভাষার জন্য। মাতৃভূমি না হয়েও অসংখ্য বাঙালির আত্মপরিচয়ের ও মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠ জায়গা হিসেবেই আজকের বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব অন্য তাৎপর্য বহন করে আনবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা--এমন এক স্বপ্নের দিকে পৃথিবীর সমগ্র বাঙালি যেমন তাকিয়ে থাকে, তেমনি আমরাও তাকিয়ে থাকি দেশটির দিকে বাঙালি সত্তার ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রনির্মাণের অতীত ইতিহাসের কাছে নতজানু হয়ে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপিত হবে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মধ্যেই। একটি দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবকিছু ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করবে সেটা অমূলক। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে ফুল বিছানো ছিল না। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ভাঙাচোরা অর্থনীতি নিয়ে যাপিত অন্ধকার জীবন। আশা-নিরাশার দোলা। তবু পঞ্চাশ বছরের মধ্যে নানান ক্ষেত্রে অসাধারণ উন্নয়ন ঘটেছে, আত্মতুষ্টির করার জায়গা নেই। সময়ের হাত ধরে জাতীয় জীবনের যা কিছু ব্যর্থতা তা কাটিয়ে উঠতে হবে আগামী দিনে। কোন দেশই হতাশার ও অপ্রাপ্তির ছবি একেবারে মুছে ফেলতে পারেনা এত অল্প সময়ে। হয়তো আরো কিছু সময় পেলে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে আগামী দিনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার ছিল একতা ও জাতীয়তাবোধ। স্বাধীনতার পরেও আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা, মৌলবাদের আধিপত্য, বিচ্ছিন্নতাবাদিদের আধিপত্য, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা অভাব কিছু রয়েছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ও সাফল্যে এগুলো অন্ধকার দিক। এগুলো সমূলে বিনাশ করতে হবে। সামাজিক অস্থিরতা ও অসাম্য এবং জাতিগত ভেদাভেদ দূর করতে হবে দৃঢহাতে। জাতিগত, বেকারত্ব ও কর্মহীনতার চিরকালীন অসুখকে কড়া হাতে দমন করা দরকার। দেশে কৃষি ও শিল্পের সুষম বিকাশ ঘটিয়ে বেকারত্ব দূর করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যদি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্নীতি মুক্তপ্রশাসন, সবার জন্য শিক্ষা ও কাজের ব্যবস্থা নিশ্চিত করণ, এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করে, তাহলেই ভবিষ্যত প্রজন্ম খুঁজে পাবে মুক্তির প্রকৃত সার্থকতা। এ বছর স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ- বছর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন ও গঠনতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা শুরু হোক। এটাই শপথ গ্রহণ করুক দেশবাসী। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ও জটিল স্বাধীনতা সংগ্রামে এই স্বপ্ন ছিল ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে অসংখ্য দেশপ্রেমিক ও শহীদের প্রেরণাস্বরূপ।
স্বাধীনতা যে মূল্যে আসুক, একে কেন্দ্র করে যত বিতর্কই থাকুক, দিবালোকে মতো তা স্পষ্ট। প্ররবশতা থেকে মুক্ত দেশ ও জাতির সেই স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা কোনও স্বর্গই রচনা করেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও শোষণ-অর্থনীতির নিগড় থেকে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম আজও চলেছে। স্বপ্ন আর বাস্তবের বিপুল ফারাক থাকলেও তা কখনো অধরা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই করোনার বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করে চলেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। বর্তমানে মৃত্যু মিছিল অনেক খানি থেমে গেছে। চারদিকে স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ। মারণরোগের বিরুদ্ধে লড়াই আজও থামেনি। তবু সারাদেশ জুড়ে সাজোসাজ বর্ণাঢ্য উৎসবের প্রস্তুতি। একটা কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মতো লড়াই করে চলেছে। এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। দারিদ্র্য ও বেকারত্বের পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাস আর তার সঙ্গে উপমহাদেশীয় ঠাণ্ডা যুদ্ধের বৈরিতা বেড়ে চলেছেই। ঠিক এমনই এক অশান্ত প্রতিবেশ- পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপিত হবে। তবে হতাশাই শেষ কথা নয়। শান্তি, মৈত্রী ও প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে আমাদের সবার প্রিয় রূপসী বাংলাদেশ। শুভ সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের প্রাককালে শপথ হোক
'এ পথটুকুই ভীষণ।
এটুকু পার হতে পারলেই
হৃদয়ের সবুজ উপত্যকায় গিয়ে নামবে ----
এই দুরন্ত লড়াইয়ের সিঁড়ি ভাঙো
জয় হবেই,
জয় হবেই।'
(দীনেশ গঙ্গোপাধ্যায়)
ডঃ সুবীর মণ্ডল
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বিষয়: সুবীর মণ্ডল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: