সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

স্যালুট ক্যাপ্টেন নওশাদ  : মু: মাহবুবুর রহমান 


প্রকাশিত:
৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:০৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৭:১৩

ছবিঃ ক্যাপ্টেন নওশাদ 

 

“Heroes Never Die” (বীরের মৃত্যু নেই)। এ উক্তিটি ক্যাপ্টেন নওশাদের জীবনের সাথে মিলে যায়। যিনি নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে বাঁচিয়েছেন বিমান যাত্রীদের জীবন। নিজের দায়িত্ব কিভাবে পালন করতে হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন ক্যাপ্টেন নওশাদ।   

পুরো নাম নওশাদ আতাউল কাইয়ুম, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন গর্বিত ক্যাপ্টেন, যিনি দায়িত্বরত অবস্থায় গত ৩০/০৮/২০২১ তারিখ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।  

এর মাত্র দুই দিন আগে ২৭ আগস্ট ওমানের মাস্কাট থেকে ১২৪ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট (বিজি-০২২) পরিচালনা করছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। কিন্তু মাঝপথে পাইলট নওশাদ হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ বোধ করেন, নিজের তীব্র কষ্টের মধ্যেও ১২৪ জন যাত্রীর কথা তাঁর মাথায় ছিল। জরুরি অবতরণের জন্য বার্তা দেয়া হয় কলকাতা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে। নিকটবর্তী নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণের পরামর্শ দেন তাঁরা। এরপর সেখানে জরুরি অবতরণ করে ৭৩৭-৮০০ মডেলের বিমান এবং যাত্রীরা সবাই রক্ষা পায়।   

আকাশে বসে অসুস্থ হয়ে পড়লে সাথে সাথেই কো-পাইলট ফার্স্ট অফিসার মোস্তাকিমের  কাছে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ। নাগপুরের ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের পর ক্যাপ্টেন নওশাদকে দ্রুত নাগপুরের হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রথমতঃ জানা যায় পাইলটের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো! পরবর্তীতে পরীক্ষা নীরিক্ষা'র পর জানা যায় তার স্ট্রোক হয়েছিল! প্রথমে ছিলেন কোমায়, তারপর লাইফ সাপোর্টে আর সবশেষ সবাইকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।   

হার্ট অ্যাটাকের পরও কি পরিমান মানসিক দৃঢ়তা ও দায়িত্ববোধ থাকলে এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া সম্ভব! যেটা করে দেখিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। তবে তাঁর এই দায়িত্বশীতলতার পরিচয় এবারই প্রথম নয়.! পাঁচ বছর আগে আরেকটি ঘটনায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে ১৪৯ জন মানুষকে বাঁচিয়ে ছিলেন তিনি ও তার সহ-পাইলট। তাও এই মাসকট থেকেই! সেই সময়েও এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিলো।  

দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। ক্যাপ্টেন (প্রধান পাইলট), ফার্স্ট অফিসার (পাইলট) আর পাঁচজন কেবিন ক্রু। আর যাত্রী ১৪৯ জন। ওমান থেকে ফ্লাইটটি যাচ্ছিল চট্টগ্রাম। ওমানের স্থানীয় সময় তখন রাত তিনটা! গভীর রাতে দেড় শতাধিক আরোহী নিয়ে মাসকট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গর্জন করে আকাশে উড়াল দিতে যাচ্ছিলো বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজটি। গন্তব্য চট্টগ্রাম‌ কিন্তু মাসকট বিমানবন্দরে রানওয়ে থেকে উড়াল দেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে উড়োজাহাজটিতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে কন্ট্রোল টাওয়ারে দফায় দফায় যোগাযোগ করে জানা যায় ল্যান্ডিং গিয়ারের ডান পাশের চাকার টায়ার ফেটেছে!  

বিমানটি উড়ার পরের বিকট শব্দ যাত্রীরাও শুনতে পেয়েছিলেন। তবে শুরু থেকেই যাত্রীদের আতঙ্কিত না হতে বলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। তিনি এবং ফার্স্ট অফিসার মেহেদী হাসান বুঝতেও পারছিলেন, কী ঘটেছে! ১৮ টন জ্বালানি আর উড়োজাহাজটির ওজন ৬০ টন। সব মিলিয়ে ৭৮ টন ওজনের বিশাল উড়োজাহাজের ওমানে ফিরে গিয়ে জরুরি অবতরণ করাও অসম্ভব! একটু এদিক-সেদিক হলেই বিস্ফোরিত হতো উড়োজাহাজটি! প্রাণ যেতে পারতো সব আরোহীর। তবে পাঁচ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে চট্টগ্রামের পরিবর্তে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করান ক্যাপ্টেন নওশাদ! আর জীবন রক্ষা পায় দেড় শতাধিক আরোহীর।   

এই দুঃসহ অভিযাত্রার স্বীকৃতি হিসেবে বৈমানিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের প্রশংসাপত্রও পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। 

ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুম ১৯৭৭ সালের ১৭ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পাইলট হিসেবে যোগদান করেন। নওশাদের বাবা আব্দুল কাইয়ুমও ছিলেন পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেন। চলতি বছর ২৮ শে ফেব্রুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। ছয় মাসের ব্যবধানে পিতা ও পুত্রের এই দুনিয়া থেকেই বিদায়!  

২ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বিমানের একটি ফ্লাইট নওশাদের মরদেহ নিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এসময় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মাথার ক্যাপ খুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে নওশাদকে শেষ শ্রদ্ধা জানান তাঁর সহকর্মী পাইলটরা। পরে রাজধানীর বনানীতে মা ও বোনের কবরে চির নিদ্রায় শায়িত হন ক্যাপ্টেন নওশাদ। 

আমাদের সবার পক্ষ থেকেও স্যালুট ক্যাপ্টেন নওশাদ। যখন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দায়িত্ববোধ, সততা, নিষ্ঠা, মানবিকতা নিভৃতে কাঁদে তখন ক্যাপ্টেন নওশাদ দেখিয়ে গেছেন জীবন দিয়ে হলেও কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।   

বিনম্র শ্রদ্ধা ক্যাপ্টেন নওশাদ! ওপারে ভালো থাকুন !! 

 

মু: মাহবুবুর রহমান
নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top