সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়াবহরূপ : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২২ জুন ২০২২ ০৩:২৩

আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:২৮

 

বন্যার পানিতে রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বানভাসি মানুষ নিজ ঘরে থাকার নিষ্ফল চেষ্টা করেছিল। ঘরের ভেতর অনেক আগেই পানি প্রবেশ করেছে। কেউ পানি সেচে কমানোর চেষ্টা করেও পানি কমাতে পারেনি। শুকনো খাবারের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উঁচুতে রাখার চেষ্টা করেছিল, যাতে খাবারের সাময়িক সঙ্কট মেটাতে পারে। সবই বিফলে গেল। অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়েই ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। মধ্যরাতে পানি বেড়ে যাবার কারণে রাতের আঁধারে অনেককে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। এ সকল বানভাসি মানুষদের চেহারায় মলিনতার ছাপ। চারদিকে রাস্তা-ঘাট পানিতে থৈ থৈ করছে। কেউ কেউ নৌকা এবং ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে। বাসার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শত চেষ্টায়ও সেগুলো রক্ষা করতে পারেনি। গবাদিপশুর আরো বেহাল অবস্থা। বন্যার ফলে চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সকল সময় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে এ সকল বানভাসি মানুষদের দিন পার করতে হচ্ছে। সিলেট এবং সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষ এভাবেই সীমাহীন দুর্ভোগে দিন পার করছে। কেউ কেউ প্লাবিত এলাকা থেকে উদ্ধার পেতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা পাঠাচ্ছেন।

বিকালে যে সকল এলাকায় হাঁটু বা কোমর সমান পানি রাতের মধ্যে বেড়ে তা গলা সমান হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে ঘরের চালায় আশ্রয় নিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক উপজেলা শহর বন্যায় প্লাবিত হবার কারণে সিলেটের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ রাস্তায় পানিতে টইটুম্বর হবার কারণে সিলেটের সাথে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সারা সুনামগঞ্জ জেলা জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তাই অনেক স্বজনরা চেষ্টা করেও বন্যা দুর্গত এলাকার লোকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। ফলে, স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। শহরের তুলনায় গ্রামের পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। বিভিন্ন উপজেলায় রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় উপদ্রুত এলাকার মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। পানি যত বাড়ছে সঙ্কটও তত বাড়ছে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বানভাসি মানুষদের। দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবন্দিদের উদ্ধার করতে নৌকার ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ পানিবন্দিদের উদ্ধারের জন্য নৌকা খুঁজছেন সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবকরা। তবে দিনভর দৌড়ঝাঁপ করে এবং বাড়তি টাকা দিয়েও সহজে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত নৌকা। ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা স্বজনেরা হতাশার পাশাপাশি তীব্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি খাদ্যগুদামও হুমকিতে রয়েছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে খাদ্য গুদাম পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।

চলতি মৌসুমে মে মাসে প্রথমবারের মতো সিলেটে বন্যা হয়। প্রথম দফা বন্যার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারো বন্যা। সীমাহীন দুর্ভোগের মাঝে আরো আতঙ্ক। অন্যদিকে, সুনামগঞ্জে এ নিয়ে তৃতীয় বারের মতো বন্যা হচ্ছে। প্রথমদফার বন্যায় সুনামগঞ্জের হাওড়ের অনেক জায়গা জুড়ে বোরো ধান তলিয়ে যায়। ফলে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বিতীয় দফা বন্যায় মৎস্যজীবীদের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। বন্যার পানিতে পুকুর, নদী, খাল-বিল একাকার হয়ে গিয়েছে। যার ফলে, চাষ করা মাছ উৎসস্থল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মাছ চাষীদের হাহাকারে পরিণত হয়েছে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা বন্ধ রয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন স্থানে কোমর সমান পানি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপদ্রুত এলাকাসমুহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অচল হয়ে গেছে সামগ্রীক জীবনযাত্রা। বন্যা হলেই পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পয়:নিষ্কাশন এবং বন্যার পানি একাকার হয়ে রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। ফলে, আমাশয়, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, জণ্ডিসের মতো রোগবালাই দেখা দেয়। ঠাণ্ডাজনিত এবং মশা মাছির উপদ্রবে ডেঙ্গু জ্বর বেড়ে যায়। একদিকে বন্যা অন্যদিকে অসুখ-বিসুখ। সব মিলিয়ে বন্যায় কবলিত মানুষজন দুর্দশায় জীবন পার করছে। বন্যা উপদ্রুত এ সকল এলাকায় ঔষধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট জরুরীভাবে সরবরাহ করা হয়েছে। তবে, তা যেন চলামান থাকে সেদিকে নজর রাখাতে হবে।

সমাজের প্রান্তিক মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। যারা দিনে আনে দিনে খায় তাদের অনেকের ঘরে চাল নেই। ফলে, অনাহারে, অর্ধাহারে তারা দিন পাড়ি দিচ্ছে। তবে, ইতোমধ্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অনেকেই কূল-কিনারা না পেয়ে এদিক সেদিক ছুটে চলেছে। আবার তাদের অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান নিয়েছে। সীমান্তবর্তী গ্রামের বিচ্ছিন্ন বাড়ীতে অনেকে অভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। বন্যায় ঘরবন্দি এ সকল মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা অতি জরুরী।

উজান থেকে নেমে আসা ঢল, টানা বর্ষণ এবং নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে অনেকেই সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বন্যা কবলিত এলাকায় শতশত গ্রাম ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেক শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে, এ সকল বানভাসি মানুষদের সাথে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকেই নৌকা বা অন্য কোথাও আশ্রয়ে আশা খুঁজছে। বন্যা অবনতির কারণে সিলেটে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি প্রবেশ করছে। ফলে, যেকোন সময় সারা সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে ও দুর্ঘটনা এড়াতে ইতোমধ্যে সিলেটের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সিলেট বিভাগ কার্যত সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বলা যায়।

ইতোমধ্যে বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা, নিজস্ব নৌকা দিয়ে পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার, বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্তদের নিয়ে আসা, চিকিৎসা সহায়তা, সীমিত পরিসরে খাদ্য সামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করছেন তারা। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ যে যেভাবে পারেন সাহায্যের জন্য ছুটে চলেছেন।

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বানভাসি মানুষদের কষ্ট, দুর্দশা বাড়তেই থাকবে। তবে, এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক মেরামত, ক্ষতিগ্রস্থ বাসাবাড়ির তালিকা প্রণয়ন এবং নগরীকে বন্যামুক্ত রাখতে করণীয় নির্ধারণে একটি উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন, সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণ, তালিকা প্রণয়ন ও করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। এ কমিটির যৌথ প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। (দৈনিক জনকন্ঠ, ২৪ মে, ২০২২)

সিলেট আবহাওয়া অফিস থেকে জানা যায়, পুরো জুন মাস জুড়ে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। গত তিন দিনে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ওই বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সব কটি জেলায় প্রবেশ করেছে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস বলছে, আগামী তিন দিন উজানে ভারতীয় অংশে ও বাংলাদেশ অংশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। (প্রথম আলো, ১৬ মে, ২০২২)

তাই সে হিসেবে ত্রাণ এবং আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখা জরুরী। তা না হলে, সঙ্কট আরো ঘনিভূত হবে, মানুষের দুর্দশা বাড়বে।

 

অনজন কুমার রায়
কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top