আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে পদবাণিজ্য : মাহবুবুল আলম
প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৪১
আপডেট:
১৮ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৪৩
সারাদেশেই আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে সম্মেলন চলছে। আর যে সকল জায়গায় সম্মেলন শেষ হয়েছে প্রায় ক্ষেত্রেই পদবাণিজ্যের অভিযোগ ওঠছে। আবার কোথাও কোথাও সম্মেলন শেষ হলেও নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। তাই পদপ্রত্যাশি নেতাকর্মীরা লবিং করার জন্য ঢাকায় ছোটাছুটি করছেন। অনেকের অভিযোগ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সম্মেলন করে কমিটি ঘোষিত না হওয়ার পেছনেই নাকি পদবাণিজ্যের বিষয়টি জড়িত। আবার মফস্বলের কোনো কোনো জায়গায় দামি দামি উপঢৌকন এবং নগদ নারায়নের বিনিময়ে একই ব্যক্তি ২০/২৫ বছর সংগঠনের শীর্ষ পদটি দখল করে রেখেছে।
তৃণমূলের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে একই অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, নিউজ পোর্টাল, ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে কোথাও কোথাও সভাপতি পদে ২০ লাখ এবং সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ১৫ লাখ টাকা দাম ওঠেছে। এতে দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত, সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতাকর্মীদের মধ্য হতাশা দেখা দিয়েছে। হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশের পাশাপাশি পদ ও কমিটিবাণিজ্যকে সংগঠনের জন্য ভয়ঙ্কর মনে করছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা।
পদ বাণিজ্য দলের নেতাদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। তিনি বলেন, এখানে কোনো বিনিয়োগ লাগে না। দল একটানা ১২ বছর ক্ষমতায় আছে। দেখা যাবে, অনেকে ব্যবসা করতে গিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়েছেন। আবার কেউ কেউ শেখ হাসিনার দেওয়া পদ-পদবি পেয়ে কমিটি করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। তবে দলীয় পদে যখন কোনো হাইব্রিড নেতাকে বসানো হয়, তা নিয়ে তখন সমালোচনা ওঠে। এসব সমালোচনায় বেশি মুখর হন যারা ধারাবাহিকভাবে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সংগঠন করে আসেন। তবে নিকট অতীতে ছাত্রলীগেও অনুপ্রবেশের অনেক অভিযোগ এসেছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর বেতাগী সদর ইউনিয়নের আয়োজিত ত্রি- বার্ষিক সম্মেলনে বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বেতাগী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম পিন্টু বিশেষ অতিথির বক্তব্যটি ‘টক অব দ্যা টাউনে’ পরিণত হয়েছে। সম্মেলন শেষ হওয়ার তিনদিন পর ১৪ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এখন ভাইরাল। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে ভিডিও বক্তব্যে আ.লীগ নেতা আমিরুল ইসলাম পিন্টু অভিযোগ করেন, বিএনপির কালচার এখন আওয়ামী লীগে ঢুকেছে। শুধুমাত্র উপজেলার ৮টি ইউনিটের ৭২ টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ৭২ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়েছে।কমিটিতে পদ পাইয়ে দেওয়ার নামে টাকার বাণিজ্য করেছেন উপজেলার অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।
তিনি বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে তৃণমূলে সঠিক নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায় সম্মেলন করা হয়।নেতা তৈরি করা হয়। কিন্তু এই সুযোগে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা কমিটিতে পদ পাইয়ে দেওয়ার নামে ৭২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিএনপির আমলনামা নিয়ে সমালোচনা করে এসেছি। আজ কেন আওয়ামী লীগ টাকার কাছে বিক্রি হবে? কেনো বিএনপির কালচার আমাদের মধ্যে আসবে?’ মো. আমিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন,‘একটি ওয়ার্ডের রাজনীতে করে একজন নেতা কি পায়? সেখানে যদি তার পদ পেতেই লাখ টাকা গুনতে হয়। আমার বক্তব্যে আমি যা বলার বলে দিয়েছি, আমি প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না। এখন যদি সৎ সাহস থাকে তাহলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। আমি প্রমাণ দিয়ে সহায়তা করব।’ (দৈনিক যুগান্তর)
আওয়ামী লীগের নেতারা হাইব্রিডের চেয়ে অনুপ্রবেশকে বেশি ভয়ঙ্কর মনে করছেন। কারণ অনুপ্রবেশকারীরা নিজেদের আদর্শের কৌশলী জাল বিস্তারের জন্য দলে প্রবেশ করে। নিজেদের মৌলিক উদ্দেশ্য গোপন রেখে অন্য একটি দলে প্রবেশ করে দলের তথ্য সংগ্রহ করে অথবা দলের রাজনীতি নিজেদের আদর্শিক পন্থায় প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তারাই অনুপ্রবেশকারী।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে কিছুদিন পরপরই ‘হাইব্রিড’, ‘অনুপ্রবেশ’ বিতর্ক ওঠে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে কাউয়া ঢুকেছে।’ ‘পোল্ট্রি ফার্ম’, ‘হাইব্রিড’, ‘ভাই লীগ’- এসব নামও আওয়ামী লীগ নেতাদের দেওয়া। দলটিতে পদ বাণিজ্য আর মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ অহরহ। রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের উত্তরসূরিরাও জায়গা পাচ্ছে দলে। ঢাকাসহ বেশ কিছু জেলায় ‘হটাও কাউয়া লীগ, বাঁচাও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ’ পোস্টার লাগিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। ভুঁইফোঁড় সব লীগ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতিও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন কয়েকবার।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, অনুপ্রবেশকারীরা কিছু নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দলে জায়গা করে নেয়। রিজেন্টের সাহেদ, পাপিয়া কিংবা জিকে শামীমদের মতো চরিত্রের উন্মোচন হলেই আওয়ামী লীগে হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশের বিষয়গুলো বেশি আলোচিত হয়। এক-এগারো পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই শুরু হয়েছিল সুবিধাভোগীদের অনুপ্রবেশ। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর অনুপ্রবেশের মাত্রা বিস্ময়করভাবে বেড়ে গিয়েছিল এবং সেই থেকে কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখে প্রায় লাগামহীনভাবেই সারা দেশে বাড়তে থাকে ‘হাইব্রিড’ আওয়ামী লীগারদের সংখ্যা। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপিদের হাত ধরেই ভিন্ন মতের লোকজন আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। এ সময়ে অন্তত ১১ হাজার ভিন্ন মতের নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে ঢুকেছে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিভিন্ন সংস্থা ও দলীয়ভাবে পাঁচ হাজার অনুপ্রবেশকারীর একটি তালিকাও হয়। এর মধ্যে দেড় হাজারকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতা বিরোধিতাসহ আরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘পদ বাণিজ্য হয় না’- এটা বলব না। আবার ‘পদ বাণিজ্য হচ্ছে’- এটাও বলা যায় না। আমাদের নেত্রী তৃণমূল পর্যায়ে একটি সুন্দর, ত্যাগী, গ্রহণযোগ্য ও দুঃসময়ের নেতাদের নিয়ে কমিটি ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব হচ্ছে তৃণমূলকে সেভাবে সাজানো। এক্ষেত্রে যদি কেউ পদ বাণিজ্য করে আমি মনে করি সে কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়ে না।’ (দৈনিক মানবকন্ঠ)
লেখার কলেবর না বাড়িয়ে এই কথা বলেই শেষ করতে চাই, বঙ্গবন্ধুর আমল তারও অনেক পরে দলের সম্মেলনে নেতারা আসলে সংগঠন অথবা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে আসতেন, রাত যাপন করতে নেতাকর্মীদের বাড়িতে। আর এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্মলনে আনতে কোথাও কোথাও বিমানভাড়া দিতে হয় এবং পাঁচ তারকা হোটেল রাখতে হয়, এতে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। পদবাণিজ্য নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা যদি আওয়ামীলীগের ওপরও বর্তায় তাহলে বিএনপি আর আওয়ামিলীগে পার্থক্য রইলো কোথায়? এ বিষয়ে যদি দলের হাইকমান্ড নজর না দেন এবং প্রতিকার না করেন তা একদিন দলকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
মাহবুবুল আলম
কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক
বিষয়: মাহবুবুল আলম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: