জাতীয় পতাকা শুধুমাত্র একখন্ড বস্ত্র বিশেষ নয় : নজরুল ইসলাম
প্রকাশিত:
১৬ নভেম্বর ২০২২ ০২:৪০
আপডেট:
৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১৬
বাংলা ‘পতাকা’ একটি সংস্কৃতজাত শব্দ। ‘পত্’ ধাতু থেকে এর উৎপত্তি। যথা:√ √ /পত্ + আক + আ = পতাকা। এটি স্ত্রী-বাচক শব্দ। পত্ অর্থ ধাবিত হওয়া, উড্ডীন হওয়া ইত্যাদি। ধ্বন্যাত্মক সম্পর্কও রয়েছে; কারণ পতাকা বাতাসে উড়লে ‘পত্ পত্’ শব্দ হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩০ অব্দে পারস্যে এক ধরনের পতাকার প্রচলন ছিল। ১৩ শতকে ডেনমার্কে রাষ্ট্রীয় পতাকার প্রচলন ঘটে (কড়বৎহবৎ, ২০০৩)।
পতাকা নিয়ে কথার সূত্রপাত করছি এজন্য যে, কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের গ্রাম-শহরের অলিগলি ঢেকে যাবে বিদেশি পতাকায়। বিশ্বের অনেক দেশের পতাকার রঙে রঙিন হবে ভবনগুলো। আগামী ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ, ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২! যা চলবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবারের আসরের আয়োজক মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র কাতার। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা।
পতাকা উত্তোলনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে অনেক পুরোনো। আমি নিজেও একসময় এই স্রোতে গা ভাসানো একজন ছিলাম। সমাজ বিষয়টিকে আইনের দিক থেকে না দেখে আবেগের দিক থেকে দেখতেই অভ্যস্ত। তবে এই কথাটা চিরন্তন, ‘পরিবর্তন ছাড়া সব কিছুই অস্থায়ী’। আমাদের বোধহয় এখন সময় এসেছে, এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার।
আমরা ভিন্ন দেশের কোন একটা বিশেষ কৃতিত্বকে সমর্থন করতেই পারি। হতে পারে সেটা শিক্ষা, গবেষণা, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা, সঙ্গীত বা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে। এখন আমরা যদি সেই দেশকে আমাদের সমর্থন জানাতে চাই, তাহলে কি আমাদের সেই দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে?
বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করে বলি— আমরা অনেকেই ভারতীয় বা ইরানি ছবি পছন্দ করি। এখন অস্কার বা কান চলচ্চিত্র উৎসবের সময় আমরা যদি ভারত বা ইরানের ছবির সমর্থনে তাঁদের দেশের পতাকা উত্তোলন শুরু করি, তাহলে বিষয়টা কেমন হবে!
বিদেশি পতাকা উত্তোলন নিয়ে সমালোচনা চলছে অনেকদিন ধরে। হয়ত সেকারনেই, অনেক বিবেচনার পর, ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় নতুন কিছু করতে পেরেছিলাম— বিদেশি পতাকা উত্তোলনের সময় এর শীর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা (ছোট করে) সংযুক্ত করা! কোন আইন বা নিজস্ব বিবেক-বিবেচনা প্রয়োগ করে আমরা এটা করেছিলাম, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে বিষয়টা আমারা সবাই উপেক্ষা করে গিয়েছি, নিছক আমাদের আবেগের সাথে সম্পর্কিত বলে।
প্রত্যেক দেশেই জাতীয় পতাকা ব্যবহার করার কিছু বিধি ও আইন থাকে, আমাদের দেশেও আছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে, ১৯৭২ সালে পতাকা আইন করা হয়েছিল। ২০১০ সালের মে মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক এই আইন সংশোধন করা হয়। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক একটি স্মারক প্রতিস্থাপিত হয়, যার মূল পর্যবেক্ষণ ছিল নাগরিকদের অজ্ঞতার কারণে জাতীয় পতাকার অবমাননা। নিজ দেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার ও সংরক্ষণের আইন যেমন আছে, অন্য একটি দেশের পতাকা নিজ দেশে ব্যবহারের আইন নিশ্চয়ই আছে।
বাংলাদেশ পতাকা বিধিমালা ১৯৭২ এর বিধি ৯(৪)-এ দেশের অভ্যন্তরে কোনো ভবনে বা যানবাহনে কোনো বিদেশি পতাকা উত্তোলন করা যাবে না মর্মে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি ক‚টনৈতিক মিশনসমূহ ছাড়া অন্য কোনো স্থানে অন্য রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। আসলে বিধিমালায় থাকা অনেক বিধির মতো এই আইনকেও আমরা আগে তেমন একটা গুরুত্ব দেইনি।
জাতীয় পতাকা যে দেশেরই হোক, তার নিজস্ব মর্যাদা আছে। বিশ্বকাপ ফুটবল শেষে এই বিদেশি পতাকাগুলোর ভাগ্যে কি হয়, তা কি আমাদের জানা আছে? দেখা যায়, বছর পার হবার পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় পতাকাগুলো জীর্ণশীর্ণভাবে ঝুলে আছে। অনেক গ্রামাঞ্চলে, বিশ্বকাপ ফুটবল শেষে বিদেশি জাতীয় পতাকা অনেকে দৃষ্টিকটুভাবে ব্যবহার করে। আর আমরা যেভাবে এখন বিদেশি পতাকা উত্তোলনের সময় এর শীর্ষে আমাদের জাতীয় পতাকা সংযুক্ত করছি, আমরা কি নিশ্চিত যে বিদেশি পতাকার সাথে আমাদের জাতীয় পতাকার কোন অবমাননা হবে না?
ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ সময়কালে পতাকা আইন লঙ্ঘণ করে যত্রতত্র বিদেশি পতাকা উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল মহামান্য হাইকোর্ট। আর যত্রতত্র পতাকা উত্তোলন করার বিষয়টা শুধু আইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা আমাদের বিবেক-বিবেচনার সাথেও সম্পর্কিত। আর সবকথা আইনেই লেখা থাকতে হবে, তা কেন!
দীর্ঘদিন কোনো অসঙ্গতি চলে আসলেই তা সঠিক হয়ে যায় না। আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনেক অসঙ্গতি আমরা নিজেরাই সংশোধন করেছি; প্রয়োজন একটু উপলব্ধি এবং সচেতনতার। খেলাধুলায় সমর্থন-সমর্থক সবসময় ছিল, থাকবে। কিন্তু, বিশ্বকাপে একটি নির্দিষ্ট ফুটবল দলকে সমর্থন করতে তাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ছাড়া আমাদের কি আর কোন বিকল্প নেই?
এটা ঠিক যে বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের আবেগের জায়গা। কিন্তু, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা দলকে সমর্থন করতে গিয়ে তাঁদের জাতীয় পতাকা অবমাননা করলে তা সমর্থকসুলভ আচরণ হবে না। তথাপি ধরে নিচ্ছি, অনেকেই তীব্র আবেগ বা অসচেতনতা থেকে এবারও বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় বিদেশি পতাকা উত্তোলন করবেন। সেক্ষেত্রে অন্তত এটুকু প্রত্যাশা করা যেতে পারে— আমরা যদি বিশ্বকাপ ফুটবল শেষে বিদেশি পতাকাগুলো যথাসময়ে খুলে যতœসহকারে সংরক্ষণ করি, তাহলেই বরং আমাদের সমর্থনকৃত দলকে সম্মান জানানো হবে। দেশও পরিচ্ছন্ন থাকবে।
এই দেশ যেহেতু আমাদের সকলের, এর পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। আমাদের হয়ত মনে থাকবে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ শেষে জাপান ফুটবল দল হোটেল থেকে বেরুনোর আগে, তাঁদের ড্রেসিংরুম নিজেরাই পরিচ্ছন্ন করে রেখে এসেছিলেন। এমনকি তাঁদের দেশের সমর্থকরাও দল হারার পর স্টেডিয়াম থেকে বেরুনোর আগে গ্যালারি পরিস্কার করেছিলেন।
জাতীয় পতাকা শুধুমাত্র একখন্ড বস্ত্র বিশেষ নয়, যা সচরাচর চারকোণা একটুকরো সাদা বা রঙীন কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়। জাতীয় পতাকা রাষ্ট্র ও জাতি হিসেবে একটি দেশের স্বকীয়তার প্রতীক। এর সাথে জড়িয়ে থাকে একটি জাতির ভালোবাসা, ইতিহাস আর ত্যাগের গল্প।
পতাকা যে দেশেরই হোক তার কথা বলতে গেলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অসাধারণ পঙক্তিটিই আমাদের হৃদয়ে বাজে, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’।
নজরুল ইসলাম: লেখক ও এমফিল গবেষক (শিক্ষা), স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল [email protected] ও ফেসবুক @nazrul.russell
নজরুল ইসলাম
লেখক ও এমফলি গবষেক (শিক্ষা), স্কুল অব এডুকশেন, বাংলাদশে উন্মুক্ত বিশ্ববদ্যিালয়
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: