সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক খাত ও রিজার্ভ নিয়ে পরিকল্পিত গুজব নির্বিকার সরকার ও সরকারি দল : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
২৪ নভেম্বর ২০২২ ০৪:৩৯

আপডেট:
২৪ নভেম্বর ২০২২ ০৪:৪২

ছবিঃ  মাহবুবুল আলম


আগামী নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ যেন কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসতে না পারে সে জন্য একদম আটঘাট বেঁধে নেমেছে এবার বিএনপি জামায়াতসহ আওয়ামী লীগবিরোধী সকল গোষ্ঠী। সরকারকে শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার ও গুজব রটিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনা সরকারের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামিয়ে কাবু করতে চায় অই গোষ্ঠীটি। পঁচাত্তর সালে যেভাবে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পাহাড় সমান জনপ্রিয়তাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল; একইভাবে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারকেও মিথ্যাচার, গুজব ও অপপ্রচারের সেই গোয়েবলশীয় কায়দায় সরকারের সকল অর্জন ও সুনামকে ম্লান করে দিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।
সরকারবিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে ঘরে-বাইরে সরকারকে একা করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে দেশের ভেতরে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে জনসমাশের মাধ্যমে মিথ্যাচারের চুঙা ফুঁকিয়ে
সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে, অপরদিকে, প্রতিদিনই রুটিন করে সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ধর্না দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা নির্বাচন শিষ্টাচার বহির্ভূত কথা-বার্তা বলে যাচ্ছে। এপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিকে পররাষ্ট্র দপ্তরে তলব করে ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১তম অনুচ্ছেদের প্রথম অধ্যায়ে কূটনীতিকদের গ্রহণকারী রাষ্ট্রের আইন ও প্রবিধানকে সম্মান করার জন্য স্মরণ করিয়ে দেয় তাছাড়া খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকসহ বেশ ক'জন মন্ত্রী কুটনীতিবিদদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থাকতে বলা হয়েছে।
বিএনপি জামায়াত ও সরকার বিরোধীরা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে অতিরঞ্জিত করে সাধারণত মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। যদিও দব্যমূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের একা সমস্যা নয়, এটা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে উন্নতবিশ্বের অনেক দেশেরই নাকাল অবস্থা। বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে প্রধানত বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পাশাপাশি কভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই সবচেয়ে বেশি দায়ী।
আইএমএফ বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভের বিতর্কটা নেট এবং গ্রস নিয়ে, সেটা তো সমাধান হয়ে গেছে। বিভিন্ন খাতে রিজার্ভের যে আট বিলিয়ন ডলার আছে সেটা নেট রিজার্ভে এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক আর দেখাচ্ছে না।'
শুধু আমাদের দেশ নয়, করোনা অতিমারি বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তচনচ করে দিয়ে গেছে। তার অভিঘাত সামাল না দিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে ধ্বংসিয়ে দিয়েছে, যার ফলে আমাজন গুগল, টুইটারসহ বিশ্বের নামীদামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও লোকবল ছাটাই করছে। বিশ্বের ৯৫% দেশে যেহেতু রিজার্ভে টান পড়েছে, কাজেই বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

আমরা অনেকেই জানি যে, কোনো দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমপরিমাণ ডলার রিজার্ভে থাকলেই সেটাকে স্ট্যান্ডার্ন্ড ধরা হয়। বাংলাদেশের হাতে এখন যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে বাংলাদেশ চারমাসের বেশি আছে আমদানি ব্যয় মিটাতে পারবে। আর রিজার্ভ যে রকম খরচ হয় সেভাবে আসেও। তাছাড়া রিজার্ভ কোনো স্থির জমা নয়, রিজার্ভ যে কোনো সময় বাড়তে পারে আবার কমতেও পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে তারল্যের (ক্যাশ টাকা) কোনো সংকট নেই বলে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের পরও ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এর ফলে আমানত তুলে নেওয়া উচিত বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে আতঙ্কিত হয়ে ইতোমধ্যে অনেকে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা তুলে নিচ্ছে। আর একাজটি সচেতনভাবেই করছে, বিএনপি জামায়াত এবং গুজব সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী। তাদের অনেকেই আবার তাদের ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত টাকার অধিক চেক ইস্যু করে চেক ডিজঅনার করিয়ে এনে বলছে দেখুন ব্যাংক আমাকে টাকা দিতে পারে নাই।
হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে গুজব ছড়িয়েছে ব্যাংকে টাকা নেই। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হতে যাচ্ছে। তাই গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা তোলার জন্য হুড়াহুড়ি লেগেছে বলেও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দেশের বাইরে অবস্থান করে কিছু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অপপ্রচার চালাচ্ছেন। দেশের ভেতরেও কিছু মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এসব ব্যক্তি আগেও বাংলাদেশ নিয়ে, সরকারকে নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা খবর ছড়িয়েছে। এমনই একটি একটা ঘটনা কথা জনতে পারলাম বন্ধু সাঈদ ভুঁইয়ার স্ট্যাটাস থেকে। সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হলো-
"লোকটার একাউন্টে ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আর সোনালি ব্যাংকে চেক দিয়েছে দুইলাখ টাকার। টাকা না পাইয়া ফেসবুকে আবার স্ট্যাটাস‌ও দিয়েছে তারপর! তারপর আর কী,যা হবার তাই হচ্ছে, টের পাচ্ছে ,কত ধানে কত চাল! অসুবিধা নাই, গুজব ছড়ান,আর বসে বসে কত ধানে কত চাল হয়, তার হিসাব করেন।"
বন্ধু মুজিব রহমানের ওয়াল থেকে এসংক্রান্ত আরও একটি স্টাটাসের অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা ধরছি-
"হঠাৎ করেই মানুষ হাতে টাকা রাখছে কিছু গুজবের কারণে। এখন ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে জনগণের হাতে রয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিবার পিছু প্রায় ৬৫ হাজার টাকা করে রয়েছে যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই। এর অর্ধেকটা থাকতে পারতো। গুজবে বিশ্বাসী মানুষ টাকা তুলতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে কিছুটা চাপে ফেলছে। কিছু ব্যাংক আমানত ও ঋণের মার্জিন ঠিক রাখতে পারবে না। অতি সাম্প্রতিক সময়ে হয়তো পরিবার পিছু নগদ টাকার পরিমাণ আরো বেড়েছে।"
সরকার বিদেশগামীদের ডলার দিতে পারছে না বলেও গুজব ছড়াচ্ছে। এতেও আতঙ্কিত হয়ে মানুষ ডলারের জন্য ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছে; ফলে ব্যাংকগুলোতেও চাপ বাড়ছে। গুজবের পাশাপাশি কিছু পত্রিকাও ব্যাংকে ডলার নেই শিরোনামে রিপোর্ট করে গুজবকে আরও উসকে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোন ঘটনার কথা কেউ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকব্যবস্থায় বর্তমানে এক লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। ব্যাংক খাতে নগদ অর্থের সংকট বা তারল্য সংকট নেই।’
শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হওয়ার পর একই গোষ্ঠী গুজব ছড়িয়েছিল যে, বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যাবে। কিন্তু এতদিন গুজব ছড়িয়েও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হয়নি দেখে সুযোগসন্ধানীরা এখন ব্যাংক নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বসে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি অর্থনীতি নিয়ে কল্পিত সব তথ্য ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। দেশে বসে অনেকেই সেই গুজবে ইন্দন দিচ্ছে। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা সেই সব গুজবের তথ্য বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
লোকজন মনে করেছে, না জানি কী হয়ে গেছে। অলরেডি আইএমএফ আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক নতুন ঋণ দিচ্ছে না। এমনিতেই এই কয়টি ঘটনায় আস্থায় কিছুটা চিড় ধরেছে। লোকজন টাকা তুলে ফেলেছে। কেউ কেউ হয়তো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে একটা মহল বিপুলভাবেই গুজবটি ছড়াচ্ছে যে, ব্যাংক গ্রাহককে টাকা ফেরত দিতে পারবে না। হুজুগে পড়ে মানুষ টাকা তুলে নিচ্ছে। এই তুলে নেয়াটাই সমস্যা তৈরি করছে। এমন হুজুগ থামাতে যতটা প্রচার প্রচারণা চালানো দরকার। সরকারের লোকদেরও এ ব্যাপার নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে আমার মনে হয় এব্যাপারে সরকার ও সরকারদলকে জোরালোভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে।

 

মাহবুবুল আলম
কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top