সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

স্কুল পালিয়ে কি রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় ? : সাইফুর রহমান


প্রকাশিত:
২ মে ২০১৯ ২০:৩১

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২০:৫৬

সাইফুর রহমান

 

১৮৭০ সালের ভাদ্র মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা তাদের শুভার্থী দাতাদের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করেন। সেই ছাপা নামের তালিকায় দেখা যায়, জনৈক দাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। দাতা এই ব্যক্তিটি দান করেছেন দু’টাকা ১২ আনা ৩ পয়সা। প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলতে হয়, এই দাতাটি কোনো পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি নন। ইনি সাড়ে ১২ বছর বয়সের একটি বালক মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তাকে নিয়ে ডালহাউসি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন, কিছুদিন পর তিনি রবীন্দ্রনাথকে ফেরত পাঠিয়ে নিজে রয়ে গেলেন সেখানে।

হাতখরচ বাবদ ছেলের হাতে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে তিনি দান করেছিলেন তত্ত্ববোধিনী ফান্ডে। ঘটনাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, সেই প্রথম ছাপার অক্ষরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম দেখা যায়। তিনি তার নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখার জন্যই যে এ কাজটি করেছিলেন সেটি বোঝা যায় এ কারণে যে- ব্রাহ্ম সমাজে ছাপাখানায় টাইপ খুঁজে খুঁজে নিজের নাম সাজিয়ে তাতে কালি মেখে কাগজের ওপর ছাপ দিয়ে দেখতে তার ভালো লাগত। এ ঘটনার উল্লেখ আছে, তার জীবন স্মৃতিতে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা যখন ছাপা হয় তখন তার নিচে অবশ্য কবির নাম ছিল না। সে সময়ে নামহীন রচনা প্রকাশেরই রীতি ছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে? যে মানুষটি ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে এতটা উতলা হয়ে উঠেছিলেন সেই কাঁচা বয়সেই। সচেতন বা অচেতন মনে হতে চেয়েছিলেন বিখ্যাত। সেই বালকটি কেন মন বসাতে পারলেন না স্কুলে। সম্ভবত এর একটি চমৎকার উত্তর আমরা খুঁজে পাই বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক গ্রাহাম গ্রিনের উক্তিতে, তিনি বলেছেন- অবসেশন বা আচ্ছন্ন-মগ্নতা না থাকলে সৃষ্টিশীল মানুষ হওয়া যায় না। ছোটবেলা থেকেই যেসব মানুষ পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনের প্রত্যেকটি ব্যাপারেই বড় বেশি সজাগ সাবধানী ও গোছাল তাদের জীবনে বড়জোর পর্যাপ্ত অর্থপ্রাপ্তি ঘটে।

কিংবা তথাকথিত সাকশেসফুলও হন। কিন্তু তাদের হাতে সহসা কালজয়ী সাহিত্যকর্ম কিংবা মহৎ কোনো শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় না। তাদের মধ্যে কিছু জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে- আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, হারমান হেসে, কাফকা, পাবলো পিকাসো, সালভাদর ডালি কিংবা ভ্যান গগ প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ শুধু তার পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না- যিনি স্কুল পালিয়েছিলেন। ওই ঠাকুর বাড়িতেই স্কুল পালানো ছেলে পাওয়া যায় আরও দুজন। তাদের মধ্যে একজন রবিঠাকুরের আপন বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর অন্যজন রবিঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথ বড় হয়ে যিনি গোটা ভারতবর্ষের চিত্রকলার জগতে বইয়ে দেন বড় রকমের পরিবর্তনের ঝড়। সেই অবনীন্দ্রনাথও কিন্তু আসলে এক স্কুল পালানো ছেলে। কাকা আর ভাইপোর মধ্যে দারুণ মিল এই এক জায়গায়। অন্যদিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি চিরকালই কোলাহল এড়িয়ে একলা থাকার মানুষ এবং মানুষটি গুণেও অদ্বিতীয় অথচ তারও মন ছিল না স্কুলে পড়া।

বাংলা সাহিত্যে নিদেনপক্ষে এ রকম প্রায় আধা ডজনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। তাদের মধ্যে একজন বাংলা ভাষার প্রথম লিরিক্যাল অর্থাৎ ছন্দের কবি, কবি বিহারী লাল চক্রবর্তী। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জসীমউদ্দীন। বিহারী লাল জন্মে ছিলেন ১৮৩৫ সালে। রবীন্দ্রনাথ থেকে ২৬ বছর আগে। আর বিহারী লালের জন্মে ২৪ বছর আগে জন্মে ছিলেন আরেক কবি যিনি ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় আমাদের সাহিত্যে একাই তৈরি করে দিয়ে গেছেন একটি নতুন যুগ। তার ওপর তিনি ছিলেন সেকালের এক নামজাদা পত্রিকার সম্পাদক নাম ‘সংবাদ প্রভাকর’, বললেই আমরা বুঝি এমন এক পত্রিকা যার জুড়ি মিলবে না কোথাও।

এ পত্রিকাতেই বাংলা সাহিত্যের দুই স্মরণীয় লেখকের কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। পরে একজন হয়ে যান ঔপন্যাসিক তিনি বঙ্কিমচন্দ্র, অন্যজন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হাতে তৈরি হয়েছিল আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জš§ নদীয়া জেলার কাঁচরাপাড়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ডাক্তার। ঈশ্বরচন্দ্র ছোটবেলা থেকেই প্রচ- ডানপিটে ধরনের। তিন বছর বয়সে মামার বাড়িতে এসেছেন কলকাতায়। এসেই অসুখ। কলকাতায় তখন মশামাছির প্রবল উপদ্রব। এসব দেখে বালক ঈশ্বর তখনই লিখে ফেললেন এই ছড়া। যা আজও সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে- রাতে মশা, দিনে মাছি/এই নিয়ে কলকাতায় আছি। মাত্র তিন বছর বয়সেই এই ছড়া?

অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনীকার হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র খোলাখুলিভাবেই বলেছেন- ‘তাই নাকি? অনেকেই কথাটা না বিশ্বাস করিতে পারেন। আমরাও বিশ্বাস করিব কি না জানি না। তবে যখন ইংরেজ দার্শনিক স্যার জন স্টুয়ার্ড মিলের তিন বছর বয়সে গ্রিক শেখার কথাটা সাহিত্য জগতে চলিয়া গিয়াছে তখন এ কথাটাও না হয় চলুক। অসুবিধা কী?’ ছেলেবেলা থেকেই পাঠশালার দিকে অমনোযোগ। রইল পড়ে স্কুলের লেখাপড়া। ব্যস্ত কেবল হো-হো টোটো খেলায়। বাড়িতে গঞ্জনার শেষ নেই। মূর্খ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের মনে কালো মেঘের মতো দুশ্চিন্তা। সন্দেহ নেই, এ ছেলের দিন কাটবে অন্যের গলগ্রহ হয়ে। কিন্তু কালক্রমে তিনি হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের জগতের এক অনন্য কবি। এবার বিহারী লালের কথা কিছু বলি- বাংলা কবিতা তখন ছিল সেজবাতি পর্যায়ে কিন্তু বাংলা সাহিত্যে কবি বিহারী লালের আবির্ভাবে সেই সেজবাতি রাতারাতি পরিণত হলো ঝাড়লণ্ঠনে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম লিরিক অর্থাৎ ছন্দ কিন্তু তার কলমেই। প্রথমে ঠাকুরবাড়ির প্রিয় কবি, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ বৌ ঠাকরুন জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরীদেবীর প্রিয় কবি। জনশ্রুতি আছে, রবীন্দ্রনাথের আগে কাদম্বরী দেবীর সঙ্গেই বিহারী লাল চক্রবর্তীর হƒদয়ঘটিত একটি ব্যাপার-স্যাপার ছিল।

কাদম্বরী দেবী বিহারী লালের জন্য নিজ হাতে একটি আসনও তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন এবং সে আসনটি উপলক্ষ করে বিহারী লাল একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিহারী লালের কবিতা দ্বারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। প্রথমে ঠাকুরবাড়ির প্রিয় কবি হলেও তারপর তিনি পাকা আসন পেয়ে গেলেন সারা দেশের মানুষের মনে। আজ পর্যন্ত সেই আসনে কিন্তু এতটুকুও ফাটল ধরেনি। বিহারী লালও স্কুল পালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। ‘বিহারী লালের লেখাপড়া সম্পর্কে বলতে হয় যে, দিন কতক সে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়ে ব্যাকরণ, মেধদূত প্রভৃতি পড়েছিলেন। কিন্তু স্কুল-কলেজের বাঁধাধরা নিয়মের বশবর্তী হয়ে থাকা তার স্বভাবের সঙ্গে মিলত না।

অল্পকালের মধ্যেই সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করে বাড়িতে প-িতের কাছে ব্যাকরণ ও অন্যান্য বিষয়ে পড়তে শুরু করল। আমরা ছোটবেলায় স্কুল কামাই করলে শিক্ষকদের মুখে এই কথাটি প্রায়ই শুনতে হতো যে, স্কুল পালিয়ে কখনো রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না। কিন্তু আমার প্রশ্ন? প্রতিনিয়ত স্কুলে উপস্থিত থেকেই কি রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায়? প্রতিদিন শতসহস্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লক্ষ-কোটি ছাত্রছাত্রী আসা-যাওয়া করছে তাদের মধ্যে ক’জন রবীন্দ্রনাথ হতে পারছেন? আসলে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যটা কী? আমাদের শিক্ষার সেই উদ্দেশ্য কী পূরণ হচ্ছে? আদৌ আমরা কী কিছু শিখছি? প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একটি উক্তি এখানে বেশ প্রণিধানযোগ্য। আমাদের মা-বাবারা তাদের সন্তানকে ছোটবেলায় দেখতে চান ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্ররূপে।

আর সেই ছেলেটি যখন পরিণত বয়সে পদার্পণ করেন তখন তাকে দেখতে চান একজন চোর হিসেবে। কারণ ভালো ছাত্ররাই তো সাধারণত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সচিব কিংবা সরকারি আমলা হয়ে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করেন। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সব মানুষ বর্তমানে সাধারণত লেখাপড়ার শুধু আর্থিক প্রাপ্তিটাই খোঁজেন। শিক্ষা লাভের মধ্যে যে বৃহৎ একটি উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে সেটি বেমালুম ভুলে যান। কাজী মোতাহের হোসেনের মতে, শিক্ষার দুটি আদর্শের মধ্যে আর্থিক কারণটিকে তিনি গৌণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হচ্ছে মনোবিকাশের পথ উš§ুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজের ক’জন ছাত্র-শিক্ষক সেটা চিন্তা করেন; কিংবা বোঝার চেষ্টা করেন। এ জন্যই এখন দেখা যাচ্ছে মানবতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা বলে সমাজে আর কিছু নেই। ফলে ১৮ বছরের এক বালিকা মাদকের পয়সার জন্য বাবা-মাসহ পুরো পরিবারকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। মূল্যবোধ বিষয়টি কী? সেটি একটু ব্যাখ্যা করছি। বিখ্যাত লেখক কাইভ বেল তার সিভিলাইজেশন নামক বইটিতে মূল্যবোধের একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন।

একজন মানুষ যদি এটি বুঝতে না পারে যে, একটি ভালো সনেট একটি ডিম ভাজার চেয়েও উৎকৃষ্ট। তাহলে বুঝতে হবে যে, তার মধ্যে মূল্যবোধের ঘাটতি আছে। পাঠকবৃন্দ বিশ্বাস করুন- এই প্রশ্নটি আমি বহু মানুষকে করেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা সনেট শুনতে রাজি নন বরং বেশিরভাগ মানুষই বরং ডিম ভাজা খাওয়াটাই বেছে নিয়েছেন। পুরনো দিনে কিংবা বর্তমানেও যেসব মানুষ স্কুলে যাননি কিংবা স্কুলে যেতে পারেননি- তারা নিজ গৃহে কিংবা জীবনে চলার পথে ভালো শিক্ষক, গুরু কিংবা সঠিক পথপ্রদর্শকের সংস্পর্শে এসে কীর্তিমান হয়েছেন। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছি ঠিকই কিন্তু স্কুলে তারা কি শিখছে আমরা একটি বারও তা তলিয়ে দেখছি না। মেয়ে কিংবা ছেলে ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হচ্ছে- এতেই আমরা খুশি হয়ে যাচ্ছি।

ফার্স্ট, সেকেন্ড বিষয়গুলো যে আপেক্ষিক সেটি আমাদের মাথাতেই আসে না। গ্রাম, অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা একটি ছেলে ঢাকার কোনো স্কুলে হয়তো প্রথম ২০-৩০ জনের মধ্যেও স্থান পাবে না। কিন্তু তারপরও সেই ছেলেটির কিন্তু বাস্তব জ্ঞান ঢাকায় বেড়ে ওঠা ছেলেটির চেয়ে অনেক বেশি। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাটুকুর প্রয়োজনই বেশি হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়ার জন্য পুরস্কার আছে। কিন্তু মানবতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জন্য কোনো পুরস্কার নেই। আর ভালো শিক্ষক পাওয়া সেটিও এখন এক দুর্লভ বস্তু। আমার জীবনে আমি শুধু একজন যথার্থ শিক্ষকের দেখা পেয়েছিলাম। যখন আমি ঢাকা কলেজে পড়ি তখন কিছুদিনের জন্য শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদকে।

তিনি নিজে একজন আলোকিত মানুষ এবং চারপাশের মানুষকেও আলোকিত হিসেবে তৈরি করার জন্য তাঁর সে কী প্রাণান্তকর প্রয়াস। এই যে আমরা যখন কোনো লেখকের জীবনী পড়ি- যেমন জে এইচ ওয়েলস, জ্যাক লন্ডন, হারপার লি, উইলিয়াম ফকনার, ম্যাক্সিম গোর্কি, মার্ক টোয়েন প্রমুখ ব্যক্তি স্কুল পালিয়ে বিখ্যাত সব লেখক হয়েছেন। মার্ক টোয়েনের সাদামাঠা জীবনী পড়লে দেখা যাবে যে, ছোটবেলায় এহেন কোনো কুকর্ম নেই যে, তিনি করেননি। ছিনতাই, চুরি ইত্যাদি। কিন্তু এর গভীরে যে জীবনটি জানতে হবে যে, তারা স্কুলের আঙিনা না মাড়ালেও নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। একটি উদাহরণ দিই- শরৎচন্দ্র একবার তার এক আত্মীয় লীলা রানী গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘১৪ বছর ১৪ ঘণ্টা ধরে পড়ি। সেই যে কলেজ জীবনে পরীক্ষা দিতে পারিনি কেবল সেই রাগে।’ উইনিস্টেন চার্চিল ছোটবেলায় একবারে গোমূর্খ ছাত্র ছিলেন বলে তার বাবা তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। চার্চিল ছোটবেলায় ভালো করে লেখাপড়া করতে পারেননি বলে সেই রাগে পরবর্তী জীবনে এতটাই পড়াশোনা করেছিলেন যে, সাহিত্যে তিনি একেবারে নোবেল অর্জন করে ছেড়েছিলেন। অনেকে আবার আর্থিক কারণে পড়তে পারেন না।

যেমন কাজী নজরুল ইসলাম ও চার্লস ডিকেন্স। নজরুল যেমন রুটির দোকানে কাজ করতেন ডিকেন্স তেমনি বোতলে লেবেল আঁটানোর কাজ করতেন। কিন্তু এসবের মধ্যেও পাঠ্যাভ্যাস কিন্তু থেমে থাকেনি। কবি জসীমউদ্্দীন নবম শ্রেণিতে উঠে স্কুল পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। জীবনে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন সে আশায়। কিন্তু কিছুকাল ভবঘুরের মতো ঘোরাঘুরি করে আবার ফরিদপুরে এসে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। অনেকটা ইংরেজ কবি বায়রনের মতো। বায়রনের স্কুল ভালো লাগে না বলে পালিয়ে চলে এলেন বাড়িতে। বছর পাঁচেক পরে আবার গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ক্যামব্রিজে। আমাদের বর্তমানে এই সময়ে যেমন রবীন্দ্রনাথের স্কুল পালানো বেশ একটি প্রচলিত বিষয়। বায়রন-পরবর্তী ছাত্রদের কাছেও বায়রনের স্কুল পালানোটাই একটা বিশেষ প্রচলিত বিষয় ছিল। আর সেই প্রচলিত গল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুল পালিয়েছিলেন আরেক নোবেল জয়ী আইরিশ লেখক জর্জ বার্নাড শ। আমি যতটুকু তার সম্পর্কে পড়েছি তাতে বলতে পারি, স্কুল পালানো সব বিখ্যাত মানুষের মধ্যে বোধকরি তিনি ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও স্কুল সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। স্কুল সম্পর্কে তার ধারণা ছিল ভয়াবহ। জীবনজুড়েই তিনি স্কুল ও শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করে গেছেন। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘বর্তমানে আমাদের স্কুল ও স্কুলের শিক্ষক উভয়ই শিক্ষার জন্য উপযুক্ত কোনো স্থান নয়। বরং এগুলো গারদখানা কিংবা ট্রাংক অর্থাৎ লোহার বাক্স বলাই শ্রেয়। কারণ বাবা-মায়েরা সাধারণত তাদের ছেলেমেয়েদের ওখানে পাঠান যাতে শিশুগুলো তাদের সহসাই বিরক্ত না করে।’ সত্যি খুবই মর্মভেদী উক্তি তবে শেষ কথা হলো ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে আর হয়তো সেটাই কাম্য। কিন্তু তারা কী শিখছে আমাদের সবাইকে সেটিই সব সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।

 

সাইফুর রহমান
গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top