‘ছিঁছোড়ে’ বলিউডের আরেকটি পপকর্ন সিনেমা নয় : রাম কৃষ্ণ সাহা
প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০২০ ২০:৪৩
আপডেট:
৩০ জুন ২০২০ ২১:০৩

বলিউড নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে প্রতিনিয়ত। বিতর্কের উৎসে থাকে ইন্ডাস্ট্রির স্বজনপ্রীতি, সেকেলেপনা/ নতুন ভাবনা-চিন্তার অভাব, মিথ্যা গ্ল্যামার প্রদর্শন, তারকা বান্ধব অভিরুচি, বাজারীকরণ, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে প্রণোদিত করা, নারী চরিত্রের যথাযথ মূল্যায়ন না করা ইত্যাদি। কিন্তু এতসব সমালোচনার পরেও বলিউড বিশ্বের বৃহৎ তিনটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির একটি। হতাশাজনক হলেও বাস্তবতা এমন যে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে বলিউডের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। সিনেমার মধ্যে চার থেকে পাঁচটা গান এবং সিনেমা চলাকালীন সময়ে ইন্টারভেল/বিরতির ব্যবস্থা করা বলিউডের একান্ত উদ্ভাবন। স্বার্থ সংরক্ষনে বলিউড নিজেদের মত করে চলচ্চিত্রের ভাষা বা কাঠামো তৈরী করে নিয়েছে যেখানে চলচ্চিত্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বছরব্যাপী কয়েক শতাধিক সিনেমা মুক্তি পেলেও মানসম্মত সিনেমা হয় কয়েকটামাত্র। এখানে ‘মানসম্মত সিনেমা’ প্রপঞ্চটি ব্যবহার করছি দর্শক ও সমালোচক উভয় দলের মতামত/পর্যালোচনার ভিত্তিতে - মানসম্মত সিনেমার সমকালীন মাধুর্য্য/টান থাকে, যা নির্দিষ্ট বাজার ছাড়াও যেকোন ভাষার, যেকোন দেশের দর্শক সেই সিনেমার সাথে একাত্ম হতে পারে।
মানসম্মত সিনেমার প্রধান লক্ষণ হলো সমাজের প্রতি তার দায় স্বীকার। সিনেমা যখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে না খেঁটে বৃহত্তর বোধদয়ের উৎস হয় তখন তাকে মানসম্মত বলা চলে। তবে সিনেমার মান বিচার কার্যে এই একটিমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি পর্যাপ্ত নয়। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি আর ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা এই দুই সিনেমার বিশ্লেষণ যেমন একই পাল্লায় করা দুষ্কর তেমনি এই দুই পরিচালকের পর্যালোচনাও একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করা অসমীচীন। মোদ্দাকথা হলো প্রত্যেকের সমাজভাবনা একই রকম নাও হতে পারে। ভাবনায় সমাজের প্রতি দায় স্বীকার আছে কিনা না খতিয়ে দেখাই চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রধান দায়।
এপর্যায়ে, নিতেশ তিয়ারী নির্মিত ছিঁছোড়ে সিনেমার পাঠ-পর্যালোচনা হাজির করবো। বলিউড থেকে ২০১৯ সালের গুটিকয়েক মানসম্মত সিনেমার মধ্যে ছিছোরে অন্যতম। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন সিনেমা পাঠের সময় একটা মানসম্মত সিনেমাই বেছে নিলাম। কারণটা হলো, মানসম্মত সিনেমা অনুধাবনই চলচ্চিত্র পাঠের প্রধান অভিপ্রায়। আর সিনেমাটি সত্যিকার অর্থেই মানসম্মত কিনা তার স্বপক্ষে যথাযথ যুক্তি উপস্থাপনের প্রয়াস চালাবো। সিনেমাটি নির্বাচনের পেছনে আরেকটি বড় কারন হলো এর সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা। তবে, এ প্রসঙ্গে কথা বলবো সিনেমা পাঠের শেষ প্রান্তে পৌঁছে।
ছিঁছোড়ে একটি মৌলিক ও সরল গল্প হাজির করেছে। একেবারে জলবৎ তরলং। পরিচালক নিতেশ তিয়ারী নিজে বম্বে আইআইটির ছাত্র ছিলেন। তাই কলেজ জীবনের গল্প তুলে ধরতে তিনি তাঁর কলেজ জীবনেই ফিরে গিয়েছেন। ‘ছিঁছোড়ে’, বাংলা করলে দাঁড়ায় ছ্যাঁচড়া। সেই ছেলেমেয়েদের কথা, যাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলের যাবতীয় আনন্দ-মজা-দুষ্টুমি চেটেপুটে নেয়। আবার বড় কোনও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বা অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পিছপা হয় না। তেমনই ছেলের দল আন্নি (সুশান্ত সিং রাজপুত), অ্যাসিড (নবীন পলিশেট্টি), সেক্সা (বরুণ শর্মা), মাম্মি (তুষার পান্ডে), ডেরেক (তাহির রাজ ভাসিন)। এঁদের সঙ্গে আছেন মায়া (শ্রদ্ধা কাপুর)। কলেজে যেমন একটা দল থাকলে তার বিরুদ্ধেও আরেকটা দল থাকে, এছবিতেও তেমন আছে। আর সেই দলের মাথা রাগ্গি (প্রতীক বব্বর)।
এ পর্যন্ত পড়ে যদি ভাবেন, এ ছবি স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার সিরিজের আরেকটা গল্প, তাহলে সেখানেই মোচড়। কারণ, সিনেমা শুরুর দিকেই দেখা যায়, অনিরুদ্ধ ও মায়ার (সুশান্ত সিং রাজপুত ও শ্রদ্ধা কপুর) একমাত্র ছেলে রাঘব (মোহাম্মদ সামাদ) এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সফল হতে না পেরে, লজ্জা-ঘেন্নায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। প্রচন্ড সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু ডাক্তার নিরাশাভরা কন্ঠে জানায়, রাঘবের শরীরে কোনো চিকিৎসাই সাড়া দিচ্ছে না। শয্যাশায়ী ছেলেকে পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচাতে অনিরুদ্ধ তার কলেজের পুরোনো বন্ধুদের ডেকে আনে। বন্ধুরা মিলে রাঘবকে তাদের কলেজ জীবনের গল্প শোনাতে থাকে। সেই গল্পের সিড়ি বেয়ে ওঠার প্রতি মুহুর্তেই থাকে হইহুল্লোড়, বন্ধুত্ব, হাসি-বেদনা ও হোস্টেল জীবনের আরো অজস্র স্মৃতি যা কেবল রাঘবকে নয় বরং দর্শকেও উজ্জীবিত করে। চিত্রনাট্যের ছন্দ-তালে সবার মনের ভিতর বুনতে থাকবে বেঁচে থাকার আশা, বন্ধুত্ব উদযাপনের অনাবিল আনন্দ। চোখ ভিজবে মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্কের মেলবন্ধনকে ঘিরেও।
নিতেশ তিয়ারির এই ছবিতে প্রধান চরিত্রই আসলে কেউ নন। প্রত্যেকেই এক একটি ভিন্ন চরিত্র হয়ে উঠেছে যেন। সুশান্ত ও শ্রদ্ধা সাবলীল ও বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। এছাড়াও বরুন শর্মা, তুষাড় পাণ্ডে, তাহির রাজ বাসিন, শরশ কুমার শুক্লার অভিনয়ও নজর কাড়বে। শিল্পনির্দেশনা, রূপসজ্জা, শব্দ, দৃশ্যধারণ সিনেমার বক্তব্য প্রকাশে সহায়ক থেকেছে।
দ্বিতীয়ার্ধে ছবির দীর্ঘতা কিছুটা বিরক্ত লাগলেও, স্পোর্টস ইভেন্টটি শুরু হওয়ার পর পরিচালক নিতেশ তিওয়ারি ওনার স্বভাব মতই কাউকে নিশ্বাস ফেলারও সময় দেননি। তবে ছবিতে কখন ছাত্ররা পড়াশোনা করল তার খোঁজ মেলেনি যদিও। সবথেকে মনে রাখার মত বিষয়, গোটা ছবি জুড়েই পরিচালক কোনো দৃশ্যেকেই অতিরঞ্জিত করেননি। যেহেতু ওদের নিয়েই সিনেমা, তাই ওরা জিতবেই, বা এই গল্প শুনেই অসুস্থ ছেলেটি সুস্থ হয়ে গেল, এরকম ধরনের কোনো মিরাকেলও দেখাননি পরিচালক। সেই কারণেই এই ছবির গল্পের সত্যতাই যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে।
কেন ছিঁছোড়ে’ গুরুত্বপূর্ন?
ছিঁছোড়ে সমাজ বাস্তবতার নিরিখে উদার পর্যালোচনা করেছে জীব ও জীবনকে। জীবের কাছে জীবনই সর্বাধিক মূল্যবান, জীবনকে নিছক জয়-পরাজয়ের ডায়েরি ভাবাটা বোকামি, এমন সাম্যবাদী চিন্তাও সিনেমায় হরহামেশা দেখা যায় না। সমসময়ের প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন অনুষঙ্গের সিনেমাটিক রিপ্রজেন্টেশনের মাধ্যমে প্লটগুলোর পারস্পারিক সংযুক্তি ঘটেছে। যেখানে বলিউডের সিংহভাগ সিনেমাই সেকেলে সেখানে ছিছোরে আশ্চর্যজনক রূপে প্রগতিশীল। আরোপিত বা অতিরঞ্জিত জীবনবোধের জোয়ারে ডুবে সিনেমা প্রান ত্যাগ করে নি। এক একটি ঘটনাপ্রবাহের উপস্থাপন করতে গিয়ে এখানে সমাজের নানান দিকের দ্বান্দিক বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছে। যেখানে দর্শক প্রতিমুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করার অবাধ সুযোগ পাবে। দর্শক নিস্ক্রিয় না থেকে বরং সংক্রিয় অনুঘটকের ন্যায় বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি নিয়ে সমাজ বাস্তবতা নিরীক্ষণ করতে পারবে।
সুশান্ত সিং রাজপুত, জ্বলে থাকা এক তারা
বৈশ্বিক মহামারীর ফলে অন্য সবকিছুর মতো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলোও আতঙ্কে ডুবে আছে। এর মধ্যে বলিউড ইন্ডাস্ট্রির তিন তারকার অকাল প্রয়ান, মেনে নেওয়া মোটেই সরল নয়। কালজয়ী ইরফান খান, ক্ল্যাসিক ঋষি কাপুরের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই সুশান্তের বিদায়.... শোঁকে পাথর হয়ে যাচ্ছেন সিনেমাপ্রমীরা।
সর্বভারতীয় পরীক্ষায় সেভেন্থ র্যাংক করা সুশান্ত পড়েছেন দিল্লি টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। একটা নাচের ক্লাস থেকে বলিউডের শীর্ষ সারির অভিনেতা- সুশান্ত সিং রাজপুতের পথ পেরোনোর গল্প নিয়েই তৈরি হতে পারত সিনেমা। ২০০৮ সালে বালাজি টেলিফ্লিমসের ধারাবাহিক 'কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল' দিয়েই যাত্রা শুরু তাঁর। এরপরই এল একতা কাপুরের সেই 'পবিত্র রিস্তা'! প্রথম লিড রোল পেয়েই ভারতীয়দের ড্রয়িং রুমের নির্ভরযোগ্য মুখ হয়ে উঠলেন সুশান্ত। কিন্তু ধারাবাহিকে কি আর ভরে রাজপুত-মন? সুযোগ এল ২০১৩ সালে। অভিষেক কাপুরের 'কাই পো চে'-র সেই ইশান নামের দামাল ছেলেটা সেই যে ছুটতে শুরু করল, তারপর থেকে দৌড়-দৌড় আর দৌড়। 'শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স' সেরেই সুশান্ত ব্যস্ত হলেন 'পিকে'কে সামলাতে। আমির-ছটাতেও ঢাকা না পড়ে স্বমহিমায় জ্বলে উঠলেন 'সরফরাজ'। রাজপুত হলেও তাঁর মুখে বাঙালি ভাব খুঁজে পেয়েছিলেন পরিচালক দিবাকর ব্যানার্জী। 'ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সীর' জন্য সুশান্তই ছিলেন দিবাকরের একমাত্র পছন্দ। ভার্সেটালিটি বোধহয় একেই বলে... ব্যোমকেশের সঙ্গে মহেন্দ্র সিং ধোনির কি সম্পর্ক? একটাই সম্পর্ক। দুজনের চরিত্রে একমাত্র অভিনয় করেছেন সুশান্ত সিং রাজপুত। বলিউডের এমন অভিনেতা খুবই হাতেগোনা যারা মেইনস্ট্রিম ও আর্টহাউস উভয় ক্ষেত্রেই সমান অংশগ্রহণ করেছেন এবং সফল হয়েছেন।
'ছিছোড়ে’ তার শেষ ছবি। গোটা ছবিটা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে, প্রবল প্রতিকূলতাকে জয় করে কীভাবে জীবনকে উদযাপন করা যায়, তারই মন্ত্রগুপ্তি সিনেমা জুড়ে। শেষ ছবিতে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে লড়লেন আর তারই এমন প্রস্থান। হৃদয়বিদারক এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন। বারবার তার সিনেমাগুলোর দিকে ফিরে যাই। সিনেমা রয়ে গেছে, সুশান্তও তাই ফুঁড়ায় নি। সিনেমা ও সুশান্ত বেঁচে থাকবে চিরকাল।
রাম কৃষ্ণ সাহা
চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়: রাম কৃষ্ণ সাহা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: