সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


বিবি রাসেল এবং বাংলাদেশে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ ধারার বিকাশ : রাম কৃষ্ণ সাহা


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২০ ২১:০২

আপডেট:
৩০ জুন ২০২০ ২১:০৮

 

বিবি রাসেল একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি মডেল ও শীর্ষ ডিজাইনার। তিনি কাজ করেছেন বিশ্বখ্যাত সব ফ্যাশন ম্যাগাজিন এবং ব্র্যান্ডের সাথে। ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করার পরেও, তিনি মাতৃভূমি এবং মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে নিজের দেশে ফিরে এসেছিলেন। বিবি রাসেল আমাদের হস্ত এবং বস্ত্র শিল্পকে পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। 

তার জন্ম ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে। স্কুলজীবন কেটেছে রাজধানীর টিকাটুলীর কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। এখান থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে বিবি রাসেল যুক্তরাজ্যের লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনে অধ্যয়ন করার সুযোগ পান। ১৯৭৫ সালে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

মডেলিং

১৯৭৬ সাল থেকে তিনি মডেলিং শুরু করেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত একটানা ১৬ বছর ছিলেন হারপারস বাজার এবং কসমোপলিটনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মডেল।

এছাড়াও জর্জিও, কার্ল, কোকো শ্যানেল, বিএমডব্লিউ, ইভস সেন্ট লরেন্ট, কোডাক, টয়োটা, কার্ল লেগার ফিল্ড, আরমানিসহ অসংখ্য অভিজাত ব্র্যান্ডের মডেল ছিলেন বিবি রাসেল। ক্যাটওয়াক করেছেন নাওমি ক্যাম্পবেল, ক্লদিয়া শিফারের মতো বিশ্বখ্যাত সুপার মডেলদের সঙ্গে।

বিবি প্রোডাকশনস

বিশ্বের জনপ্রিয়তকে পেছনে ফেলে প্রিয় মাতৃভূমির টানে বিবি রাসেল দেশিয় বস্ত্র ও হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করার একান্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৯৪ সালে। তার ফ্যাশন সংস্থা ‘বিবি প্রোডাকশনস’ যাত্রা শুরু করে ১৯৯৫ সালে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত তাঁতপল্লীতে গিয়ে তিনি গামছা, খাদি কিংবা জামদানির মতো দেশীয় বস্ত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগ দেন। চেষ্টা চালিয়ে যান দেশীয় হস্তশিল্পকে বিশ্ববাজারে পরিচয় করিয়ে দিতে। সুযোগ আসে ১৯৯৬ সালে, ইউনেস্কোর সহায়তায় ‘উইভারস অব বাংলাদেশ’ নামে ‘বিবি প্রোডাকশনস’ ইউরোপে তিনটি বড় ফ্যাশন শো করে। প্রতিটি প্রদর্শনীই দর্শকের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। প্যারিস প্রদর্শনী থেকে যে অর্ডার তিনি পেয়েছিলেন, তাতে বাংলাদেশের প্রায় তিরিশ হাজার তাঁতির কর্মসংস্থান হয়েছিল তখন।

বিবির কাজের অন্যতম একটি লক্ষ্য ফ্যাশনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন। তিনি নিজেই ড্রেস, ব্যাগ, জুতা, ওড়না, স্কার্ফ, অলংকার, চুড়ি ইত্যাদির নকশা করেন। বিবি প্রডাকশনস-এর অধিকাংশ পণ্যই হাতে বোনা। তিনি বলেন, ‘আমি সিন্থেটিক উপকরণ ব্যবহার করি না। আমি যে কাপড়গুলি ব্যবহার করি তা হল খাদি, তুলা, সিল্ক, গামছা, পাট, পূর্ণব্যবহারযোগ্য কাপড় এবং জামদানি’। তিনি মনে করেন, সুতির কাপড় যেকোন ঋতুতেই শরীরকে আরাম দেয়। খাদি তার সবচেয়ে পছন্দের। বিবি প্রোডাকশনস-এর ৬০ শতাংশ পোশাক খাদি কাপড় দিয়ে তৈরি। যার দামও খুব বেশি নয়। সব ধরনের ফ্যাশনপ্রিয় মানুষই যেন শপিং করতে পারেন সেজন্য দামের দিক থেকে সব সময়ই সূলভ রাখার চেষ্টা করেন। এছাড়াও বিবি রাসেল রিকশা আর্টের উপর ভিত্তি করে চশমার ফ্রেম ডিজাইন করেন। রিকশা আর্টের সব প্রোডাকশন রিকশা আর্টিস্টদের দিয়েই করানো হয়।

 

ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের হস্তশিল্পীদের হাতে জাদু আছে। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে তিনি তাঁতিদের খোঁজখবর নেন, নিবিড় সম্পর্কে মেতে ওঠেন, একসঙ্গে কাজ করেন। গ্রামীণ তাঁতিদের দক্ষতার সঙ্গে বিবি যুক্ত করেছেন বৈশ্বিক রুচি ও ব্যতিক্রমী সব ডিজাইন। শুধু দেশেই নয়, ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ডেনমার্ক ও কম্বোডিয়ার তাঁতিদের নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ ধারার প্রায়োগিক চর্চা শুরু করেন। ফ্যাশন হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার। এই ধারণার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’। জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কম্বোডিয়ায় এইচআইভি পজিটিভ নারীদের সঙ্গে এবং স্পেনের কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী নারীদের সঙ্গে নিয়ে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’- এর কাজ করেছেন।

বহুমুখী উন্নয়ন কর্ম পরিচালনায় তার অবদান অপরিসীম। যেমন- অ্যাসিড আক্রান্ত নারীদের নিয়ে ফ্যাশন শো আয়োজন করা কিংবা কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের জন্য ব্যতিক্রমী দোকান চালু করা। যেখানে তারা দেশজ সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্য বহনকারী শিল্পপন্য উৎপাদন, প্রদর্শন ও বিপনন করতে পারেন।

সম্মাননা

এই সমস্ত নানা কর্মজজ্ঞের জন্য বিবি রাসেল অর্জন করেছেন দেশী-বিদেশী অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি। তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো। ১৯৯৭ সালে ‘এল ম্যাগাজিন’-এর বিবেচনায় বর্ষসেরা নারী হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৯ সালে লন্ডন আর্ট ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ পান। একই বছর ইউনেস্কো তাঁকে ‘ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট’ খেতাবে ভূষিত করে। ২০০১ সালে ইউনেস্কো আরেকবার তাঁকে ‘শান্তির শিল্পী’ পদক দেয়।

২০০৮ সালে ইউএনএইডস তাঁকে শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করে। ২০১০ সালে স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘দ্য ক্রস অব অফিসার অব দ্য অর্ডার অব কুইন ইসাবেলা’ পদক পান। ২০১০ সালের সেরা চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’-এর জন্য শ্রেষ্ঠ পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৩ সালের নারী দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্লগ ‘ফ্যাশন কম্প্যাশন’ ফ্যাশনে ব্যাপক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ১০ নারী ফ্যাশন ডিজাইনারের নামের তালিকা ঘোষণা করে। এই ১০ নারীর মধ্যে এশিয়ার একমাত্র ডিজাইনার হচ্ছেন বিবি রাসেল। ২০১৫ সালে নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী জাগরণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করে। উপরোক্ত সম্মাননা ছাড়াও আরো অনেক পুরস্কার আর সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বিবি রাসেল। বিবির জীবন ও কর্ম নিয়ে সোনিয়া কিরপালানি নির্মান করেছেন প্রামাণ্যচিত্র ‘সিল্কেন সিনার্জি’। 

তার গামছা স্কার্ফ প্রথম থেকেই বেশ জনপ্রিয়। স্পেনের রানী সোফিয়া এবং অ্যান্টোনিও ব্যান্ডেরাস পর্যন্ত বিবির গামছা স্কার্ফ পরেছেন। ব্যান্ডেরাস তার থেকে ক্রিসমাসের উপহার নিয়েছিলেন এই গামছা। ম্যাডোনা গামছা চুড়ি পরেছেন। তার হাত ধরেই রিকশা আর্ট জনপ্রিয় ফ্যাশন ট্রেন্ড-এ পরিনত হয়।

হাতে বোনা খাদি, মসলিন, জামদানি ও উন্নতমানের সুতি কাপড়ের ব্যবহারে তাঁর ডিজাইন ও ফ্যাশন সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে অন্য রকম মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। ইউরোপের বিশ্বসেরা আটটি ব্র্যান্ড আরমানি, ভেলেন্তিও, পলস্মিথ, কেলভিন ক্লেইন, হুগোবস, ম্যাক্স মারা ও লরেন ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ‘বিবি রাসেল’ নামের ব্র্যান্ডও ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম।

বর্তমানে তিনি বিস্কুট/চিপসের খালি প্যাকেট কিভাবে কাজে লাগানো যায়, এ বিষয়ে গবেষণা করছেন। রিসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে কাপড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্যান্ডেল, ব্যাগ, পার্স, গয়না ও ডায়েরি বানানোর পরিকল্পনা নিচ্ছেন তিনি। এই হলেন বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের পথিকৃৎ বিবি রাসেল। দেশের তাঁতি গোষ্ঠী, দেশজ সংস্কৃতি ও  শিল্পের প্রতি তার অনুরাগ ও কর্মস্পৃহা হাজারো তরুণ-তরুনীদের উদ্যোমী হতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। সমাজ ও মানুষের উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার উজ্জ্বল এক উদাহরণ বিবি রাসেল। তার একান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’-এর ধারা বিকশিত হয়েছে। বিবি রাসেলকে নিয়ে গর্বিত আমরা, গর্বিত বাংলাদেশ।   

 

রাম কৃষ্ণ সাহা
চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top