সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


বাংলা সিনেমার গৌরবময় ঐতিহ্য : শিবব্রত গুহ


প্রকাশিত:
২৭ জুলাই ২০২০ ২১:২৮

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২১:২৩

ছবিঃ উত্তম-সুচিত্রা

 

বাঙালীর অত্যন্ত গর্বের হল বাংলা সিনেমা। এই সিনেমার ঐতিহ্য এককথায় অসাধারণ। ভারত তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, বাংলা সিনেমার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই সিনেমার জগতে কত যে মনি - মানিক্য ছড়িয়ে আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।

প্রথমেই আসি আমদের সবার প্রিয় মহানায়ক উত্তম কুমারের কথায়। সেই ১৯৮০ সালের ২৪শে জুলাই, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তারপরে, এখন ২০২০ সাল। এখনো, এখনো, তিনি আছেন জীবন্ত বাংলা সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের হৃদয়ে।
তাঁর অসাধারণ অভিনয় আজো মানুষকে হাসায়, কাঁদায়। যে কোন চরিত্র মহানায়ক খুব সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। তিনি যেমন নায়কের চরিত্রে সাবলীল ছিলেন, ঠিক তেমনি খলনায়কের চরিত্রেও। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, বাঘবন্দি খেলা, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী - এই বাংলা সিনেমাগুলো।

উত্তমকুমারের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে উঠে আসে বাংলা সিনেমার মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কথা। উত্তম - সুচিত্রা জুটি বাংলা সিনেমার সর্বকালের সেরা রোমান্টিক জুটি। এই জুটির কোন বিকল্প আজও তৈরি হয়নি বাংলা সিনেমাতে। সেই সাড়ে চুয়াত্তর থেকে শুরু, তারপর, একে একে পথে হল দেরি, হারানো সুর, ইন্দ্রানী, সাগরিকা সহ একের পর এক সুপার ডুপার হিট সিনেমা। এদের দুজনের কেমিস্ট্রি ছিল একদম আলাদা। তাইতো, এই জুটি বাংলা সিনেমার জগতে এত জনপ্রিয় এখনো।

সুচিত্রা সেনের অভিনয় দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তার একটি উদাহরণ হল দ্বীপ জেলে যাই, বাংলা সিনেমাটি। এছাড়া, বাংলা সিনেমার জগতে অনেক ভালো ভালো অভিনেত্রী তাঁদের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে বাংলা সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের হৃদয় করেছেন জয়। তাঁদের মধ্যে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, কানন দেবী, সন্ধ্যা রায়, অপর্না সেন, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়, শতাব্দী রায় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ছবিঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়


বাংলা সিনেমাতে নায়ক হিসাবে উত্তমকুমারের পরেই যাঁর নাম করতে হয়ে, তিনি হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ইনিও একজন অসাধারণ অভিনেতা। সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ সিনেমাতে ইনিই নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি নাম বলি, চারুলতা, অপুর সংসার প্রভৃতি। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদার চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ফেলুদাকে নিয়ে তৈরি করা সিনেমা সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথে
অসাধারণ অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেন তিনি। যে কোন চরিত্র খুব সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন তিনি। ঝিন্দের বন্দী সিনেমাতে মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথে তাঁর অভিনয় দ্বৈরথ আজও দর্শকদের মনে রয়েছে জীবন্ত।

ছবিঃ মিঠুন চক্রবর্তী
বাংলা সিনেমার এক দাপুটে অভিনেতার নাম হল মিঠুন চক্রবর্তী। বলিউড, টলিউড - সর্বত্র তিনি সফল হয়েছেন। মিঠুন হলেন একজন সুদক্ষ অভিনেতা। তাঁর অভিনয় বাংলা সিনেমার দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে আজও। সবরকম চরিত্র
ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখেন তিনি। তিনি একদিকে রোমান্টিক হিরো, অন্যদিকে মারপিটের দৃশ্যেও তিনি একজন সাবলীল হিরো।
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, ত্রয়ী, অন্যায় অবিচার, পদ্মা নদীর মাঝি, মৃগয়া, বারুদ হল তাঁর অভিনীত কয়েকটি বাংলা ছবি।

বাংলা সিনেমাতে সুদক্ষ নায়কের অভাব কখনো হয়নি। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করছি। বিশ্বজিৎ, অনিল চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, কিশোর কুমার, তাপস পাল, প্রসেনজিত, চিরঞ্জীত , সোহম, দেব, জিৎ, রঞ্জিত মল্লিক প্রভৃতি।

বাংলা সিনেমার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে কমেডি অভিনেতারা। তাঁরা দর্শকদের হাসাতে ওস্তাদ। তাঁদের অভিনয় দেখলে আপনার হাসতে হাসতে পেটে ধরে যাবে খিল। তাঁদের মধ্যে সবার আগে বলি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে জহর রায়ের সোনার কমেডিয়ান জুটির কথা। এনারা দুজনেই ছিলেন অভিনয়ের ক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক। সাড়ে চুয়াত্তর, ভানু পেল লটারি, মিস প্রিয়ংবদা এই সিনেমাগুলো কখনো যাবে না ভোলা। রবি ঘোষ, অনুপ কুমার, চিন্ময় রায়, কিশোর কুমার, উৎপল দত্ত, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শুভাশীষ মুখার্জি, রজতাভ দত্ত এনারাও বাংলা সিনেমার হাসির অভিনয়কে করেছেন সমৃদ্ধ।


ছবিঃ উৎপল দত্ত

 

বাংলা সিনেমাতে অনেক ভালো ভালো খলনায়ক এসেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসি উৎপল দত্তের কথায়। একজন বিরাট মাপের অভিনেতা ছিলেন উৎপল দত্ত৷ তাঁর খলনায়কের চরিত্রে মেশানো থাকতো কমেডির ছোঁয়া। অন্যায় অবিচার, অমানুষ, অনুসন্ধানে আমরা তার পরিচয় ভালোভাবে পাই। তারপরে আসি বিকাশ রায়ের কথায়। বিকাশ রায়ের খলনায়কের চরিত্রাভিনয় ছিল অপূর্ব। তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল উত্তর ফাল্গুনী। এছাড়া, দিলীপ মুখার্জী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, দীপঙ্কর দে এনারা প্রত্যেকেই বাংলা সিনেমার নামী খলনায়ক।

বাংলা সিনেমাতে এসেছেন সব অসাধারণ চরিত্রাভিনেতা। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসি পাহাড়ী সান্যালের কথায়। চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রভৃতি হল তাঁর অভিনীত কয়েকটি ছবি। মহানায়ক উত্তম কুমার ও তাঁর পরিবারের সাথে পাহাড়ী সান্যালের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। এছাড়া, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র - এনারাও এক
একজন দিকপাল চরিত্রাভিনেতা ছিলেন। এনাদের অভিনয় আজো দর্শক পারেনি ভুলতে।

সবশেষে আসি, বাংলা সিনেমার পরিচালকদের কথায়। সবার প্রথমে যাঁর কথা বলবো, তিনি হলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। তাঁর নাম হল সত্যজিৎ রায়। তিনি একমাত্র ভারতীয় চিত্র পরিচালক, যিনি অস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি সারাজীবনে, দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তাঁর সব সিনেমাই দেশে বিদেশে অনেক প্রশংসা পেয়েছে। চারুলতা, গণশত্রু, চিড়িয়াখানা, নায়ক, অপুর সংসার, হীরক রাজার
দেশে, পথের পাঁচালী, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ হল তাঁর পরিচালিত কয়েকটি অসাধারণ বাংলা সিনেমা। এরমধ্যে, পথের পাঁচালী বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে দিয়েছে এক মর্যাদার আসন। মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, ঋত্বিক ঘটকের মতো সুদক্ষ পরিচালকেরা করেছেন বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ।

তাই, একথা বলতেই হয়, যে, বাংলা সিনেমার গৌরবময় ঐতিহ্য বারংবার গর্বিত করেছে আপামর বাঙালী জাতিকে।

 

শিবব্রত গুহ
কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top