সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


শ্রদ্ধাবনত স্মরণ!

হাজারিকা-রোবসন আ-জীবন সংযুক্ত থাকবে অবিচ্ছেদ্য নাড়িতেই! : তন্ময় সিংহ রায় 


প্রকাশিত:
২৭ জুলাই ২০২০ ২১:৩৭

আপডেট:
২৭ জুলাই ২০২০ ২২:১১

ছবিঃ ভূপেন হাজারিকা

 

'বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-
হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি-
গঙ্গা বইছ কেন?'

চিরসবুজ সৃষ্টি ও সৃষ্টিকেন্দ্রিক গায়কি'র এই অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা আজও সমানভাবে মুগ্ধ, মোহিত ও আন্দোলিত করে অসংখ্য বাঙালীসহ বিশেষত দুইবাংলার সংগীত প্রেমীর হৃদয়কে!

ভারতীয় সংগীত জগতের সেই পুরোধা ও কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভূপেন হাজারিকা জন্মেছিলেন ব্রিটিশ-ভারতে অর্থাৎ ১৯২৬ সালের ৮ ই সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের অসম রাজ্যে। অসমিয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে ভুমিষ্ঠ হয়ে, হিন্দি ও বাংলা গানে পরবর্তীকালে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশে তিনি অর্জন করেন অসম্ভব জনপ্রিয়তা!

অত্যন্ত দরাজ গলার অধিকারী এই কন্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল গগনচুম্বী! শুধু গায়ক হিসেবেই থেমে থাকেনি তাঁর শৈল্পিক জীবনের গতিবেগ, একাধারে তিনি ছিলেন সুরকার, কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সঙ্গীতজ্ঞ।

ভূপেন হাজারিকার গানগুলোতে বারেবারেই উচ্চারিত হয়েছে মানবপ্রেম, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের পক্ষে ও বিপক্ষে এক বলিষ্ঠ  প্রতিবাদী সুর!

১৯৭৫ সালে ২৩ তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র চামেলী মেমসাহেব ছবির সংগীত পরিচালক হিসাবে তিনি লাভ করেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।

এরপর ১৯৭৭ সালে পান পদ্মশ্রী সম্মান।

১৯৭৯ সালে শ্রেষ্ঠ লোকসংগীত শিল্পী হিসাবে তিনি অর্জন করেন অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন পুরষ্কার ও সাল ১৯৮৭ তে সাম্মানিক হিসেবে অর্জন করেন, অসম সরকার দ্বারা শঙ্করদেব পুরষ্কার।

ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরষ্কার দাদাসাহেব ফালকে পান ১৯৯২ তে।

এ ছাড়াও জাপানে, ১৯৯৩ এ এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রুদালী ছবিতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের(প্রথম ভারতীয়) পুরষ্কার, ২০০১ এ পদ্মভূষণ ও ২০০৯ সালে তিনি লাভ করেন অসমরত্ন। 

দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান হিসেবে ২০১৯ সালে তাঁকে ভূষিত করা হয় 'ভারতরত্ন' সম্মানে যা দাবী রাখে যথেষ্ট গৌরবের!

সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত এই শিল্পী'র, ছোটবেলা থেকেই সম্পর্ক স্থাপন হয় আসামের লোকজ গানের সঙ্গে। তিনি পছন্দও করতেন এই সমস্ত গানগুলি গাইতে।

আসামের সোনারাম, তেজপুর, ধুবড়ি এবং বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের সূত্রপাত ঘটিয়ে ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করেন পি.এইচ.ডি ডিগ্রি।

অমূল্য সব কালজয়ী সৃষ্টি উপহার দিয়ে অতঃপর ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর স্থানীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৪.৩৭ মিনিটে, কোকিলাবেন ধীরুভাই হাসপাতালে কিডনি বৈকল্য ও বার্ধক্যজনিত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে, এই অসম্ভব গুণী বিশ্বশিল্পী ভূপেন হাজারিকা  দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৮৫ বছর বয়েসে চলে যান আমাদের ছেড়ে!

আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলি এক জীবন্ত কোহিনুরের শরীরকে ঠিকই কিন্তু, তাঁর বর্ণময় ও তেজোদীপ্ত আলোকছটা'য় আজও লক্ষ-কোটি মন-প্রাণ হয়ে ওঠে উদ্ভাসিত! 

এখন যে মানুষটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো, তিনি অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান এক সু-বৃহৎ ও বলিষ্ঠ বটবৃক্ষ, যার চূড়া স্পর্শ করেছে গগনকে! 

জন্ম ১৮৯৮ সালে আমেরিকায়, আফ্রিকার কোনো এক দেশ থেকে তাঁর পূর্বপুরুষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়েছিল ক্রীতদাস হিসেবে।

আমেরিকা'র আন্তঃপ্রাদেশিক যুদ্ধ বা ৪ বছরের গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে অর্থাৎ ১৮৬০ সালে, বাবা উইলিয়াম এবং তাঁর ভাই(Uncle) ইজেকিয়েল তাঁদের মালিকের তুলোর খামার থেকে যখন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, উইলিয়ামের বয়স তখন ১৬ বছর। এরপর নর্থ ক্যারোলিনা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ির মাধ্যমে তাঁরা এসে উপস্থিত হন ক্রীতদাসপ্রথা-বিরোধী একটি স্টেট্ পেনসিলভেনিয়া-তে।

কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে নতুন জীবন জন্ম দিয়ে, ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে, লিঙ্কন কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি(Father) প্রিন্সটনে একটি ছোট্ট গির্জার নিযুক্ত হন যাজক হিসেবে, আর সেখানেই কেটেছে সেই বটবৃক্ষের প্রাথমিক জীবন।

অতঃপর রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলম্বিয়া ল'স্কুল। সেখানে আইনে স্নাতক হওয়ার পরে এক ল'ফার্মে চাকরি গ্রহণ করলেও শ্বেতাঙ্গ দ্বারা বঞ্চিত হয়ে, ইস্তফার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে আসেন পুরোনো

এবং অত্যন্ত শখের গানে এবং অল্পদিনের মধ্যেই যুগপৎ গায়ক এবং অভিনেতারূপে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন।

বলাবাহুল্য, বটবৃক্ষটি সে অধ্যায়ে নিগৃহীত হয়েছিলেন চতুর্দিক থেকেই! 

হলিউড থেকেও তিনি হন বিতাড়িত!

স্টেজ-শো করার ক্ষেত্রেও এসেছে বাধা-বিপত্তি! রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোও তাঁর গান প্রকাশ করতে প্রকাশ করেছে প্রবল অনীহা!

এক কথায়, আমেরিকা থেকে চিরতরে তাঁর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র! 

 

এতক্ষণে নিশ্চই প্রবল আগ্রহ দানা বেঁধে ফেলেছে মনে, যে কে সেই বটবৃক্ষ?

ছবিঃ পল রোবসন

তিনি আর কেউ নন, ভূপেন হাজারিকা'র বিপুল অনুপ্রেরণা গুরু, যাঁকে দেখে ও উপলব্ধি করে প্রায় মোহিত হয়ে যান ভূপেন হাজারিকা নিজে, তিনি স্বয়ং পল রোবসন।

যার নাড়ি আজীবন সংযুক্ত থাকবে 'ওল ম্যান রিভার' নামক বাঙালী নাড়ি'র সাথে। 

পরবর্তীতে রোবসনের, পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই গানের আদলেই তৈরি হয়েছে, হৃদয়স্পর্শী ও কালজয়ী সেই বাংলা গান,  

"বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-

হাহাকার শুনেও,

নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি-

গঙ্গা বইছ কেন?"

পরবর্তীকালে, পেনসিলভেনিয়ার বৃহত্তম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫ম জনবহুল শহর ফিলাডেলফিয়া'র ছোট্ট এক বাড়িই ছিল সেই কৃষ্ণাঙ্গের শেষ আশ্রয়! কৃষ্ণাঙ্গ বলে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে অবস্থিত একটি আইভি লীগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটন ঠাঁই তো দেয়ইনি তাঁকে উপরন্তু কমিউনিস্ট সন্দেহে সে দেশের সরকারও কেড়ে নিয়েছিল সেই মানুষটির পাসপোর্ট। তবুও তাঁর গান ভেদ করেছে সমগ্র পৃথিবী'র হৃদয়কে! 

আর তিনি না থাকলে, বিস্তীর্ণ দু'পারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও গঙ্গার সেই নীরব প্রবহমানতা নিয়ে কোনো অভিযোগও জানাতে পারতোনা এই বাংলা গানটি!

শিল্পী'র দেহটুকু শুধু ত্যাগ করে এ গ্রহ ঠিকই কিন্তু, হৃদপিন্ডটা রেখে যান শিল্পেই।

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top